১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

হজ প্যাকেজ ২০২৫, কিছু কথা

-

বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এ দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯১ শতাংশ মুসলমান। প্রতি বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলমান এ দেশ থেকে হজব্রত পালন করেন।
হজ শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত। যেসব মুসলিম নর-নারীর শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে কেবল তাদের জন্যই হজ ফরজ। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালে সরকারি মাধ্যমে ‘সাধারণ হজ প্যাকেজ’ শিরোনামে একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল যেখানে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল পাঁচ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকা। এর সাথে নিবন্ধনের সময় অতিরিক্ত আট হাজার ৫৫০ টাকা পরিশোধ করে ট্রেনে মিনা-আরাফাহ-মুজদালিফাহ-মিনায় যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল। এ ছাড়া গত হজ মৌসুমে ‘সরকারি মাধ্যমে বিশেষ হজ প্যাকেজ-২০২৪’ শিরোনামে অন্য যে প্যাকেজটি ছিল সেখানে সর্বমোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ টাকা। এই বিশেষ প্যাকেজটির কিছু বৈশিষ্ট্যও ছিল। এতে হজযাত্রীদের জন্য হারাম শরিফের বহির্চত্বর থেকে ৭০০ মিটারের মধ্যে আবাসনের ব্যবস্থা ছিল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হোটেলে প্রতি রুমে সর্বোচ্চ চারজনের আবাসন, মিনায় ‘এ’ ক্যাটাগরির তাঁবুতে অবস্থানসহ বুফে খাবার গ্রহণের ব্যবস্থা ছিল। ২০২৩ সালে সরকারি মাধ্যমে শুধু একটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল যেখানে সর্বমোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ছয় লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা।
জনশ্রুতি আছে, বাংলাদেশের নিকটতম দেশ ভারত এবং পাকিস্তানের মুসলমানরা বাংলাদেশের হজযাত্রীদের চেয়ে অনেক কম টাকায় হজব্রত পালন করতে পারেন। এ বিষয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মে নানা আলোচনা দেখা যায়। হজের প্যাকেজ মূল্য কমানোর দাবিতে সোস্যাল প্ল্যাটফর্মেও অনেকে বেশ সরব ভূমিকা রাখেন। ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে হজ প্যাকেজ মূল্য যৌক্তিক করার কথা বলেছেন।
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এবার ২০২৫ সালের হজ প্যাকেজ করা হয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে হজ প্যাকেজ ২০২৫ ঘোষণা করেন। এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ হজ প্যাকেজ-১ ও সাধারণ হজ প্যাকেজ-২ নামে দু’টি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। সাধারণ হজ প্যাকেজ-১-এর মূল্য চার লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকা এবং অন্যটির মূল্য পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমের সাধারণ হজ প্যাকেজ মূল্য ধরা হয়েছে চার লাখ ৮৩ হাজার ১৫৬ টাকা। তবে হজ এজেন্সির জন্য একটি অতিরিক্ত বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণার সুযোগ রাখা হয়েছে।
এ বছর বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজব্রত পালনের সুযোগ পাবেন। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ২০২৫ সনের ৫ জুন পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে।
সরকারি মাধ্যমে ‘সাধারণ হজ প্যাকেজ-১’-এ মক্কায় হারাম শরিফের বহির্চত্বর থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে এবং মদিনায় মসজিদে নববী থেকে সর্বোচ্চ দেড় কিলোমিটারের মধ্যে আবাসনের ব্যবস্থা থাকবে। মক্কায় হারাম শরিফে যাতায়াতের জন্য থাকবে বাসের ব্যবস্থা। এই প্যাকেজটিতে মিনায় তাঁবুর অবস্থান হবে গ্রিন জোনে (জোন-৫) এবং মিনা-আরাফায় ‘ডি’ ক্যাটাগরির সার্ভিস পাওয়া যাবে।
সরকারি মাধ্যমে ‘সাধারণ হজ প্যাকেজ-২’-এ মক্কায় হারাম শরিফের বহির্চত্বর থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে এবং মদিনায় মার্কাজিয়া এলাকায় আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। এই প্যাকেজের হজযাত্রীদেরকে মিনায় ইয়োলো জোনে (জোন-২) আবাসনের ব্যবস্থাসহ উন্নততর ‘ডি’ ক্যাটাগরির সার্ভিস ও মিনা-আরাফায় মোয়াল্লেমের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করা হবে। উভয় প্যাকেজের হজযাত্রীদের জন্য মক্কার হোটেল কিংবা বাড়ি থেকে বাসযোগে মিনার তাঁবুতে এবং মিনা-আরাফাহ-মুজদালিফা-মিনা ট্রেনযোগে যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া মিনা এবং আরাফায় মোয়াল্লেমদের দিয়ে খাবার পরিবেশন করা হবে। দু’টি প্যাকেজেই মক্কা ও মদিনায় বাড়ি বা হোটেলে রুমসংলগ্ন বাথরুমসহ প্রতি রুমে সর্বোচ্চ ছয়জনের আবাসনের ব্যবস্থা থাকবে।
উল্লেখ্য, এ বছর প্রত্যেক হজযাত্রীকে খাবার বাবদ ন্যূনতম ৪০ হাজার টাকার সমপরিমাণ সৌদি রিয়াল এবং কোরবানি বাবদ ৭৫০ সৌদি রিয়াল আবশ্যিকভাবে সাথে নিতে হবে।
সাধারণত হজ প্যাকেজে দু’টি বিষয় আলোকপাত করা হয়ে থাকে; যথা- প্রতিশ্রুত সেবা ও সেবামূল্য। হজব্রত পালনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সেবাগুলোকে আমরা প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন- পরিবহন, আবাসন, খাবার ও বিবিধ খরচ।
পরিবহন সেবাটিকে দু’টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যথা- বিমান ও বাস। সৌদি আরবের অভ্যন্তরে হজযাত্রীদের যাতায়াতের জন্য চুক্তিবদ্ধ কোম্পানি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে পরিবহন সেবা দিয়ে থাকে। মক্কায় হারাম শরিফ থেকে দূরত্ব ও হোটেলের মান অনুসারে ভাড়ার তারতম্য হয়। মদিনাতেও তাই। হোটেল ভাড়ার বাইরে মিনা ও আরাফায় তাঁবুতে অবস্থানকালে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানি খাবার সরবরাহ করে। বাকি সময়ের জন্য খাবার বাবদ বাংলাদেশী টাকায় ৩৫-৪০ হাজার টাকার প্রয়োজন হয়।
পরিবহন, আবাসন এবং খাদ্য- এই তিন খাতে খরচের বাইরে ভিসা ফি, স্বাস্থ্যবীমা, হজ গাইড, জমজমের পানি, প্রশিক্ষণ প্রভৃতির জন্য নির্ধারিত ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়ে থাকে।
হজযাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে বিধিবদ্ধ নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়। তাই স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় হজ ফ্লাইটে জনপ্রতি ভাড়া বেশি পড়ে।
বাংলাদেশ বিমান, সাউদিয়া ও ফ্লাইনাস- এই তিনটি এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের হজযাত্রী পরিবহন করে। এ তিনটি এয়ারলাইন্সের ভাড়া সমান। বিগত কয়েক বছর হজযাত্রী পরিবহনে বিমানভাড়া নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। পাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ থেকে বিমানভাড়া অনেক বেশি বলে পত্রপত্রিকা কিংবা গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ বছর হজ প্যাকেজ ঘোষণার আগে বাংলাদেশ বিমান, সাউদিয়া ও ফ্লাইনাস এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের সাথে কয়েক দফা মতবিনিময় সভা হয়। প্রতিটি সভায় ধর্ম উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। প্রথম সভায় বাংলাদেশ বিমানভাড়া কমানোর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানায়। পরে সবার সাথে আলোচনা করে এ বছর বিমানভাড়া চূড়ান্ত হয়েছে এক লাখ ৬৭ হাজার ৮২০ টাকা, যা গতবারের তুলনায় ২৬ হাজার ৯৮০ টাকা কম। প্রসঙ্গত, এ বছর কলকাতা থেকে হজযাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৫ রুপি, যা বাংলাদেশী টাকায় এক লাখ ৭২ হাজার ৫৩৬ টাকার সমপরিমাণ যা বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা বেশি। ভারত সরকার মক্কায় তাদের হজযাত্রীদের আবাসনের ব্যবস্থা করবে আজিজিয়ায়। অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশী হজযাত্রীরা ভারতীয়দের চেয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হারাম শরিফের দিকে এগিয়ে থাকবেন। ২০২৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার হজযাত্রীদের হজব্রত পালনে ব্যয় হয়েছে ৯ কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার ২৮৬ রুপি, যা বাংলাদেশী টাকায় সাত লাখ ৯ হাজার ৯১৮ টাকার সমান। গত বছর মালয়েশিয়ার হজযাত্রীদের হজব্রত পালনে খরচ করেছে ৩৩ হাজার ৩০০ রিঙ্গিত যা বাংলাদেশী টাকায় ৯ লাখ ২০ হাজার ৭৪৫। তবে ২০২৪ সালে পাকিস্তানের একজন হজযাত্রী চার লাখ ৬২ হাজার ২৫০ টাকায় হজ পালন করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের মতোই পাকিস্তানের হজযাত্রীদের আবাসন ছিল আজিজিয়ায়।
হজ প্যাকেজ ঘোষণার প্রাক্কালে ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, সব অংশীজনের মতামত, বিভিন্ন খাতে খরচের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও সম্ভাব্য সবধরনের ব্যয় বাস্তবভিত্তিক ও যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে এ বছরের হজের প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ বছর হজ প্যাকেজে খাবারের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়টিকে অনেকেই নেতিবাচকভাবে দেখছেন। সরকারি মাধ্যমে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হজব্রত পালন করেছেন এমন হজযাত্রীদের নিশ্চয় মনে আছে, সরকার হজ প্যাকেজে খাবারের ব্যয় বাবদ যে পরিমাণ টাকা গ্রহণ করে সেই পরিমাণ টাকা হজে যাওয়ার প্রাক্কালে আশকোনা হজক্যাম্পেই হজযাত্রীদেরকে ফেরত দেয়া হয়। খাবারের টাকা নিয়ে আবার তা ফেরত দেয়ার বাড়তি কাজটি এবার করা হয়নি। হজ ব্যবস্থাপনা সহজ করার লক্ষ্যেই এবার হজ প্যাকেজে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। আর কোরবানির টাকা অনেক বছর আগে থেকেই হজ প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের কারণেই এ বছর বিমানভাড়া ২৬ হাজার ৯৮০ টাকা কমেছে। রাজস্ব বোর্ডও হজযাত্রীদের জন্য বিমান টিকিটের ওপর শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। সৌদি রিয়ালের দাম গতবারের তুলনায় ২.৭৬ টাকা বেড়ে যাওয়ায় সঙ্গত কারণেই হজের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা; কিন্তু সরকার এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যাতে সুলভে হজ পালন করতে পারে সে লক্ষ্যে হজযাত্রীদের আবাসন ও সেবায় কিছুটা পরিবর্তন এনে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত হজ প্যাকেজ ঘোষণার মাধ্যমে এ দেশের হজযাত্রীদেরকে সর্বোত্তম সেবা দেয়াই সরকারের লক্ষ্য।
লেখক : সরকারি কর্মকর্তা


আরো সংবাদ



premium cement
বিদেশে আসিফ নজরুলকে হয়রানি : জেনেভার কাউন্সেলরকে প্রত্যাহার শিবালয়ে বিআইডব্লিউটিএয়ের ড্রেজার পাইপে আগুন আন্দোলনে আহতদের দেখতে হাসপাতালে বিএনপি নেতারা, ৫ লাখ টাকা অনুদান রূপগঞ্জে ফতুল্লা ব্যবসায়ীর ৭ টুকরো লাশটির পরিচয় মিলেছে কুইক রেন্টালে দায়মুক্তির বিধান অবৈধ : হাইকোর্টের রায় হাজী সেলিমের ছেলে সাবেক এমপি সোলাইমান সেলিম গ্রেফতার চুয়াডাঙ্গায় নারীর বিবস্ত্র-অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার জাতীয় নির্বাচন কবে, জানালেন প্রধান উপদেষ্টা খুলনায় স্বর্ণের বারসহ যুবক গ্রেফতার সিলেটে দোকানে রেফ্রিজারেটর বিস্ফোরণে দগ্ধ ৭ আন্দোলনকারীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দাবি আহত স্বাধীনের

সকল