০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১,
`

বর্তমান শিক্ষকসমাজ

-

বাংলাদেশ ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর থেকে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করে আসছে। এ দিবসের লক্ষ্য হলো, শিক্ষকদের পক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ ও জনগণের সমর্থন আদায় করা। তা ছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আদর্শ আলোকিত মানুষরূপে গড়ে তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করা। শিক্ষকরাই পারেন উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আদর্শবান আলোকিত মানুষ তৈরি করতে।

বিশ্ব শিক্ষক দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ১৯৬৬ সালের বর্ষপূর্তিতে ইউনেস্কো এবং আইএলওর মধ্যে সমঝোতা স্বাক্ষরের কথা, যেখানে শিক্ষকের মর্যাদার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এতে জোর দেয়া হয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে শিক্ষকদের মেধার বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠন, মানসম্মত শিক্ষা এবং শিক্ষকদের সচ্ছল ও উন্নত জীবন যাপনের নিশ্চয়তার ওপর। শিক্ষকদের পেশাগত সমস্যার সমাধান, তাদের স্বার্থ আদায় এবং নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করে বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বিশ্বজুড়ে এমন একটি মানসম্মত শিক্ষা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে আদর্শবান আলোকিত মানুষ তৈরি হবে। যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ব্যতীত মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব নয়। অনেকগুলো উপাদানের মধ্যে শিক্ষক হচ্ছেন অন্যতম মাধ্যম যিনি ছাত্রদেরকে বিদ্যালয়ে থাকতে এবং শিক্ষা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন।

ছাত্রদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করতে, বহু উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য সঠিকভাবে সাজিয়ে নিতে, সহযোগিতার সাথে কাজ করতে, সমস্যা মোকাবেলা করতে এবং পছন্দের তথ্যগুলো পেতে সাহায্য করেন শিক্ষকরাই। ছাত্রদের যথাযথভাবে মেধার বিকাশ ঘটিয়ে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন শিক্ষকরা।

বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে এ পেশা তার মর্যাদা হারাচ্ছে।

বিশ্ব শিক্ষক দিবস হচ্ছে একটি সুযোগ যা সাহায্য করে ওই সব বিষয়গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য যেগুলো শিক্ষকরা জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে মোকাবেলা করেন এবং শিক্ষকরা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যে অগ্রগতি সাধন করেন তা মূল্যায়নেরও সুযোগ হয়। ২০২৪ সালের ৫ অক্টোবরের এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের স্লোগান, ‘শিক্ষকের কণ্ঠস্বর মূল্যবান : শিক্ষার জন্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তির দিকে।’

এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষকদের যে পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয় তা মোকাবেলা করার এবং শিক্ষায় তাদের ভূমিকা সম্পর্কে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। শিক্ষকদের হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে আনা এবং সব স্তরের শিক্ষকদের পেশাগত সমস্যার সমাধান করা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের নানান সমস্যা লক্ষ করা যাচ্ছে। সমস্যাগুলো সবাই মিলে দ্রুত সমাধান করতে না পারলে জাতি হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চরম মূল্য দিতে হবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও তাদের বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা কম, তাই সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। যেমন- গবেষণা সম্মানী বৃদ্ধি করা, চিকিৎসাভাতা অপ্রতুল, তা বৃদ্ধি করা, আবাসিক ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা, সরকারি খরচে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও মেধা বিকাশের জন্য উচ্চতর ডিগ্রি এবং দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যাতায়াত নিশ্চিতকরণে পরিবহন ব্যবস্থা করা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানজনক বেতনভাতা ইউজিসি কর্তৃক নির্ধারণ করা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্দিষ্ট জমি (সিটিতে এক একর অনত্র তিন একর) সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে বরাদ্দ দেয়া, শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি করা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শিক্ষকদের উচ্চ ডিগ্রি, বিদেশে প্রশিক্ষণ, নিয়মিত জার্নাল প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া, আন্তর্জাতিক মানের বৈদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান অর্জনের এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণের জন্য বেতনভাতাসহ উচ্চতর শিক্ষাকালীন ছুটি দিতে হবে।

এমপিও-বহির্ভূত মানসম্পন্ন মাদরাসাগুলোকে দ্রুত এমপিওভুক্ত করা, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বছরে দু’টি উৎসবভাতা মূল বেতনের শতভাগ করা। ব্যাপক সংখ্যক মাদরাসা শিক্ষকদেরকে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় আনা। এমপিওভুক্ত ও নন-এমপিও সব বেসরকারি মাদরাসাকে জাতীয়করণ করা। বর্তমানে খুব স্বল্প সংখ্যক মাদরাসাকে আরবি ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স-মাস্টার্স খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরো বেশি সংখ্যক মাদরাসাকে অনার্স-মাস্টার্স খোলার অনুমতি দেয়া। মাদরাসাগুলোতে অনার্স-মাস্টার্সের বিষয় সংখ্যাও বৃদ্ধি করা এবং মাদরাসা সরকারীকরণের আগ পর্যন্ত অনার্স ও মাস্টার্সের শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা। বর্তমানে আলিয়া নেছাবের মাদরাসাগুলোতে বিজ্ঞান বিভাগ চালু আছে। বোর্ড পরীক্ষায় এ বিভাগের ছাত্রদের ফলাফলও ভালো। এসব ছাত্র আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও বিজ্ঞান বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। তাই মানসম্পন্ন মাদরাসাগুলোতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স খোলার অনুমতি দেয়া। তাহলে উচ্চ শিক্ষায় ইসলামী মূল্যবোধের এক নয়া দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হবে।

কলেজের বেসরকারি শিক্ষকদের অনুপাত তুলে দিয়ে সহকারী অধ্যাপক পদ দিতে হবে। বেসরকারি কলেজে সহযোগী অধ্যাপকসহ অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা। প্রথম শ্রেণী থেকে সর্ব উচ্চতর শ্রেণী পর্যায় পর্যন্ত ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চিকিৎসাভাতা ও বাসা ভাড়া সরকারি কলেজ শিক্ষকদের সমপরিমাণ করা। শিক্ষকদের মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ করার আগ পর্যন্ত অনার্স কোর্সের শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা। কলেজ ম্যানেজিং কমিটির অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।

সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন স্কেলের বৈষম্য দূর করা। যেমন, সরকারি সহকারী শিক্ষকদের স্কেল সপ্তম গ্রেড, অথচ বেসরকারি সহকারী শিক্ষকদের হচ্ছে অষ্টম গ্রেড। সহকারী প্রধান শিক্ষক, সরকারি স্কেলের বেতন ষষ্ঠ গ্রেড, অথচ বেসরকারি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকের স্কেল হচ্ছে সপ্তম গ্রেড। এমপিওভুক্ত ও নন-এমপিও এবং বেসরকারি স্কুল শিক্ষকদের আবাসনের ব্যবস্থা করা। প্রথম শ্রেণী থেকে সব মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয়, নৈতিক ও জাতীয় মূল্যবোধসমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা।

৩০ হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার মধ্যে মাত্র চার হাজার মাদরাসা সরকারি সাহায্যের আওতায় আনা হয়েছে। বাকি মাদরাসাগুলোর দুর্দশা লাঘবের জন্য দ্রুত সরকারি সাহায্যের আওতাভুক্ত করা। অধিকাংশ ইবতেদায়ি মাদরাসার নিজস্ব জায়গায় ক্লাস ও অফিসের জন্য মানসম্মত ঘর নেই। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সরকারি ও ধনী ব্যক্তিদের আর্থিক সাহায্য করা।

শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি উদ্যোগে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা। ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলোর সিলেবাস ও কারিকুলামের অপূর্ণাঙ্গতা এবং সমন্বয়হীনতা দূর করার জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মতো অবসরভাতা/এককালীন অনুদান দিতে হবে। ফোরকানিয়া মাদরাসা ও মক্তবের জন্য সরকারি আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন। বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারি প্রাথমিক স্কুল, কারিগরি শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিগুলো সরকারের পক্ষ থেকে সমাধান হওয়া দরকার।

২০২৪ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের দাবি হলো, বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের শিক্ষকদের পেশাগত সমস্যার সমাধান করা। আমরা আশা করব, বিশ্বের সব দেশের শিক্ষকদের মান-মর্যাদা ধীরে ধীরে উন্নত হবে এবং বিশ্বে মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক চরিত্রের বিকাশ হবে। আর এর মাধ্যমে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ আলোকিত মানুষ তৈরি হবে। এটিই হোক ২০২৪ সালের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement