১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

প্রেক্ষিত ও প্রত্যাশা

-

পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের জীবনাচারে। পারিবারিক ও সমাজজীবনের এই পরিবর্তন প্রভাবিত করছে আমাদের জীবনদর্শনে। পরিবর্তন এনেছে পারিবারিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। এ পরিবর্তন এত দ্রুত ঘটেছে যে, বয়জ্যেষ্ঠ্যরা বুঝে উঠতে পারেননি। নতুন প্রজন্ম এখন এক বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। জীবন বলতে তাদের সামনে এখন ‘খাও দাও ফুর্তি করো’-এর অফুরন্ত ভোগের সমাহার। এখানে পারিবারিক বন্ধন, সম্পর্ক এখন ঢিলেঢালা। স্বামী-স্ত্রী একে-অপরের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা ভালোবাসা দায়িত্বানুভূতি কেতাবি বাক্য; এই হলো নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগের ধারণা। প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক, সামাজিকতা, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া এবং পারস্পরিক কুশলাদি বিনিময় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। একই পরিবারের সদস্যরা নিজ নিজ ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী। এমনকি খাবারের টেবিলেও তাদের দেখা মেলে না। কম-বেশি সবাই ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- তাদের রয়েছে হাজার হাজার অনলাইন বন্ধু। প্রয়োজনে কেউ পাশে থাকে না। তবুও এসব ভার্চুয়াল বন্ধুকে নিয়ে তরুণ প্রজন্মের জীবন। পৃথিবীবিমুখ, জীবনবিমুখ, বিশ্বাসের সঙ্কট স্রোতে তাদের অগস্ত্যযাত্রা। অনলাইন ব্যবস্থাপনা তাদের মায়ের, বোনের, স্ত্রীর হাতের মমতাভরা রান্নার স্বাদ হারিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। মায়ের হাতের রান্না করা তরকারির ঝোলের অপূর্ব স্বাদ এবং সুবাসের কথা এখন আর কেউ বলে না। আদুরে গলায় মায়ের কাছে পোড়া বেগুন ভর্তা, আলুভর্তা বা টাকি মাছের ভর্তার আবদার এখন আর কেউ করে না। মায়ের জায়গা এখন বাহারি নামের তৈরি খাবারের প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করেছে।
তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও গ্রামে গ্রামে উপজেলা এবং জেলা শহরে ভোরের আজানের সাথে সাথে প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকে ভেসে আসত কুরআন পাঠের সুমধুর আওয়াজ। এখন ভোরে শোনা যায় গান শেখার কসরত। গলা সাধার শব্দ। স্বাভাবিকভাবে এসব শিশুর কাছে কুরআন একটি বইয়ের নাম মাত্র। অনেকে কষ্ট করে কোনোভাবে নামাজ শেখাতে কয়েকটি সূরা শিখিয়ে দায়িত্ব শেষ করছেন। বিয়েশাদি, আকিকা, জানাজা ও মুনাজাতে এখন সবকিছু ইমাম সাহেবের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত। ঘরে ঘরে ডিশের বদৌলতে দেশী-বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেলের রমরমা অনুষ্ঠান বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আঙ্গিক আমাদের আভিজাত্যকে মর্যাদাশীল করে তোলে। ইন্টারনেটের সুবাদে সোস্যাল মিডিয়া আর ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুখ গুঁজে কাটে রাতের বড় অংশ। ভোরের ঘুম সকাল ৯টায় ভাঙা এখন যাপিত জীবনের অংশ। প্রাতঃকালীন নাশতা এখন কর্মস্থলে। স্ত্রী-পুত্র পরিবার নিয়ে সকালের নাশতার টেবিলে ঘরে তৈরি রকমারি খাবারের সমাহার এখন কেউ ভাবেন না, ভাবতে চান না। প্রয়োজনে রাস্তার পাশের দোকান থেকে কেনা খাবারে সকালে নাশতার পাট চুকানো এখন জীবনাচার।
সামাজিক অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, অপরাধের মাত্রা অপ্রতিহত গতিতে বাড়ছে। শিশুদের খেলার মাঠ হারিয়ে যাওয়ায় কিশোর গ্যাং কালচার গ্রাস করছে তাদের। সমাজজীবন যাদের ভয়ে তটস্থ। এরা ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়বে! অথচ এরকম হওয়ার কথা ছিল না। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো মুসলিম জনপদে। একসময় এ জনপদে ফজরের নামাজের পরপর দেখা যেত শিশুরা সবাই মক্তবমুখী। সেখানে কুরআন শেখার সুললিত কণ্ঠস্বরে পরিবেশ উচ্চকিত। বিয়ের সামাজিকতায় ছেলে-মেয়ের উভয়ে কুরআন জানা ছিল আবশ্যিক। এখন তার জায়গা নিয়েছে গান গাইতে পারে কি না। বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত। প্রখ্যাত শিল্পীরা (?) রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চাকে ইবাদতের সাথে তুলনা করে উসকে দিচ্ছেন সামাজিক নৈতিক বিপর্যয়। তাদের সম্মানিত করা হচ্ছে সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।
মুসলিম বাবা-মা তাদের শিশুসন্তানকে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ত করে সামাজিক সাংস্কৃতিক সফলতার গৌরবগাথা তৈরি করছেন। এ প্রতিযোগিতার ভেতর কুরআন পঠন-পাঠনের জায়গা কোথায়? কুরআন শেখার এবং এর কথা বলতে অভিভাবকরা সঙ্কোচ বোধ করেন সাম্প্রদায়িক তকমার ভয়ে। কুরআন এখন শুধু আকিকা জানাজা বিয়ের আসরে প্রয়োজন হয়। বেশির ভাগ মানুষ তাদের জীবনাচারে কুরআনের শিক্ষাকে উপক্ষো করছেন। কুরআনকে এখন সামাজিকভাবে বিশেষ ব্যক্তিদের পরিসরে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আকিকা, বিয়ে এবং জানাজার নামাজে দোয়া করবেন। মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ ‘সিজদা করো ও আমার নিকটবর্তী হও।’ (৯৬ : ১৯) আমাদের ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। পরিবর্তে শঠতা, মিথ্যাচার, আমানতের খেয়ানতকে ব্যাপকভাবে সমাজে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সুচতুরভাবে শিক্ষা এবং সামাজিক জীবনাচারের মাধ্যমে। স্বদেশ, স্বজাতি ও সামাজিক দায়বদ্ধতা এখন অজানা শব্দে পরিণত। সুবচন নির্বাসনে।
ছাত্র-জনতার বিপ্লব নতুন করে সুযোগ এনে দিয়েছে দেশের মুসলিম জনপদে নতুন চেতনার জোয়ার সৃষ্টির। এ চেতনায় নতুন করে নিজেকে, স্রষ্টাকে, সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে জানার ও চেনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের প্রতিটি মুসলিম জনপদে কুরআন শেখানোর ও শেখার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। ইসলামের মৌলিক নীতিমালা শিক্ষাব্যবস্থায় সংযোজন এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নতুন অভিধায় নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে। নিজের পরিচয়কে কুরআনের আলোকে সাজিয়ে সমাজ ও জাতীয় জীবনকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আলোময় পথে পরিচালিত করতে পারে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে, স্বজাতি চেতনার আলোকে দেশ ও জাতির উজ্জ্বল ভাবমর্যাদা তৈরিতে অবদান রাখতে পারে।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
ই-মেল : shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement