নির্বাচন কত দূর
- আলম রায়হান
- ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
টিভি টকশোতে খুব পরিচিত মুখ জনৈক রাজনৈতিক বিশ্লেষককে আমজনতার একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘সরকার কতদিন থাকবে?’ ছাত্ররাজনীতি থেকে বেড়ে ওঠা সাবেক সচিব ওই বিশ্লেষক তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কতদিন থাকা উচিত? উত্তরে উল্লিখিত আমজনতার প্রতিনিধি খুব দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘যতদিন দেশ সোজা না হয়!’ জনধারণার চলমান এই অবস্থায় ৫ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল তৃতীয় দফা সংলাপ করেছে। দলগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত। এ সংলাপে নির্বাচনের পথরেখা চেয়েছে বিএনপি। আর জামায়াত নির্বাচন চাইলেও বলেছে, ‘নির্বাচন থেকে সংস্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
বলা বাহুল্য, নির্বাচন যত দ্রুত হবে তত দ্রুত বিদায় নেবে বর্তমান সরকার। আর নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারকে গুরুত্ব দিলে সরকারের মেয়াদ বিএনপির ধারণার চেয়ে দীর্ঘতর হতে পারে। বোঝা যাচ্ছে, রাজনীতির গতিধারার বর্তমান-ভবিষ্যৎ। সরকারের মেয়াদ প্রধানত দুই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত। প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের মেয়াদের বিষয়টি দেশের মানুষ কীভাবে দেখছে?
সাধারণ মানুষ এখন যত না নির্বাচন চায় তার চেয়ে অনেক বেশি চায় ‘দেশ সোজা হওয়া!’ এই ‘সোজা হওয়া’ মানে হচ্ছে সর্বত্র জেঁকে বসা অরাজকতা ঝেঁটিয়ে বিদায় করা! যাকে ‘দেশ সংস্কার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা। আসলে তারা আমজনতার প্রত্যাশাকে ধারণ করেছেন বলে ধারণা করা হয়। অবশ্য এ জনআকাক্সক্ষার বিপরীতে রাজনীতিকদের একটি অংশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী দুঃশাসনের অবসানে রাজনীতিতে সরব থাকার সুযোগ পেয়েছে অংশটি। হয়তো তাদের অন্তর্নিহিত আকাক্সক্ষা, ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতির বিষয়টি জনচেতনায় গরম গরম থাকতে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার যাওয়া।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আগামীতে চলমান সরকারের অধিকতর শক্ত দাঁত দৃশ্যমান হতে পারে। এখন যে সরকারের অনেকটা কাছিম প্রবণতায় মানুষ বিরক্ত হতে শুরু করেছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা চলে, আচার-আচরণে খুব শান্ত ও ধীরস্থির হলেও কচ্ছপের বাইট পাওয়ার খুব শক্তিশালী। প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে সরকারের চলমান প্রবণতা অনুধাবন করতে সনাতনী ধারার সরব রাজনীতিকরা কতটা বুঝতে পেরেছেন সেটি কিন্তু এক ধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এটি খুব পরিষ্কার, সরকারের মেয়াদ নিয়ে প্রধানত দু’টি ধারণা আছে। আমজনতা যা ভাবছেন তার বিপরীত ভাবনায় বিএনপি, বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে। বিএনপির ভাবনার সাথে সম্পূর্ণ একমত নয় জামায়াত। জামায়াতের কাছে প্রধান হচ্ছে সংস্কার ও রাজনীতি এবং বিএনপির বিবেচনায় মূল হচ্ছে নির্বাচন! নির্বাচনী রাজনীতিতে জামায়াত-বিএনপির অবস্থা এখন অনেকটা খাঁচার পাখি আর বনের পাখির মতো।
অনেকে বলছেন, হতাশার গভীর থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা টেনে তুলে সঠিক সড়কে স্থাপন করার স্বর্ণদ্বার খুলেছে ৫ আগস্ট। নানা ক্ষত ও অব্যবস্থাপনায় দেশ যখন ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দোরগোড়ায় তখন কোথাও দিয়ে যেন আবাবিল পাখির মতো ছাত্র-জনতার আগমন ঘটল। অবশ্য হেমিলনের বাঁশিওয়ালার আবির্ভাবের কথা বলছেন কেউ। শুধু তাই নয়, প্রায় ১৬ বছরের লাগাতারভাবে ক্ষমতাসীন দানবীয় সরকার অপসারণের অকল্পনীয় ঘটনার পর অন্তত তিন দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। তবু রাষ্ট্রব্যবস্থা তছনছ হয়ে যায়নি। এ ছিল দেশবাসীর অভূতপূর্ব ঐক্যের ফল। এর সাথে আরো অনেক বাস্তবতা গভীরভাবে জড়িত। ফলে বর্তমান সরকারের মেয়াদ নিয়ে আলোচনা মানে ‘আসার আগে যাওয়ার আলোচনা’। আর এ আলোচনা বিএনপির তরফ থেকে বেশ জোরালো। আগে কিছুটা রাখঢাক করে বলেছে বিএনপি। এই সেদিনও রাষ্ট্র সংস্কার এবং নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দেয়ার কথা বলেছে। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ-ও বলেছেন যে, ‘কয়েকজন ব্যক্তি রাষ্ট্র সংস্কার করে দেবেন, এটি আমি বিশ্বাস করি না। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এ সংস্কার করতে হবে।’
কিন্তু নির্বাচন যে শেষ কথা নয়, তা বাংলাদেশে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এ ধারা থেকে উত্তরণে নিশ্চয় সময় লাগবে। সম্ভবত এ বাস্তবতা ধারণ করে ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘কখন নির্বাচন হবে সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশের সঙ্কটকালে ছাত্রদের আহ্বানে আমরা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা ক্রমাগতভাবে সবাইকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাব যাতে হঠাৎ করে এ প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়, আমরা কখন যাব। তারা যখন বলবে আমরা চলে যাব।’
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তার সরকারের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। সাথে বেশ কিছু সূক্ষ্ম শব্দ প্রয়োগে নিরেট বাস্তবতা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে।’ আসলে প্রধান উপদেষ্টা রাজনীতির জটিল প্রসঙ্গ সহজভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন মাত্র।
অতীতের চেয়ে কঠিনতম এবং জটিল পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার দেশের দায়িত্ব নিয়েছে। যে জটিলতার শিকড় অনেক গভীরে। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টি ১৯৯০ সালের মতো রাজনৈতিক সমঝোতায় হয়নি। এটি হচ্ছে কোটি শিশু-কিশোর-যুবক-ছাত্র-জনতার তীব্র চাপপ্রয়োগ এবং হাজারও জীবন দানের মধ্য দিয়ে। এর প্রভাবে আওয়ামী সরকারের কেবল পতন হয়নি, শেখ হাসিনার মতো একরোখা প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা ছেড়ে হেলিকপ্টারে উড়ে পালাতে হয়েছে। তবে এটিই বাস্তবতা- বিএনপি ও সমমনারা হাসিনা সরকারকে বিদায় করতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছে। ঘাম ঝরিয়েছে, জীবন দিয়েছে। কিন্তু এর উত্তাপে মসনদ পোড়ানো দূরের কথা, আঁচও লাগেনি।
৫ আগস্টের অকল্পনীয় পটপরিবর্তনের রাজনৈতিক বেনিফিসিয়ারি হিসেবে জামায়াতের পর বিএনপির অবস্থান। যাকে নেতা-কর্মীরা চিহ্নিত করছেন ‘সুসময়’ হিসেবে। মামলা নেই, হামলা নেই, কর্মসূচিতে বাধা নেই, গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি তো নেই! ফলে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নতুন উদ্যমে রাজনীতির মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছে। কেবল দৌড়ের উপর আছে আওয়ামী লীগ এবং তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা। অবশ্য, এ মিত্রদের অনেকে এর আগে রাজনীতিতে দেউলিয়া হয়ে গেছেন। অনেকে আওয়ামী লীগের সাথে থেকে রাজনৈতিকভাবে বিনাশও হয়ে গেছেন। যেমনটি হয় শিয়ালের সাথে মুরগির প্রেমের পরিণতি। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে চাপাবাজি করার খেসারত হিসেবে সাবেক এক বিচারপতির চরম জিল্লতিও হয়েছে। বিতর্কিত সাবেক এ বিচারপতির এই পরিণতির নেপথ্যে রয়েছে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। মনে করা হয়, ধরা পড়ার আগে এই বিচারপতি সদ্য ভারত ফেরত। মানে তাকে ভারত থেকে পুশব্যাক করা হয়েছে। এরপর জঙ্গলে লুকিয়ে কলাপাতায় শুয়েছিলেন তিনি। এ দৃশ্য দেখে কেউ হয়তো সিনেমার অথবা কবিতার নাম ভেবেছেন- ‘কলাপাতায় বিচারপতি!’
সব শেষে বলতে চাই, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণটি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে তার সেই উচ্চারণ- ‘সংস্কারের মাধ্যমে নতুন যাত্রা শুরু করতে চাই।’ এ বক্তব্য বিবেচনায় নেয়ার পাশাপাশি প্রয়োজন, বাতাসে কান পেতে মানুষের কথা শোনা।
লেখক : সাংবাদিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা