০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

বিভেদ বৈষম্য নয় : মানুষ মানুষের জন্য

-

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষকে বুদ্ধি ও আত্মোপলব্ধি ও জ্ঞান দেয়া হয়েছে- অন্যান্য জীবকে যা দেয়া হয়নি। পৃথিবীতে আল্লাহ তার প্রতিনিধি হিসেবে মানুষ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত যখন নেন তখন ফেরেশতারা আল্লাহকে জানায় তারাই তো তাঁর ইবাদত বন্দেগির জন্য যথেষ্ট আবার মানুষ সৃষ্টি করা কেন। আল্লাহ বলেন- ‘আমি যা জানি তা তোমরা জানো না’। তিনি মাটি থেকে প্রথম মানুষ হজরত আদম আ:কে সৃষ্টি করলেন এবং তাকে কিছু জিনিসের নাম শিক্ষা দিলেন। ফেরেশতাদের সামনে আদমকে ডেকে আল্লাহ তাঁর জ্ঞানের পরীক্ষা নিলেন। আদম আ: তার জ্ঞানের দ্বারা সব জিনিসের নাম বলতে পারলেন, যা ফেরেশতারা বলতে পারলেন না। আল্লাহ তখন ফেরেশতাদের আদমকে সিজদা করার নির্দেশ দিলেন। ইবলিশ ব্যতীত সবাই সেজদা করল অর্থাৎ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিলো। ইবলিশ বরং প্রতিজ্ঞা করল মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে খর্ব করার কাজে সে সদা নিয়োজিত থাকবে- তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। আল্লাহর একান্ত প্রত্যাশা থেকে গেল মানুষ বরাবরই তার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়ে যাবে এবং এই ষড়যন্ত্রে শয়তানের কাছে পরাভূত হবে না।
সেই থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার সংগ্রাম শুরু। মানুষ যখনই শয়তানের ষড়যন্ত্রে পা দিয়েছে অর্থাৎ শয়তানের অনুসরণে ব্রতী হয়েছে তখন সে বিপথগামী হয়েছে, নিজের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় খুইয়েছে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করার ফলে তার জন্য নির্ধারিত হয়েছে অশেষ শাস্তি ও যন্ত্রণাভোগ। মানুষ মানুষের জন্য, এ জন্য যে একা মানুষ শয়তানের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় সক্ষম না হলে একে অপরকে সহায়তা করবে। দুর্বল মানুষ সবল মানুষের সহায়তা পেয়েই নিজের দুর্বলতার ব্যর্থতাকে জয় করবে- এটিই প্রত্যাশা। জীবনের অথৈ নদী সমস্যার পাহাড় আর দৈবদুর্বিপাকের সব বাধা পেরুতে অন্যের সহায়তা ও সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজন। সবল দুর্বলের জন্য, শিক্ষিত অশিক্ষিতের জন্য, ধনী দরিদ্রের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে টেনে তুলবে এবং আল্লাহর সেই মহৎ ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন প্রতিফলন ঘটাবে।
সমগ্র মানুষ এক বৃহৎ সংসারের বাসিন্দা। সংসারে ছোট-বড় সবাই থাকে। বড়রা ছোটকে স্নেহ করবে, ছোটরা সম্মান ও সমীহ করবে বড়দের। ভালো কাজে নির্দেশ আর অন্যায় কাজে নিষেধের নিয়মকানুন মেনে চলবে ছোট-বড় সবাই। একে অন্যের দুঃখে দৈন্যে সহমর্মিতা প্রকাশ করবে- এটিই পারিবারিক সুখ শান্তির পূর্বশর্ত। পারিবারিক সুখ শান্তির চিন্তাভাবনা যদি সমাজ দেশ ও বিশ্বব্যাপী ব্যাপৃত হয় তাহলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ এবং একে অপরকে শোষণ শাসন ও অবদমনের নামে যে অশুভ প্রয়াস প্রচেষ্টা চলে তার আর প্রয়োজন পড়ে না- তার অস্তিত্ব থাকে না। আমরা সবাই এক বিশ্ব পরিবারের সদস্য এই চিন্তাচেতনা সবার মধ্যে জাগ্রত থাকলে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, সন্ত্রাস-পাল্টা সন্ত্রাস, অবরোধ, অধিকার দাতা-গ্রহীতার স্বার্থ নিয়ে টানাটানি হানাহানি আর থাকে না। সব মানুষ এক অভিন্ন চিন্তাচেতনা নিয়ে অগ্রসর হলে যুদ্ধবিগ্রহে, আন্দোলন-সংগ্রামে এতটা সৃজনশীল সময়, মূল্যবান মানুষ ও সহায় সম্পদ ধ্বংসের প্রয়োজন পড়ে না।
মানুষই মানুষের বড় প্রতিপক্ষ। মানুষই সভ্যতা গড়ছে আবার সেই মানুষই নিজের বানানো মারণাস্ত্র দিয়ে তার গড়া সভ্যতা ধ্বংস করছে। একের বাড়াবাড়ির পরিণামে অন্যের সর্বনাশ হচ্ছে। এসবই যেন শয়তানের সেই চ্যালেঞ্জের সপক্ষে গড়ে তোলা দুর্ভাগ্যের দেয়াল মানুষ পৃথিবীতে হানাহানিতে কালাতিপাত করে আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির মহৎ উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে দিয়ে ফেরেশতাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিফলনই ঘটাচ্ছে যেন! অথচ মানুষ মানুষের জন্য সহমর্মিতাবোধের এই মূল্যবোধ যদি সবার মধ্যে কাজ করত তাহলে হানাহানি অনেকখানি উপশম হতো। অতি সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতারা যাদেরকে জনগণ বলেন, দুঃখ দৈন্য-দারিদ্র্য ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। এগুলো সৃষ্টি হয়েছে মানুষে মানুষের বিভেদ সৃষ্টির উদগ্র বাসনা থেকে। সহায় সম্পদ বণ্টন ও ব্যবহার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি বিচ্যুতি ও স্বার্থ বুদ্ধির ভেদাভেদের কারণে। মানুষ মানুষের জন্য এই মূল্যবোধের ব্যাপক বিকাশই মানব সভ্যতার শ্রীবৃদ্ধি ও নিরাপদ দেশ, সমাজ , অর্থনীতি বা বিশ্ব রচনার একমাত্র উপায়।
দুর্বল মানুষ যদি জীবনের অথৈ নদী পাড়ি দিতে সবল মানুষের সাহায্যপ্রার্থী হয় এবং সবল মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে তাকে যদি উদ্ধার করে তাতে তো তার কোনো ক্ষতি নেই; বরং দুর্বল মানুষ সবল মানুষের সহায়তায় ত্রাণ বা উদ্ধার পেয়ে সমাজে ঠাঁই পেয়ে সমাজ ও সংগঠনকে শক্তিশালী করার সুযোগ পাবে। সবারই কল্যাণ হবে। অর্থনীতি বলি আর সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি বলি, সবই উন্নত হয় অগ্রসরমান হয় সবারই সমন্বিত অংশগ্রহণে এবং প্রয়াস প্রচেষ্টায়।
এ ক্ষেত্রে ‘দশে মিলি করি কাজ হারি-জিতি নাহি লাজ’ কথাটি প্রণিধানযোগ্য, বারবার স্মরণীয়। সবাই মিলেমিশে কোনো কাজ করলে তাতে সফলতা আসবেই। যদি সে কাজ সফল না হয় তার জন্য কাউকে এককভাবে দুঃখিত কিংবা লজ্জিত হতে হয় না। সফলতা যেমন সবার, ব্যর্থতাও তেমন সবার। আমরা সবাই এই গল্পটা জানি- এক বৃদ্ধ তার মরণকালে তার ১০ ছেলেকে ডেকে প্রত্যেকের হাতে একটি করে লাঠি দিয়ে বললেন, এটি ভাঙো তো। প্রত্যেকে খুব সহজে এক একটি লাঠি ভেঙে ফেললে। এরপর বৃদ্ধ ১০টি লাঠি একত্রে করে আঁটি বেঁধে প্রত্যেককে বললেন, এবার এই আঁটি ভাঙো তো। কেউ সে আঁটি ভাঙতে পারল না। তখন বৃদ্ধ বললেন, বাবা সব! সবসময় তোমরা যদি এই আঁটিটির লাঠিগুলোর মতো একত্রে থাকো তাহলে কেউ তোমাদের ভাঙতে বা ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি তোমরা একেকজন আলাদা হয়ে যাও তাহলে তোমাদের অনৈক্যের সুযোগে অন্যেরা তোমাদের একেকজনের ক্ষতি সহজে করতে পারবে। সে জন্য কথায় বলে- একতাই বল। ইংরেজিতে একটি চমৎকার প্রবাদবাক্য আছে ‘United we stand, divided we fall’, একতার বলে আমরা দাঁড়াই, বিভক্তিতে ঘটে আমাদের পতন। এ কথা সব ক্ষেত্রে খাটে। যেকোনো কাজে, যেকোনো ক্ষেত্রে সম্মিলিত প্রয়াস প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো কঠিন কাজ হোক না কেন, সবাই মিলেমিশে বুদ্ধি খাটিয়ে শক্তি দিয়ে করলে তা সমাধা করা সহজতর হয়।
এই সমাজে বা সংসারে কেউ একা একা কিছু করতে পারে না। আমরা প্রত্যেকে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। আমার যা আছে আরেক জনের হয়তো তা নেই- আবার অন্যের যে শক্তি, দক্ষতা ও সামর্থ্য আছে আমার হয়তো সেটি পুরোপুরি নেই। তাই আমাদেরকে অবশ্যই সামর্থ্যরে ভাগাভাগি করতে হবে। দুই দুইয়ে যেমন চার হয় তেমনি আমাদের সবার সম্মিলিত শক্তি একেক জনের একক শক্তি ও সামর্থ্যরে চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।
দেশের যেকোনো বড় ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এখানে ঐক্যের ব্যাপারটি বেশ বড়। লাঠিগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় তা ভাঙা যেমন সহজ হয়েছিল, তেমনি দেশের বড় সমস্যা মোকাবেলায় দেশবাসী যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তা হলে তা মোকাবেলা করা সহজ হয়; বরং পরস্পরের মধ্যে অনৈক্য, একে অন্যের ওপর দোষারোপ ও নির্ভরশীলতায় সমস্যার সমাধান শুধু কঠিনই হয় না, সমস্যা আরো বাড়ে বৈকি। কেননা, অনৈক্যের মধ্যেই সে সমস্যা আরো বাড়ার সুযোগ পায়, সমস্যা সম্প্রসারিত হয়। বড় কিছু অর্জন করতে হলে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন, সবার বুদ্ধি পরামর্শ ও অংশগ্রহণ আবশ্যক। আর সবার সজাগ দৃষ্টিতে সব ভুল ও সমস্যা সহজে দূর করা সম্ভব হয়। ইতিহাসে বহু প্রমাণ আছে, কোনো দেশে যদি জনগণের মধ্যে একতার অভাব দেখা দেয়, তখন নিজেদের মধ্যে অনৈক্য ও ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে, একে অন্যের ওপর দোষারোপের প্রবণতা বাড়ে, তখন সে দেশে বাইরের শত্রুরা এসে সহজে নানান সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ ঘটিয়েই বড় বড় সংসারে ভাঙন সৃষ্টি হয় এবং সংসার ভাঙার সে সুযোগ গ্রহণ করে বাইরের কোনো ষড়যন্ত্রকারী।
ক্ষুদ্র প্রাণী পিপীলিকা, মৌমাছি এরা সবাই একতাবদ্ধ হয়ে সারিবদ্ধ হয়ে চলাচল করে, খাদ্য সংগ্রহ করে। কোনো খাদ্যের সন্ধান পেলে কাক তার স্বরে অন্য কাকগুলোকে ডাকে। আবার একটি কাক যদি বিপদগ্রস্ত হয় ডাকাডাকি করে সব কাক একত্রে সমস্বরে তার প্রতি সমবেদনা জানায়। এসবই একতাবদ্ধ থাকার প্রেরণা থেকে। বনের পশু পাখিরাও প্রতিকূল পরিবেশে একত্রে সহাবস্থান করে নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে।
মানুষ সংসারে নানান উপায় ও উপলক্ষে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকতে চায়। পরিবারে ভাইবোন পিতা-মাতা সবাই একত্রে, বিদ্যালয়ে সহপাঠীদের সাথে, মেসে বা হলে হলমেট বা কক্ষ সাথীর সাথে, চাকরিতে ব্যাচমেট, প্রবাসে জেলাবাসী ও এলাকাবাসী হিসেবে সমিতি করে। তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্যের ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেয়। উৎপাদনকারী ব্যবসায়ী শিল্প-কারখানার মালিক শ্রমিক সবাই সমিতি গঠনের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার ও উন্নয়নে সবাই সম্মিলিতভাবে সজাগ, সোচ্চার ও সক্রিয় হতে চায়। জাতিসঙ্ঘ সবল ও দুর্বল সব রাষ্ট্রেরই সঙ্ঘবদ্ধ সংস্থা। বিচ্ছিন্ন ইউরোপীয় দেশগুলো এখন ইউনিয়নভুক্ত হয়ে শক্তিশালী ইউরোপ গড়ার স্বপ্ন দেখছে।
একতাবদ্ধ হওয়ার জন্য প্রত্যেকের ঐকান্তিক ইচ্ছা এবং পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব থাকতে হবে। প্রত্যেকে আমরা পরের তরে এ উপলব্ধি সবার মধ্যে থাকা জরুরি। নিজের শক্তি সামর্থ্য ভাগাভাগিতে সহযোগিতার মনোভাব না থাকলে একতা গড়ে উঠবে না। সবার সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে তা সমাধানে সবাইকে ব্রতী হতে হয়। এ ক্ষেত্রে নিজের স্বার্থ হয়তো কিছুটা ছেড়ে দিতে হতে পারে। শুধু নিজের লাভের চিন্তা এখানে অত্যন্ত বেমানান। বড় কিছু অর্জন করতে হলে, বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ উৎসর্গ করতে হয়। সবার সম্মিলিত প্রয়াস প্রচেষ্টায় অনেক কঠিন কাজ সহজে করা সম্ভব। সুতরাং সে উদ্দেশ্য সাধনে নিজের আত্মত্যাগও জরুরি।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement