২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সাংবিধানিক রাজনীতি ও জামায়াতে ইসলামী

-

(প্রথম কিস্তি)

১৮৮৫ সালে ভারতীয় কংগ্রেস গঠিত হয় এবং দলটি ব্রিটিশ সরকারের সাথে রাজনৈতিক দেনদরবার করে ভারতীয়দের নানাবিধ দাবি-দাওয়া আদায়ের কাজে নিয়োজিত ছিল। এ সময় বিশিষ্ট আইনজীবীদের অনেকে এ দলে যোগ দেন। তাদের মধ্যে কিছু মুসলিম নেতাও ছিলেন।
১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হয় এবং তারাও ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিবিধ সমস্যা সমাধানে ঔপনিবেশিক সরকারের সাহায্য লাভের চেষ্টা করছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন বোম্বের বিশিষ্ট আইনজীবী। তিনি প্রথমে কংগ্রেসে যোগদান করলেও কয়েক বছরের ব্যবধানে উপলব্ধি করেন, যদিও কংগ্রেস ভারতের সব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব এবং সবার স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করার কথা বলছে; কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে হিন্দুদের প্রতি পক্ষপাতমূলক নীতি অনুসরণ করছে। তিনি একপর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম উভয়ের স্বার্থকে একটি ঐক্যের ফর্মুলায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। এ জন্য তাকে ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ বলা হতো। কিন্তু তিনি তার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হন। একই সাথে স্বার্থ আদায়ে মুসলমানদের পৃথক সংগঠন যুক্তিযুক্ত বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করেন তিনি। মুসলমানদের স্বার্থে সংগ্রাম করতে গিয়ে যুক্তি উদ্ভাবন করেন, হিন্দু ও মুসলিম দু’টি পৃথক জাতি। সুতরাং তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনে তারা আলাদাভাবে লড়াই করবে। তার এ তত্ত্ব ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। কংগ্রেস তার এই নীতিতে ক্ষুব্ধ হয়। যুক্তি উপস্থাপন করে, ভারতীয়রা এক জাতি। মুসলিম নেতাদের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি অংশ কংগ্রেসের যুক্তির সাথে একমত পোষণ করে। এর মধ্যে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ অন্যতম। এ সময় ভারতের দেওবন্দভিত্তিক আলেমদের বড় ও প্রধান অংশ মুসলমানদের স্বার্থের কথা আলাদাভাবে না বলে কংগ্রেসের ‘অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তা’কে সমর্থন করে। মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানির নেতৃত্বে কংগ্রেসপন্থী দেওবন্দি আলেমরা জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ বিরোধিতা করতে উঠে পড়ে লেগে যান। তারা ১৯২০ সালে ‘জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ’ নামে একটি দল গঠন করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী আদর্শ, মুসলিম কৃষ্টি, পবিত্র স্থানগুলোর মর্যাদা সংরক্ষণ, ইসলামী শিক্ষার অধিকার অর্জন, ইসলামী শিক্ষার আলোকে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন, ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুনরুদ্ধার ইত্যাদি। (আবুল আসাদ, এক শ’ বছরের রাজনীতি)
তরুণ সাংবাদিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী কংগ্রেসপন্থী মাওলানা ওবায়দুল্লøাহ সিন্ধী ও মাওলানা আবুল কালাম আযাদের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি ‘মাসায়ালায়ে কওমিয়াত’ নামে একটি গ্রন্থ লিখে প্রমাণ করেন, হিন্দু-মুসলিম দু’টি স্বতন্ত্র জাতি। বইটি মুসলিম লীগের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মিলে যাওয়ায় তার লাখ লাখ কপি পুরো ভারতে বিতরণ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় আবাসভূমির প্রয়োজনীয়তার দৃষ্টিকোণ থেকে জিন্নাহ ও মাওলানা মওদূদী একই অবস্থানে ছিলেন। (আবুল আসাদ) মওদূদীর এ অবস্থানে কংগ্রেস নেতা জওয়াহেরলাল নেহরু তাকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ এবং ‘সাম্র্রাজ্যবাদী’ বলে কটাক্ষ করেন। জবাবে মওদূদী বলেন, ‘আমরা নিজেদের কবর খননে তাদের হাত শক্তিশালী করতে অস্বীকার করছি। প্রকৃতপক্ষে, ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ এবং ‘সাম্রাজ্যবাদী’ তারা নিজেরা, তারা নিজেরা স্বাধীনতা অর্জনের এবং সাম্র্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এমন পন্থা অবলম্বন করছেন যা ভারতের এক-চতুর্থাংশ অধিবাসী কিছুতে মেনে নিতে পারে না।’ (আব্বাস আলী খান, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী: একটি জীবন একটি ইতিহাস)
১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের এক সম্মেলনে ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ ঘটনায় কংগ্রেসী আলেমরা ভারতকে খণ্ড-বিখণ্ড করার পরিকল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করলে মওদূদী তার রচিত ‘মুসলমান আওর মওজুদা কি সিয়াসি কাশমাকাশ’ গ্রন্থে বলেন, ‘মুসলমান হিসেবে আমার কাছে এ প্রশ্নের কোনো গুরুত্ব নেই যে, ভারত অখণ্ড থাকবে, নাকি ১০ খণ্ডে বিভক্ত হবে। সমস্ত পৃথিবী এক দেশ। মানুষ তাকে সহস্র খণ্ডে বিভক্ত করেছে। আজ পর্যন্ত পৃথিবী যত খণ্ডে বিভক্ত হয়েছে, তা যদি ন্যায়সঙ্গত হয়ে থাকে, তাহলে আরো কিছু খণ্ডে বিভক্ত হলে ক্ষতি কী? এটি খণ্ড-বিখণ্ড হলে মনোকষ্ট তাদের যারা একে দেবতা মনে করে। আমি যদি এক বর্গমাইলও এমন জায়গা পাই যেখানে মানুষের ওপর খোদা ছাড়া অন্য কারো প্রভুত্ব কর্তৃত্ব থাকবে না, তাহলে এ সামান্য ভূমিখণ্ডকে আমি পুরো ভারত অপেক্ষা অধিকতর মূল্যবান মনে করব।’
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর উদ্যোগে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগ অধিবেশনে বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ১৭ মাস দুদিন পর এ নতুন সংগঠনটির জন্ম। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, মুসলিম লীগ যখন মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, ঠিক সে সময়ে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী কেন মুসলমানদের জন্য আলাদা একটি নতুন দল গঠন করতে গেলেন? এ সম্পর্কে তিনি বলেন, মুসলিম লীগ শুধু মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে আন্দোলন করছে; অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন মুসলমানদের সামগ্রিক স্বার্থ নিয়ে, যার ভিত্তি হচ্ছে ইসলামী জীবনবোধ। মওদূদী তার সম্পাদনায় প্রকাশিত তৎকালীন মাসিক ‘তরজমানুল কোরআন’ পত্রিকায় নিজের নতুন দল গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে লিখেন : ‘দুনিয়াকে ভবিষ্যতের অন্ধকার যুগ থেকে রক্ষা করে তাকে ইসলামের নিয়ামত দ্বারা ভূষিত করতে এতটুকু যথেষ্ট নয় যে, এখানে ইসলামের সঠিক ধারণা ও মতবাদ বিদ্যমান আছে, বরঞ্চ সঠিক মতবাদের সাথে একটি সত্যনিষ্ঠ দলেরও প্রয়োজন। এ দলের সদস্যদের ঈমানের দিক দিয়ে সুদৃঢ় ও অবিচল হতে হবে এবং আমলের দিক থেকে হতে হবে প্রশংসনীয় ও উচ্চমানের। কারণ তাদের সভ্যতা সংস্কৃতির ভ্রান্ত অবস্থা ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ করতে হবে। এ পথে আর্থিক কোরবানি থেকে শুরু করে কারাদণ্ড এমনকি ফাঁসির ঝুঁকিও নিতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার এমন এক স্বাধীনতা প্রয়োজন যার সাহায্যে আমি পতনোন্মুুখ ইসলামী শক্তিকে সামলাতে পারি, জীবনের যাবতীয় সমস্যাবলি মুসলমান হিসেবে সমাধান করতে পারি এবং হিন্দুস্তানে মুসলিম জাতিকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে দেখতে পারি।’
মওদূদীর অভিমত পর্যালোচনা করলে তিনটি বিষয় লক্ষ করা যায় : ১. দেশের স্বাধীনতা অর্জন, যেখানে গঠিত হবে মুসলমানদের সরকার; ২. ওই স্বাধীনতা হবে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানদের জন্য পরিপূর্ণভাবে অর্থবহ এবং ৩. এ সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে আত্মনিবেদিত কর্মীবাহিনী তৈরি করা। তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রথমটি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্য দু’টি নিজস্ব। মওদূদীর এই চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, হাজী শরীয়তুল্লøাহ, মীর নিসার আলী তিতুমীর, শাহ ইসমাইল শহীদ প্রমুখের আন্দোলনের পুনর্জাগরণ ঘটে। আবুল আসাদের মতে, ‘মাওলানা মওদূদীর হাতে শাহ ওয়ালী উল্লাহর ইসলামী আন্দোলন আরো সুন্দর, সুশৃঙ্খল, সুচিন্তিত এবং মহানবী সা:-এর শিক্ষা ও আদর্শের আরো ঘনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে উঠল।’ (আবুল আসাদ)
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের পর থেকে মুসলিম লীগ ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একমাত্র স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য লড়াই করছিল। স্বাধীনতা অর্জিত হলে নতুন দেশটিতে ইসলাম কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে তার কোনো রূপরেখা তাদের কাছে ছিল না। কিন্তু মওদূদীর লক্ষ্য ছিল আরো সম্প্রসারিত। মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং গ্রুপ চিঠি লিখে তাকে মুসলিম লীগে যোগদানের আহ্বান জানালে তিনি বিনয়ের সাথে জানান, যদি আমাদের লক্ষ্য হয় ইসলামের প্রতিষ্ঠা, তাহলে সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমাদের জাতিকে নৈতিক দিক দিয়ে তৈরি করতে হবে। এর জন্য মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তাধারা, নৈতিকতা, তাহজিব তমদ্দুন, রাজনীতি, অর্থনীতি সার্বিক বিষয়ে কাজ করতে হবে। এ লক্ষ্য নিয়ে তিনি তার নতুন দল গঠন করেছেন। তিনি মুসলিম লীগে যোগ না দেয়ায় এবং মুসলমানদের প্রকৃত স্বাধীনতার যে কথা তুলে ধরেন সে জন্য তাকে কোনো কোনো মহল কংগ্রেসের মতো তাকেও পাকিস্তানের স্বাধীনতাবিরোধী বলে অপপ্রচার চালাত।
পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন ও নেতৃত্বের কাছে আলাদা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড ছিল মুখ্য বিষয় : ইসলাম ছিল অনেকটা গৌণ। এ কারণে দেখা যায়, মুসলিম লীগ ইসলাম কায়েমে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারেনি। মুসলিম লীগ নেতৃত্ব ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবাদর্শে প্রভাবিত। ফলে পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও আধুনিকতার ধারণা তাদের মনে মগজে বাসা বেঁধেছিল। তাদের কর্মকাণ্ডে তার প্রতিফলন ঘটবে, এটি স্বাভাবিক ছিল। শুধু পাকিস্তান সৃষ্টি নয়- সেটি যাতে ইসলামী রাষ্ট্র হতে পারে এ ব্যাপারে যিনি পূর্বাহ্নে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন তিনি হচ্ছেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। তিনি দ্বিজাতি তত্ত্ব ও পাকিস্তানের সমর্থন করলেও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। তার মতে, মুসলমান শুধু সাধারণ একটি জাতি নয়; বরং একটি বিপ্লবী ও মিশনারি দল যারা বিশ্বব্যাপী ইসলামী আদর্শ প্রচার করার দায়িত্বে নিয়োজিত। তিনি মনে করতেন, মুসলিম লীগ যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে তা নিছক মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হতে পারে, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র হতে পারে না। এ জন্য তিনি মুসলিম লীগের সাথে একাত্ম হতে পারেননি। তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আলাদা একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। জামায়াত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ইসলামী চরিত্র, জ্ঞান ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোক তৈরির কর্মসূচি হাতে নেয়। স্বল্প কিছু লোক নিয়ে গঠিত এ জামায়াত উপমহাদেশের ইতিহাসে ইসলামী আন্দোলন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
([email protected])


আরো সংবাদ



premium cement