০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১,
`

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে প্রত্যাশা

-

শিক্ষক দিবস হলো শিক্ষকদের সম্মানে পালিত বিশেষ দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন দিনে দিবসটি পালন করে। ভারত ১৯৬২ সাল থেকে দেশের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বর, আর্জেন্টিনা ১১ সেপ্টেম্বর, ব্রুনাই ২৩ সেপ্টেম্বর ও ভুটান ২ মে শিক্ষক দিবস পালন করে। এ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় শতাধিক রাষ্ট্র ৫ অক্টোবর বিশ^ শিক্ষক দিবস পালন করে আসছে।
বিশ^ শিক্ষক সংঘ তথা বিশে^র বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের ক্রমাগত প্রচেষ্টায় ও ইউনেস্কো-আইএলওর সদিচ্ছায় ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকার সম্মেলনে শিক্ষকের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদা-বিষয়ক সনদ ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশ ১৯৬৬ প্রণীত হয়। সেজন্য ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে ৫ অক্টোবরকে বিশ^ শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বিশ^ শিক্ষক দিবসে প্রতি বছর আমাদের দেশের শিক্ষকরা সরকারের কাছে কিছু প্রত্যাশা করে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো- "Valuing Teachers Voices : Towards a new Social Contract for Education"। এর আভিধানিক অর্থ হলো, ‘শিক্ষকদের কণ্ঠের মূল্যায়ন : শিক্ষার জন্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তির দিকে।’ ব্যাখ্যায় বলা যায়, সবলের অত্যাচার থেকে দুর্বলদের রক্ষার জন্য সমাজের মানুষগুলো যখন কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তখন তা হলো সামাজিক চুক্তি। সামাজিক চুক্তি তৈরি হয় সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। এই চুক্তি দুর্বলদের রক্ষার হাতিয়ার। এবার বিশ^ শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, ইউনেস্কো অন্তত অনুধাবন করতে পেরেছে যে, শিক্ষক সমাজ দুর্বল। আমাদের দেশের শিক্ষকদের প্রধান সমস্যা অর্থনৈতিক। এই সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন সরকার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তা নিতান্তই কম। এর কারণ হয় সদিচ্ছার অভাব নতুবা সঙ্কীর্ণতা অথবা অজ্ঞতা। শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণের বিকল্প নেই। আমি মনে করি, শিক্ষা এবং শিক্ষকের উন্নয়ন একসাথে সম্ভব। শিক্ষক-কর্মচারীদের অর্থনৈতিক সমস্যাগ্রস্ত রেখে শিক্ষার যথাযথ উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার উন্নয়নের জন্য দরকার মানসম্মত শিক্ষানীতি, বলিষ্ঠ কারিকুলাম এবং শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন। বলিষ্ঠ শিক্ষাক্রমের জন্য চারটি Components রয়েছে। এগুলো হলো- ১. উদ্দেশ্যে; ২. বিষয়বস্তু; ৩. পদ্ধতি ও ৪. মূল্যায়ন।
একটি মহৎ উদ্দেশ্য অন্তরে ধারণ করে কোনো দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মতাত্ত্বিক দিক বিবেচনায় রেখে শিক্ষাক্রম রচিত হবে। তবে সংখ্যালঘু জনগণের ধর্মকে কটাক্ষ বা আঘাত না করে দেশের সার্বিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে শিক্ষাক্রম রচিত হবে।
বিষয়বস্তু হলো শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বাংলা, ইংরেজি, সামাজিক বিজ্ঞান প্রভৃতি বইয়ে যদি অমুসলিম কৃষ্টিকালচারসমৃদ্ধ বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করে তা শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নে বাধ্য করা হয় তাহলে সে দেশের কারিকুলাম সমৃদ্ধ হবে না। হবে দুর্বল এবং ভয়ঙ্কর। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ধর্মীয় শিক্ষা পুস্তকে বিভিন্ন ধর্মের নিজ নিজ বিষয়াদি লিপিবদ্ধ থাকবে।
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি হবে যুগোপযোগী। মূল্যায়ন সাধারণত দু’ভাগে হয়ে থাকে। একটি হলো গাঠনিক মূল্যায়ন, অপরটি সামষ্টিক মূল্যায়ন। গাঠনিক মূল্যায়ন সাধারণত শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা বা প্রশ্নের উত্তর লিখতে দেয়া অথবা বাড়ির কাজ দেয়ার মাধ্যমে করা হয়। আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হলো বছরের কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচির মাধ্যমে প্রশ্ন করে নির্দিষ্ট সময়ে উত্তরদানের ব্যবস্থা করে মেধা যাচাই করা। বছরে দুই বা তিনটি পরীক্ষার মাধ্যমে এই মূল্যায়ন করা হয়। সামষ্টিক মূল্যায়নই সর্বোৎকৃষ্ট মূল্যায়ন।
মূল্যায়নের জন্য দরকার প্রশ্ন পদ্ধতি। প্রশ্ন পদ্ধতির মধ্যে উৎকৃষ্ট হলো কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন পদ্ধতি। এর আবার দু’টি অংশ থাকে। একটি রচনামূলক অংশ; অন্যটি নৈর্ব্যক্তিক অংশ। রচনামূলক অংশকে আমরা সৃজনশীল প্রশ্ন বলি। এর চারটি অংশ থাকে যেমন- জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক, প্রয়োগমূলক ও উচ্চতর দক্ষতা। আর নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের তিনটি অংশ থাকে। যেমন- সাধারণ বহুনির্বাচনী, বহুপদী বহু নির্বাচনী ও অভিন্ন তথ্যভিত্তিক প্রশ্ন। এই ব্যবস্থায় কিছু পরিমার্জন ও সংশোধনের মাধ্যমে প্রশ্ন প্রণয়ন করে মেধা যাচাইয়ের উত্তম পন্থা বের করার অবকাশ আছে।
চাকরি জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারীদের অর্থনৈতিক উন্নতিসাধন করে শিক্ষার উন্নয়ন করতে হবে। জাতীয়করণ যেহেতু সময়সাপেক্ষ সেজন্যে জাতীয়করণের আগে আমরা শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়নের জন্য কিছু প্রস্তাব পেশ করতে চাই :
১. স্নাতক (পাস-অনার্স) থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষের বেতন কোড-০৪ ও উপাধ্যক্ষের বেতন কোড-০৫, সেসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষের বেতন কোড-০৩ ও উপাধ্যক্ষের বেতন কোড-০৪ এ উন্নীত করতে হবে।
২. থানাভিত্তিক এ ধরনের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট শিক্ষকের একটি নির্দিষ্ট হারে একই পর্যায়ের শিক্ষকতায় মোট ২২ বছর ও ২০ বছরের প্রকৃত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকদের অধ্যাপক বেতন কোড-০৪ এবং সহযোগী অধ্যাপক বেতন কোড-০৫ দিতে হবে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন শ্রেণীকার্যক্রম চলছে সেখানে শিক্ষকদের শ্রেণী বক্তৃতা পর্যবেক্ষণ করে (কতক্ষণ বক্তৃতা দিতে সক্ষম, বক্তৃতার মান, বক্তৃতা দেয়ার কৃত্রিমতা পরিহার, স্বাভাবিক থাকা প্রভৃতি যাচাই করে) প্রকৃত অভিজ্ঞ শিক্ষক বাছাই করা যাবে। আর যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা নেই সেখানে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম চালু করে তা করতে হবে। থানা ভিত্তিক ১০ শতাংশ শিক্ষককে অধ্যাপক ও ১০ শতাংশ শিক্ষককে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিতে হবে, যা এমপিওভুক্ত স্নাতক (পাস), স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কলেজে সীমাবদ্ধ থাকবে।
৩. প্রতিষ্ঠান প্রধান হওয়ার জন্য ২০ বছরের সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও ৫০ বছর বয়স হওয়ার বিধান চালু করতে হবে।
৪. বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৫ থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে।
৫. সর্বশেষ বেতন স্কেলের ৫০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া দিতে হবে।
৬. সর্বশেষ বেতন স্কেলের ২০ শতাংশ চিকিৎসা ভাতা দিতে হবে।
৭. মহানগরের জীবনযাপন ব্যয় অধিক বলে মহানগরের শিক্ষকদের নির্দিষ্ট হারে মহানগর ভাতা দিতে হবে।
৮. কলেজ তথা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষকদের চাকরিতে প্রবেশ বেতন কোড-০৮ নির্ধারণ করতে হবে।
৯. মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নির্ধারিত অভিজ্ঞতা থাকা সাপেক্ষে ব্যাচেলর অব এডুকেশন সার্টিফিকেট জমা দিলে তাকে উচ্চতর স্কেল দিতে হবে।
১০. সহকারী অধ্যাপক পদে ৫০ শতাংশ পদোন্নতি প্রথা বন্ধ করে যোগ্যতার মাপকাঠিতে পদোন্নতি দিতে হবে।
১১. বার্ষিক দু’টি পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দিতে হবে।
১২. ‘সহযোগী অধ্যাপক’ ও ‘অধ্যাপক’ পদ চালু করে এমপিও পদ সৃষ্টি করতে হবে।
আমরা আশা করি, ইউনেস্কো-আইএলওর সুপারিশ ১৯৬৬ আমাদের দেশে বাস্তবায়িত হবে। সে অনুযায়ী সরকার শিক্ষকদের ও শিক্ষার অগ্রগতিতে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক : পেশাজীবী সংগঠক, শিক্ষা গবেষক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট।
Email : kazimain@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement