১৮ নভেম্বর ১৮৫৭ চট্টগ্রামে হাবিলদার রজব আলী খাঁর বিদ্রোহ
- মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ
- ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
প্রায় ২০০ বছরের পরাধীনতা কাটিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের আকাশে স্বাধীনতার সূর্যোদয় খুব একটা সহজ কাজ ছিল না; কিন্তু এই অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলেছেন দেশের অসীম সাহসী বীর বিপ্লবীরা। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে শত সহস্র দেশপ্রেমিক বিপ্লবীর দীর্ঘ লড়াইয়ের ফল আমাদের আজকের এই স্বাধীনতা। আর কঠিন এই লড়াইয়ে দেশকে প্রতি মুহূর্তে পথ দেখিয়েছেন বাংলা মায়ের লড়াকু সন্তানেরা।
স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ এই ইতিহাসে এমন অনেক বঙ্গবিপ্লবী আছেন যাদের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ তাদের নাম মুছে গেছে মানুষের অগোচরে। তেমনই এক নাম বীর যোদ্ধা হাবিলদার রজব আলী খাঁ। অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রাম জেলার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। তবে তার জন্ম ও বংশ পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে গেছে । ঠিক কবে কোথায় কিভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন সেই তথ্যও আমাদের অজানা। অনেক ইতিহাসবিদের অনুমান চট্টগ্রামে সিপাহি বিদ্রোহের নায়ক সন্দ্বীপের, অনেকের মতে তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের অধিবাসী ছিলেন।
তরুণ বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার হিসেবে রজব আলী খাঁ কর্মজীবন শুরু করেন। ১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলনের সময় তিনি চট্টগ্রামের সিপাহিদের নেতৃত্ব দেন।
১৮ নভেম্বর ১৮৫৭ রাত ৯টা নাগাদ চট্টগ্রামে রজব আলী খাঁর নেতৃত্বে সিপাহিরা গুলি ছুড়ে বিদ্রোহ করেন। জেলের তালা ভেঙে সিপাহিরা স্বাধীনতাকামী কয়েদিদের মুক্ত করেন। এরপর তারা আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে আশ্রয় নেন। চট্টগ্রামে সিপাহিদের এই সঙ্ঘবদ্ধ বিদ্রোহে সেখানকার ব্রিটিশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ইংরেজ নাগরিকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রের বুকে জাহাজে আশ্রয় নেয়। এর ফলে চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়ে পড়ে। টানা ৩০ ঘণ্টা চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত রাখার পর ১৯ নভেম্বর ভোর রাতে সিপাহিরা রজব আলী খাঁর নেতৃত্বে অস্ত্রশস্ত্রসহ পিলখানা থেকে হাতি নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। চট্টগ্রাম ত্যাগ করার আগে সিপাহিরা কুচকাওয়াজ ময়দানে একত্রিত হন। বর্তমানে এই মাঠ চট্টগ্রাম প্যারেড গ্রাউন্ড বা চট্টগ্রাম কলেজ মাঠ নামে পরিচিত।
সিপাহিরা রজব আলী খাঁর নেতৃত্বে ঢাকায় ৭৩ নম্বর দেশীয় পদাতিক বাহিনীর সিপাহিদের সাথে যোগ দেয়ার উদ্দেশে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু তার আগেই ঢাকার সিপাহিরা ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে যান। এই খবর পেয়ে রজব আলী খাঁ তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ত্রিপুরা চলে যান। ২ ডিসেম্বর ত্রিপুরার প্রবেশ দ্বারে পৌঁছলেও রজব আলী খাঁর নেতৃত্বে সিপাহিরা ত্রিপুরায় প্রবেশে ইংরেজ সৈন্যদের বেপরোয়া আক্রমণে বাধাগ্রস্ত হন। এরপর তারা সেখান থেকে মনিপুরের গভীর জঙ্গলে চলে যান।
দীর্ঘ যাত্রাপথে একের পর এক যুদ্ধ ও খাদ্যাভাবে সিপাহিরা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। হাবিলদার রজব আলী খাঁরও আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। সবার অজ্ঞাতেই থেকে যায় অসীম সাহসী এই বীর বিপ্লবীর শেষ জীবন। ভারত উপমহাদেশের ৭৩তম ও বাংলাদেশের ৫২তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে এই অসীম সাহসী বীর যোদ্ধাকে স্মরণ করে তার প্রতি জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম। তার আত্মত্যাগের ফসল আমাদের এই স্বাধীনতা।
১৮৫৭ সালে সিপাহিদের মহাবিদ্রোহ : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছলে-বলে-কৌশলে ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতবর্ষ দখল করে নেয়। এ স্বাধীনতা হরণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুসলিম সম্প্রদায়; পক্ষান্তরে সার্বিকভাবে লাভবান হয় সনাতন ধর্মের লোকেরা। ব্রিটিশ শাসকরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, লাখেরাজ (করবিহীন) সম্পত্তি দখল, জায়গিরদারি প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের একেবারে পথে বসিয়ে দেয়। ১৮৩৫ সালে রাষ্ট্রভাষা ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি করার মাধ্যমে দাফতরিক কাজ ও ইংরেজদের সাথে যোগযোগের সব সুযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। সেক্যুলার শিক্ষার প্রবর্তন ও ধর্মীয় স্থান থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আলাদা করার ফলে মুসলমানরা নিরক্ষর হয়ে পড়ে। শত-সহস্র মুসলিম স্বাধীনতাকামীকে প্রকাশ্যে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয় ও বাকিদের কালাপানিয়া তথা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসনের মাধ্যমে মুসলমানদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর হিম্মত বিনষ্ট করা হয়। এভাবে কেটে যায় আরো ১০০ বছর; ১৭৫৭ হতে ১৮৫৭ সাল।
ইতোমধ্যে সুবিধাবঞ্চিত হিন্দু সাধারণ জনগণ এবং বৈষম্যের শিকার দেশীয় সৈনিকরা ভেতরে ভেতরে ইংরেজদের ওপর বিক্ষুব্ধ হতে থাকে। একজন ভারতীয় সৈন্য যেখানে বেতন পেতেন মাসে মাত্র ৯ রুপি, সেখানে ইংরেজ সৈনিক পেত ৪০ রুপি। আবাসস্থল, পোশাক-পরিচ্ছদ, রেশন, চিকিৎসাসুবিধা প্রভৃতিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বৈষম্যমূলক শাসন ভারতবাসীকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে।
ঠিক সে মুহূর্তে ইংল্যান্ড থেকে সৈনিকদের জন্য আসে এক নতুন রাইফেল। নাম এনফিল্ড রাইফেল। তখন সিপাহিদের রাইফেলের কার্তুজ মুখ দিয়ে ছিঁড়ে বন্দুকের ভেতর ঢুকিয়ে তারপর গুলি করতে হতো। জানা গেল, এই রাইফেলের মুখে যে টেপ লাগানো রয়েছে তাতে গরু ও শূকরের চর্বি মেশানো আছে। এর দ্বারা হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে বিশেষভাবে আঘাত হানে।
২৯ মার্চ ১৮৫৭ ব্যারাকপুরে ৩৪ বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির ২৬ বছর বয়সী সিপাহি মঙ্গল পান্ডে সর্বপ্রথম বিদ্রোহের সূচনা করেন। ১০ মে ১৮৫৭ সালে মিরাট শহরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সৈন্যরা সসস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহ ক্রমান্বয়ে কানপুর, পাটনা, রাজস্থান, লক্ষেèৗ, বেরেলি, ঝাঁসি, গোয়ালিয়র, বিহার, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, অযোদ্ধা, চট্টগ্রাম (১৮ নভেম্বর ১৮৫৭) ও দিল্লিতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে শুধু সৈনিকরা নয় সাধারণ মানুষও ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা ১০ জুন ১৮৫৮ সালে গিয়ে শেষ হয়। তাই এটি আমাদের প্রথম মহাবিদ্রোহ তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম।
এই সংগ্রামের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত শাসনের অবসান ঘটে। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বশেষে গভর্নর জেনারেল ছিলেন চার্লস ক্যানিং। বাহাদুর শাহ জাফরের সন্তানদের শাহাদত এবং স্বয়ং সম্রাটের বন্দিত্বের মাধ্যমে মোগল শাসনের ইতি টানা হয়। পতন হয় লাল কেল্লার তথা ভারত উপমহাদেশে সুদীর্ঘ ৭৬৬ বছরের একটানা মুসলিম শাসন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা