‘সহিষ্ণু’ টিআইবির অসহিষ্ণুতা
- আমীর হামযা
- ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শুধু দেশবাসী নয়, সারা বিশ্ব দেখেছে; কিভাবে চেতনার কারবারি শেখ হাসিনা নিষ্ঠুরভাবে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে রক্তপিপাসু হয়ে ওঠেন। জুলাই বিপ্লবে হাসিনার খুনে বাহিনীর হাতে হতাহতের সংখ্যা এ কথার সাক্ষ্য বহন করছে। এখন পর্যন্ত যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে দেড় সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩০ সহস্রাধিক। আহতদের অনেকে জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। শত শত মানুষ দৃষ্টি হারিয়ে অন্ধ হয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট দেশের একমাত্র নোবেলজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়। এর পর থেকে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা সহায়তায় পরিচালিত বেসরকারি সংস্থাগুলোর আল্ট্রা সেক্যুলার কর্ণধাররা বেশ বিচলিত। সেই সাথে তাদের অসহিষ্ণুতা স্পষ্ট। কারণটা পরিষ্কার। পশ্চিমা সহায়তায় সংস্থা পরিচালিত হলেও ভারতের বন্ধুত্ব তাদের কাছে মহার্ঘ। অথচ এ দেশের মানুষ ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির বিরোধিতা করে দিল্লির অতি প্রিয়ভাজন শেখ হাসিনাকে উৎখাত করেছেন।
দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) কর্ণধার সবসময় সবাইকে সহিষ্ণু হওয়ার নসিহত করতে ভারি পছন্দ করেন। তার কথাবার্তায় এবং শরীরী ভাষা দেখে সবার মনে হতে পারে, তিনি অন্যকে উপদেশ খয়রাত করার শতভাগ হকদার। বাস্তবেও সেটি সত্য। টিআইবির কর্তাব্যক্তিটি উপদেশ দিতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেন না। গ্লানি তো নয়ই। তাই সময়ে-অসময়ে দেশে এতদিন নিষ্ঠার সাথে কাজটি করে এসেছেন তিনি।
টিআইয়ের বাংলাদেশ শাখা অর্থাৎ টিআইবির কর্ণধার ড. ইফতেখারুজ্জামান মানবতার ফেরিওয়ালা বলে সভা-সমাবেশে নিজেকে তুলে ধরতে কোনো কসুর করেন না। দেশবাসীর কাছে ‘মানবতাবাদী’ হিসেবে উপস্থাপিত হতেও কোনো কার্পণ্য নেই। ইদানীং অবশ্য মনে হচ্ছে, যেন তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। সহিষ্ণুতার মুখোশ খসে পড়ে বেরিয়ে পড়ছে আসল চেহারা। তার কর্মকাণ্ডে ঘটছে ছন্দপতন। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্ষমতার তখতে তাউস উল্টে যাওয়ার পর থেকে এটি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
দেশে সেক্যুলারদের অগ্রসেনানি টিআইবি। তাদের এখনকার হাবভাব দেখলে মনে হবে, তারা দেশের ধর্মবিশ্বাসী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ঊনমানুষের প্রজাতি ছাড়া অন্য কিছু ভাবেন না। এসব ঊনমানুষের যেকোনো দাবি, আল্ট্রা সেক্যুলারদের কাছে ‘বেয়াদবির শামিল’! এর সর্বশেষ নজির গত সোমবার টিআইবির বিবৃতিটি। সদ্য পতিত সরকারের বিতর্কিত শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনে গঠিত সমন্বয় কমিটি অপূর্ণতার কারণে বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে টিআইবি। বিবৃতি দিয়ে কমিটি বাতিলের প্রতিবাদ জানায়। সেখানে কিছু বেফাস কথা বলা হয়েছে। সুশীল ব্যক্তি ড. ইফতেখারের মুখে কিছু খড় বুলি মানে বস্তির ভাষা শুনতে পেলেন দেশবাসী। এতে অনেকে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারি এই ভেবে যে, আমাদের মতো তৃণমূলের মুখের ভাষায় কথা বলছেন ইফতেখারের মতো সুশীল, ভদ্রজন।
টিআইবির মতো সুশীল প্রতিষ্ঠানের এমন বিবৃতিতে অভ্যস্ত নই বলে আমাদের কাছে বিবৃতিটি অশোভন ও অমার্জনীয় এবং অসহিষ্ণুতার প্রকাশ মনে হচ্ছে। কেন আমাদের কাছে এমন লাগছে, তা অনুধাবনে পাঠকের সমীপে গণমাধ্যমে ড. ইফতেখারুজ্জামানের বিবৃতির খানিকটা তুলে ধরছি। এতে বলা হয়, ‘নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী মৌলবাদী হুমকির কাছে অন্তর্বর্তী সরকার আপস করে উদ্বেগজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে’। (নয়া দিগন্ত, ১ অক্টোবর, প্রিন্ট ভার্সন)
বিবৃতিতে বলা হয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত ও মুদ্রিত সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনে গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিলের সিদ্ধান্ত বৈষম্যহীন ‘নতুন বাংলাদেশের’ স্বপ্ন ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিপন্থী ও অন্তর্বর্তী সরকারের আপসকামী আচরণের পরিচায়ক বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। সেই সাথে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী মহলের সাথে আপসের পথ দৃঢ়ভাবে পরিহার করবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা আতঙ্কের সাথে লক্ষ করছি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বহুত্বের বিরুদ্ধে কুৎসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়িয়ে শঙ্কা ও হুমকির বাতাবরণ সৃষ্টির প্রচেষ্টা ক্রমে উৎকট রূপ ধারণ করছে। এ ধরনের স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচার, হুমকির প্রতি নতি স্বীকার করে অন্তর্বর্তী সরকার আপস করছে। যার উদ্বেগজনক উদাহরণ হলো- পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন সমন্বয় কমিটি বাতিলের ঘটনা। বিষয়টি এক দিকে যেমন সরকারের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সাথে আপসের উদাহরণ, তেমনি ‘নতুন বাংলাদেশে’র বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশের আকাক্সক্ষার প্রতি রীতিমতো প্রহসন। তিনি বলেন, কর্তৃত্ববাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে উত্থিত অশুভ জবরদখলকারী সাম্প্রদায়িক মহল যতই অতি ক্ষমতায়িত আচরণ করুক, তাদের বৈষম্যমূলক আদর্শকে সমাজের ওপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার যত অপচেষ্টা করুক, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চাই- বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূলধারা কোনোভাবে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক শক্তির বিকাশ ঘটতে দেবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতার মূল ভিত্তি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূলধারার বহুমত, অন্তর্ভুক্তি, সম-অধিকার ও অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ।
বলতে দ্বিধা নেই, বিবৃতিটি পড়ে প্রথমে মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এটি কি আসলেই টিআইবির বিবৃতি? না টিআইবির নামে কেউ ফেক স্ট্যাটমেন্ট দিলো। এমন সন্দেহ হওয়ার কারণ আর কিছু নয়; এটির বিষয়বস্তুর সাথে টিআইবির চারিত্রিক অমিল। মানবতার ফেরিওয়ালা কেন দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতি এত রূঢ় ভাষা প্রয়োগ করলেন। মাজেজা কী। এ লক্ষ্যে তত্ত্বতালাশ করা প্রয়োজন বৈকি।
বিবৃতিটি নকল নয়। শতভাগ সহিহ। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের স্বাক্ষরে গণমাধ্যমে পাঠানো হয় এটি। দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলো সযতেœ ছেপেছে। টিআইবির এই বিবৃতি প্রসঙ্গে পাঠকের কাছে কিছু কথা তুলে ধরতে চাই।
জাতীয়-মানস গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে শিক্ষা। বিশ্বের অগ্রসরমান প্রতিটি জাতি নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে। যাতে শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষার্থীরা স্বকীয়তা বজায়ে রেখে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে কর্মক্ষেত্রে অনন্য স্বাক্ষর রাখতে পারে। পরিতাপের বিষয়, ৫৩ বছরেও আমরা একটি যুৎসই শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারিনি। দেশে বিদ্যমান বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা জারি থাকায় মানুষের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বলয় তৈরি হয়েছে। একে-অপরের মধ্যে বিভেদের দেয়াল অলঙ্ঘনীয় হয়ে পড়েছে। পরিণামে জাতীয় ঐক্যের ভিত স্বাধীনতার এত বছর পরও নিতান্ত দুর্বল। লক্ষণীয়, দেশের সঙ্কটকালে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাই এক কাতারে দাঁড়ানোর নজির খুব কম। তবে অনস্বীকার্য, মাফিয়া শাসক হাসিনার পতন আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী ছাড়া সবাই অংশীদার।
পতিত স্বৈরাচারের পতনে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু শেখ হাসিনা গত সাড়ে ১৫ বছরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেন। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর রাষ্ট্র সংস্কারের গুরুভার বর্তেছে। সরকার সময় নষ্ট না করে সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে। শিক্ষা খাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বিগত সরকারের বিতর্কিত শিক্ষাক্রমে প্রণীত পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তড়িঘড়ি করায় এতে কিছু অপূর্ণতা রয়ে যায়। দেখা গেছে, ইংরেজি পড়নেওয়ালাদের ধর্মীয় বিষয়াদি দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এমন বৈসাদৃশ্যে দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি যারা ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত, সমন্বয় কমিটিতে দু’জন বিশিষ্ট ধর্মীয় স্কলারকে রাখার দাবি জানান। শুধু তারা নন, নানা পক্ষ থেকে কমিটি সংশোধনের দাবি ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকার সেই যৌক্তিক দাবি বিবেচনায় নিয়ে কমিটি বাতিল করে। এরপর সবাই যখন আশা করছিলেন দ্রুততম সময়ে নতুন কমিটির ঘোষণা আসবে; ঠিক তখন দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কমিটি বাতিলের বিরোধিতা করে এমন বিবৃতি দিলেন।
টিআইবির বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, শিক্ষা বিষয়ে সংস্থাটি এই ধরনের প্রশ্ন করতে পারে কি না? এটি সংস্থার কাজের আওতায় পড়ে কি না? যেখানে দুর্নীতিবিরোধী কাজ যাদের মুখ্য। বিদেশী সাহায্যপুষ্ট টিআইবির মতো এমন একটি সংস্থার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে ব্যবহৃত কিছু শব্দে সংবেদনশীল যে কারো নজর আটকাতে বাধ্য। যেমন- মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক শক্তি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ইত্যাদি।
এমন বিবৃতি দেয়ার আগে ড. ইফতেখারুজ্জামানের মনে রাখা দরকার ছিল, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন সমন্বয় কমিটি নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছেন, তারা জুলাই বিপ্লবের জোরালো অংশীদার। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের আন্দোলনে তারা সবচেয়ে বেশি জীবন দিয়েছেন। অতএব টিআইবির মতো বিদেশী অনুদানে পরিচালিত সংগঠনের এমন বিবৃতি দেয়ার নৈতিক অধিকার আদৌ আছে কি না সে প্রশ্ন উঠবেই। কারণ বিগত সাড়ে ১৫ বছরে হাসিনার দুর্নীতি নিয়ে সংস্থাটি কার্যকর প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা কতটুকু ছিল তা কারো অজানা নয়। কেউ যদি বলেন, দুর্নীতির বিষয়ে শেখ পরিবারকে ছাড় দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরোক্ষভাবে ফ্যাসিবাদের সহযোগিতা করেছে, সেটি কি অবান্তর হবে?
আসলে বিবৃতিটি বিদ্বেষপূর্ণ। কোনো প্রতিবাদের ভাষা যে এমন অশোভন হতে পারে এটি পাঠ না করলে উপলব্ধিতে আসবে না। আমরা বলতে চাই, গণ-অভ্যুত্থানের ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের যেকোনো সংস্কার কমিটিতে কিছু বিষয় প্রাধান্য দেয়া উচিত। প্রথমত, যারা জুলাই বিপ্লবের আদর্শ ধারণ করেন, তাদের অন্তর্ভুক্ত করা। দ্বিতীয়ত, তাদের স্থান দিতে হবে যারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন। তৃতীয়ত, আনুপাতিক হারে অন্য সব শ্রেণী-গোষ্ঠী ও নৃগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা।
এ ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন সমন্বয় কমিটি যেভাবে গঠন করা হয়েছিল তা সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। কিন্তু ড. ইফতেখারুজ্জামান সমন্বয় কমিটি বাতিল করার বিষয়ে বিরোধিতা করেছেন মনের জ্বালা থেকে। এতদিন অভিজাত হিসেবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে যে পুলক অনুভব করতেন, জুলাই বিপ্লবের অভিঘাতে তাতে ভাটার টান পড়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা