আ’লীগ, জাতীয় পার্টি : ইহাদের জাত ভিন্ন
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
আজকের লেখার শিরোনাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘হৈমন্তী’র নায়ক অপুর উক্তি থেকে ধার নেয়া। অপুর শ্বশুর গৌরী শঙ্কর বাবু অপুদের বাড়িতে মেয়েকে দেখতে এসে বিদায় বেলায় অপুর হাতে এমনভাবে একখানা ১০০ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করলেন যেন ঘুষ দিচ্ছেন, অপুর প্রণাম নেয়ার জন্য সবুর করলেন না। পেছন হতে অপু দেখতে পেল, পকেট হতে রুমাল বের হলো। অপু স্তব্ধ হয়ে বসে ভাবতে লাগল। সে বুঝল, ইহারা অন্য জাতের মানুষ।
হৈমন্তীর নায়ক অপু যেমন তার শ্বশুরের মধ্যে স্নেহাস্পদ পিতার সভ্য আচরণ দর্শনে বুঝে নিলো তারা অন্য জাতের মানুষ, তেমনি বাংলাদেশের মানুষও ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা পতনের আগের ১৫টি বছর ধরে ভোটচোর, ভোটডাকাত, নিশি রাতের সরকার, ডামি সরকার, গৃহপালিত বিরোধী দল, জাতীয় বেঈমান, জাতীয় মুনাফেক ইত্যাদি বিশ্লেষণযুক্ত শব্দমালা ব্যবহার করে সরকারি দল এবং সংসদের বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গালিগালাজ করলেও তাদের মধ্যে এতটুকু লাজলজ্জার উদ্রেক না দেখে, বুঝতে পেরেছিল, তাহাদের জান ভিন্ন, ‘তাহারা অন্য জাতের মানুষ’।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গর্ব করেই বলেছিলেন, ‘যে যতই গালি দিক গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের এখন বিরোধীদলীয় নেতা’ (মানবজমিন, ফেব্রুয়ারি-২০২৪)। জনগণের গালিগালাজে যাদের মধ্যে শরম লজ্জার বালাই সৃষ্টি করতে পারেনি, তারা কোন জাতের মানুষ তা নির্ণয় করতে হলে মনে হয় রীতিমতো সমাজতাত্ত্বিক বনে যেতে হবে। তবে মুজিবুল হক চুন্নুর কথার মর্মার্থ এমনই ছিল যে, বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার আনন্দ আহ্লাদে জনগণের গালিগালাজ তাদের শরীরের মেদভর্তি পুরো চামড়া ভেদ করে রক্ত-মাংস পর্যন্ত পৌঁছে অনুভূতিতন্ত্রে স্পর্শ করে লাজলজ্জার সৃষ্টি করতে পারেনি। তাদের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। ভোটের প্রয়োজন নেই। জনগণের সম্মতির প্রয়োজন নেই। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা মুখস্থ করে লাভ নেই। সংবিধানের ধারা অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করার দরকার নেই। প্রয়োজন ক্ষমতা। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের ভাগিদার হওয়া। তাদের মতে, যারা রাজপথে দাঁড়িয়ে জনগণের কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে, ভোটাধিকারের কথা বলে, সংবিধানের কথা বলে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে কথা বলে তারা গণ্ডমূর্খ, অরাজনৈতিক। এটি ঠিক যে এদের জ্ঞানগরিমা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মতো অতটা উগ্র ও বেহায়া গোছের নয়।
হাসিনা ও তার দোসররা আকারে-ইঙ্গিতে, ইশারা-ব্যবহারে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, জর্জ অরওয়েল রচিত ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে উল্লিখিত ‘ওসেনিয়া’ রাষ্ট্রের জনগণের মতোই হাসিনার দেশে জনগণের কোনো অধিকার থাকতে পারে না। কোনো বাকস্বাধীনতা থাকতে পারে না। ভুলেভালে জনগণ কোনো কথা বলে ফেললে সেই কথায় হাসিনা সরকার মাইন্ডে নিলে তার দশা কী হয়েছিল তা দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। হাসিনার কাছে রাজনীতির আদশ বলে কোনো কিছু ছিল না। প্রতিশোধ, প্রতিহিংসাই তার রাজনীতির মূল দর্শন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে গত ১৫ বছরে আদর্শিক রাজনীতির পরিবর্তে হ্যাডমের রাজনীতি বড় হয়ে উঠেছিল। যেমন বিএনপির সাবেক নেতা শাহজাহান ওমর বিএনপির সাথে ৪০ বছর সংসার করে, এমপি-মন্ত্রী হয়েও নাকি হ্যাডম দেখাতে পারেননি। হ্যাডম দেখিয়েছেন ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও পুলিশের ওপর হামলা এবং পুলিশ সদস্য হত্যা ও অগ্নিসংযোগের নির্দেশদাতা হিসেবে দায়ের করা মামলায় জামিনে জেল থেকে বের হয়ে, রাতারাতি আওয়ামী লীগে যোগদান করে এমপি নমিনেশন বাগিয়ে। বিএনপি তার কাছে হয়ে পড়েছিল বিষবৃক্ষ। অথচ কিছুকাল আগেই বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে হাসিনার বিরূপ মন্তব্যের জবাব কত শক্তভাবেই দিয়েছিলেন। একটি দলের সাথে ৪০ বছর সংসার করলেন সমস্যা হলো না, মাত্র কয়েক দিন জেলে থেকেই বুঝে ফেললেন বিএনপির রাজনীতি করে তিনি কত ভুলই না করে ফেলেছেন। হাসিনার পতনের সাথে সাথে সেই নেতাকর্মীদের হ্যাডমেরও সমাপ্তি হয়েছে। কোন গর্তে লুকিয়েছে সেই হদিসও এখন কারো কাছে নেই।
এমন আদর্শহীন, বেঈমান, মুনাফেকরা হ্যাডম দেখাতে গিয়ে আজকে মহাবিপদে আছেন। তবে এই শ্রেণীর বেহায়া রাজনীতিকদের গায়ে কোনো প্রাণীর রক্ত বহমান তা ল্যাব টেস্ট ছাড়া বলা মুশকিল। জাতপাত নির্ণয় তারও পরে।
দেশের জনগণ জাতীয় বেঈমান, বিশ্ববেহায়া, বিশ্ববাটপাড়দের দেখেছে। যেমন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছিলেন, ‘আমরা জানি সরকার নিয়ন্ত্রিত ভোট হবে, তার পরও আমরা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবো। এর মাধ্যমে ভোটে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি জনগণের কাছে তুলে ধরব।’ হলুয়া রুটির ভাগিদার এই বাটপাড় শ্রেণীর নেতৃত্ব জাতির কপালে একের পর এক সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। জাতিকে অন্ধকারের চোরাগলিতে ঢুকিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে লবণ-মরিচ লাগিয়ে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে। এত কিছুর পরও তাদের খায়েশ মেটেনি। জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে একের পর এক তামাশা-মশকরা যেন তাদের কাছে আনন্দ আহ্লাদেরই অংশ হয়েছিল। সেই সময় জনগণকেও বাহাবা দিতে হয়েছিল তাদের হজম শক্তি ও ধৈর্যের মাত্রাবোধ দেখে।
জনগণের পক্ষে ধৈর্য না দেখিয়েই বা কী করার ছিল? কারণ রাজনীতিতে তখন আর রাজপথের খেলা ছিল না। অথচ একসময় মনে করা হতো, রাজপথের লড়াইয়ে যে দল জিতবে, ভোটেও সেই দলই জিতবে। বিগত ১৫ বছরে পুলিশের হ্যাডমের কাছে এই সত্য মিথ্যায় পরিণত হয়েছে। পুলিশ তার হ্যাডম শক্তি ব্যবহার করে রাজনীতিকে রাজপথ থেকে উধাও করে বন-জঙ্গল আর জেলখানার চার দেয়ালে আটকে দেয়ার মতো মহাকীর্তি করতে সক্ষম হয়েছে। রাষ্ট্রের জনগণের ঘাম ঝরানো টাকায় উদরপূর্তি করে গায়ে গতরে শক্তি জমিয়ে সেই শক্তি যদি জনগণের বিপক্ষে ব্যবহার করা না যায় তা হলে পুলিশ কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রে নিয়োজিত হোমরা-চোমরাদের জাত পরিচয়ই বা জনগণ কী করে জানবে। অনেকে আবার বলে থাকেন, পুলিশের কোনো জাত নেই। আমি এই মহাজ্ঞানী জনতার সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলতে চাই, অবশ্যই পুলিশের জাত আছে। তবে তাদের জাত ভিন্ন। তাদের অপকর্মের পরিণতিও তারা প্রত্যক্ষ করেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন নামক খেলায় এই দেশের জনগণ বিশ্ব মোড়লদের জাতের সাথেও পরিচিত হতে পেরেছে। মোড়লরা দুই ভাগে দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তারাও চিনিয়েছিল তারা কোন জাতের। ভারত তো একেবারে উলঙ্গ হয়েই আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়েছিল। জনগণের সমর্থন নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল, যেকোনো উপায়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চাওয়াই ছিল ভারতের মূল কথা। আমরা দেখেছি চীন, রাশিয়া, ভারত উন্মুক্তভাবেই একটি দলের জন্য সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কাজ করেছে। তখন কিন্তু আওয়ামী লীগ কারো জাত-পাত নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো যখনই গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছিল এবং সর্বদলের অংশগ্রহণে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দাবি করেছিল, তখনই আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা লালনের সেই বিখ্যাত গান- ‘জাত গেল জাত গেল বলে...’ চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছিল। ওদের হাবভাব ছিল এমনই যেন, ইউরোপ-আমেরিকা ম্লেচ্ছ। ওদের কথা শোনাও পাপ।
আলোচনার এই পর্যায়ে এসে বলতেই হয়, জাতের ধরন যেমনই হোক, অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চিরায়ত। জনতার বিপ্লব শুরু হলে তার ফল আসতে এক সপ্তাহ কিংবা ১০০ বছরও লেগে যেতে পারে। তবে ফল আসবে এটি নিশ্চিত। বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী হাসিনা শাসনের যবনিকাও ঘটিয়েছে এই দেশের জনতার বিপ্লব। ছাত্র-জনতার মহান বিপ্লবের কাছে পরাভূত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে কোনো মতে জীবন রক্ষা করেছেন, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনা। ক্ষমতার দাম্ভিকতা, হ্যাডমের বাহাদুরি, হালুয়া রুটির ভাগবাটোয়ারার অংশীজন কেউই তাদের রক্ষা করতে পারেনি। জনতার আদালতই তাদের অপকর্মের শাস্তি দিয়েছে। কিন্তু তাদের নির্লজ্জ বেহায়াপনার কাছে এই দেশের জনগণ জাত চেনার মন্ত্রও ভুলে গেছে। এখনো হুমকি দিচ্ছে, উনি চট করে ঢুকে পড়বেন।
লেখার শেষ পর্যায়ে এসে বলতে চাই, ফ্যাসিবাদের জননী হয়তো পালিয়ে বেঁচে গেছেন কিন্তু আমাদের এই ছোট্ট দেশের সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছেন। ধ্বংস করে দিয়েছেন অর্থনীতি, কূটনীতির সব অঙ্গ। ফ্যাসিবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে গোটা জাতিকে, একে অপরের শত্রু হিসেবে বিভক্ত করে ফেলেছে।
এই মহাসঙ্কট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো- সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐকমত্য ও বিচক্ষণতার সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তবে খুব বেশি মনে রাখা প্রয়োজন, ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসরদের সামাজিকভাবে বয়কট করা ও তাদের অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করাও হবে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রথম ভিত্তি।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা