১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সেপটিক ট্যাংকে লাশের টুকরা

নিশ্চিত হতে এমপি আজীমের মেয়ে-ভাইকে নেয়া হচ্ছে কলকাতায়

এমপি আজীম ও তার মেয়ে - ফাইল ছবি

কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের যে ফ্ল্যাটে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যা করা হয়েছিল সেই ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাংক থেকে প্রায় ৪ কেজি ‘টুকরা মাংস’ পাওয়া গেছে। তবে এগুলো যে এমপি আজীমের তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেনি কলকাতায় যাওয়া ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দল। এগুলো এমপি আজীমের দেহাংশ কি না তা নিশ্চিত করতে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনকে কলকাতায় নেয়া হচ্ছে।

মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার প্রধান হারুন অর রশীদ এ তথ্য জানান। এমপি আজীম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে তার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের একটি গোয়েন্দা দল কলকাতায় অবস্থান করছে।

হারুন অর রশীদ বলেন, ইতোমধ্যে মাংসের টুকরোগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সেটা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হবে এবং ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। এরপরই নিশ্চিত হওয়া যাবে এটি আমাদের এমপি আজীমের লাশ কি না।

তিনি বলেন, এমপি আজীমের পরিবারের কাউকে কলকাতায় নিয়ে আসা ছাড়া দ্রুততম সময়ে লাশ শনাক্তকরণ সম্ভব নয়। তার মেয়ে ডরিনকে ইতোমধ্যেই বিষয়টি জানানো হয়েছে। আমি তাকে দ্রুত এখানে আসতে বলেছি। তিনি আসলে পরীক্ষাটা দ্রুত করানো যাবে। দু-একদিনের মধ্যে ডরিন এবং এমপির ভাই কলকাতায় আসতে পারেন।

লাশের টুকরা উদ্ধারের ব্যাপারে হারুন অর রশীদ বলেন, কলকাতা পুলিশের কাছে গ্রেফতার হওয়া জিহাদ হাওলাদার বলেছিলেন, প্রায় ৪ কেজি ওজনের দেহাংশ ফেলে দিয়েছিলেন। সেই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আজ সকালে সিআইডিকে অনুরোধ করেছিলাম ওই বাড়িতে তল্লাশি করার জন্য। সন্ধ্যায় তারা সেপটিক ট্যাংকে তল্লাশি করে একটি লাশের টুকরো পেয়েছেন বলে আমরা জেনেছি। তবে এটি এমপি আনারের কি না তা আমরা বা তারা কেউ নিশ্চিত নই। এ বিষয়ে তারা আমাদের আনুষ্ঠানিক কিছু জানায়নি।

হারুন বলেন, আমরা কাল সকালে কলকাতা সিআইডি কার্যালয়ে যাব। লাশের টুকরা উদ্ধারের বিষয়টি অফিসিয়ালি নিশ্চিত হতে হবে। সেটা যে সংসদ সদস্য আনারের তা ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া বলা সম্ভব নয়। আমরা আগে নিশ্চিত হই।

হারুন অর রশিদ বলেন, আমরা তদন্তের জন্য যেদিন প্রথম কলকাতায় এসেছি সেদিনই সঞ্জিভা গার্ডেন্স পরিদর্শনে যাই। এরপর আমরা আবাসনের প্লাম্বারের খোঁজ করি। কারণ, আমাদের সেপটিক ট্যাংক এবং সুয়ারেজ সিস্টেম দেখার প্রয়োজন ছিল। এর পাশাপাশি আমাদের কাছে থাকা তথ্যগুলো সিআইডিকে জানাই। আজকেও আমরা সিআইডিকে ঘটনাস্থলে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করার অনুরোধ জানাই। সে অনুযায়ী সেপটিক ট্যাংকে তল্লাশি অভিযান চালিয়ে এবং সুয়ারেজ সিস্টেম ফ্ল্যাশ করে বেশ কিছু মাংস উদ্ধার করা হয়।

ডিএমপির এই অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ঘাতকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আমরা বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছি। একটা মামলা করতে গেলে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য যেমন দরকার তেমন শরীরের পুরো অংশ না হলেও খণ্ডিত কিছু অংশ প্রয়োজন হয়। সেজন্য আমাদের অনুরোধে সিআইডি সেপটিক ট্যাংক থেকে কিছু মাংস উদ্ধার করেছে।

মাংসের সাথে চুল উদ্ধার হয়েছে বলে যে খবর পাওয়া গেছে তা নিয়ে ডিএমপির ডিবিপ্রধান জানান, তদন্তের জন্য এক টুকরো টুকরা মাংস হলেই হয়। আগে ফরেনসিক হোক, তারপর ডিএনএ হোক, তারপর বলা যাবে এটি কার দেহের অংশ।

এর আগে, এমপি আনারের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) আব্দুর রউফ বলেন, ১২ মে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। কিন্তু এরপর ১৬ মে তার সাথে শেষ কথা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে ১৯ মে ডিবি কার্যালয়ে যান আনোয়ারুল আজীমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, তিনদিন ধরে আমার বাবাকে ফোনে পাচ্ছি না। তার মোবাইল ফোনটি মাঝে মাঝে খোলা পাই আবার মাঝে মাঝে বন্ধ পাই। এই বিষয়ে আমি ডিবি প্রধানের সাথে যোগাযোগ করি।

যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করা হয়েছিল বলে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি জানিয়েছে, সেই ফ্ল্যাটটি মে মাসের গোড়ায় ভাড়া নিয়েছিলেন আজীমের বন্ধু ও ব্যবসার সঙ্গী, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান, সেটাও বলেছেন সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী।

তবে কলকাতার সিঁথি অঞ্চলের বাসিন্দা, গয়না ব্যবসায়ী আজীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও আখতারুজ্জামানকে চেনেন না বলে দাবি করেছেন গোপাল বিশ্বাস।

তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, যে তার সাথে নিহত সংসদ সদস্যের প্রায় আড়াই দশকের ঘনিষ্ঠতা হলেও আখতারুজ্জামান বলে কারো কথা তিনি শোনেননি।

গোপাল বিশ্বাস বলেন,‘আমি আসলে তার ব্যবসা বা রাজনীতির জগতের পরিচিতদের চিনতাম না, এসব ব্যাপারে তার সাথে আমার কথাও হত না।’

বুধবার সকালে বন্ধুর খুন হওয়ার খবর পাওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবেই কারো সাধে কথা বলেননি তিনি, বাড়িতে ছিলেনও না।

বৃহস্পতিবারও তিনি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোনো জায়গায় আছেন।

তিনি বলেন,‘আমি যেহেতু আজীমের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ডায়েরি করেছিলাম থানায়, তাই তিনি খুন হওয়ার পরে পুলিশ আমাকে নিউ টাউন থানায় গিয়ে খুনের মামলার ডায়েরি করতে বলেছিল।’

গোপাল বিশ্বাস বলেন, ‘তবে আমি অনলাইনে সেই ডায়েরি করেছি বরাহনগর থানা আর ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটে।’

তার দায়ের করা ডায়রির ভিত্তিতেই পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত খুনের মামলা রুজু করেছে।

এর আগে বুধবার গোপাল বিশ্বাস বলছিলেন,‘এবারে তিনি এসে আমাকে বলেছিলেন যে- স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাবেন। কোন ডাক্তার ভালো হবে, সেটাও জানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার জানাশোনা কোনো স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ নেই, তাই আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম সল্ট লেকের অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারেন।’

‘আমরা একসাথে সকালের খাবার খেয়েছিলাম। তারপরে এটাও তাকে বলেছিলাম যে- আমার গাড়ি সেদিন নেই, উনি যেন গাড়ির বন্দোবস্ত করে নেন। এরপরে আমি বাড়ির একতলায় অফিসে চলে

‘এরপর আমি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দুপুরে বেরনোর সময়ে আমাকে বলে যান যে- তিনি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবেন। তার খোঁজ না পাওয়ার পরে আমি যখন সিসিটিভি ফুটেজ দেখি, তখন জানতে পারি যে- উনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন দুপুর একটা ৪১ মিনিটে,’ বলছিলেন গোপাল বিশ্বাস।

বরাহনগর থানায় যে নিখোঁজ ডায়েরি করেছেন গোপাল বিশ্বাস সেখানে তিনি লিখেছেন, তার বাড়ির অদূরে বিধান পার্ক এলাকা থেকে ভাড়ার গাড়িটিতে ওঠেন আনোয়ারুল আজীম। তাকে গাড়িতে উঠতে দেখেছেন, এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথাও পুলিশকে জানিয়েছেন বিশ্বাস।

সন্ধ্যায় বন্ধুর বাড়িতে ফিরে আসার কথা থাকলেও সেখানে ফেরেননি আজীম।

হোয়াটস্অ্যাপে ১৩ মে তিনি মেসেজ পাঠান যে ‘বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছি এবং পৌঁছে ফোন করবো, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।’

ডাক্তার দেখাতে বের হয়ে দিল্লিতে?
কলকাতার গোপাল বিশ্বাস বলেন,‘বাংলাদেশে বিএনপির জমানায় আজীম ভারতে থাকত। আমাদের বাড়ি মাঝদিয়ায়। সেখানে সুভাষ আগরওয়ালের বাড়িতে থাকত আনার। আমার সাথে সেখানেই পরিচয়, তারপরে বন্ধুত্ব। সম্পর্কটা এখন পারিবারিক স্তরে চলে গেছে,’ জানালেন গোপাল বিশ্বাস।

সে কারণেই চিকিৎসা করাতে এসে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আনোয়ারুল আজীম।

সেদিন দুপুরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরে আজীম যে ভাড়াচালিত গাড়িতে উঠেছিলেন সেটির চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।

এরপর গোপাল বিশ্বাসকে পুলিশ জানিয়েছে, আজীমের সাথে আরেকজন বাংলাদেশী নাগরিককে নিউ টাউন অঞ্চলে ছেড়ে দেয়ার কথা জানিয়েছেন ওই চালক।

এরপর ১৫ মে সকালে গোপাল বিশ্বাস আজীমের কাছ থেকে আবারো একটি হোয়াটস্অ্যাপ মেসেজ পান যে- তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং তার সাথে ‘ভিআইপিরা’ আছেন, তাই তাকে যেন ফোন না করা হয়।

এর দু'দিন পরে, ১৭ মে গোপাল বিশ্বাসকে আজীমের মেয়ে ফোন করে জানান যে, তার বাবার সাথে কিছুতেই তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না।

‘ওই খবর জানতে পেরে কলকাতায় ওর যত ঘনিষ্ঠ মানুষ আছেন বলে আমি জানি, সবাইকে বিষয়টা জানাই। তারাও খোঁজ খবর করতে শুরু করেন। কিন্তু কোনোভাবেই আজিমকে ফোনে পাওয়া যায়নি,’ বলছিলেন বিশ্বাস।

পরের দিন, ১৮ মে বরাহনগর থানায় যান তিনি।

বিশ্বাস বলেন,‘সেখানে আমাকে সারাদিন বসিয়ে রাখা হয়। পুলিশ আমার বাড়িতে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। সেসব খতিয়ে দেখে আমার নিখোঁজ ডায়েরি নেয়া হয়। তারা ওই ভাড়ার গাড়িটির নম্বরও পেয়ে যায়। চালকের সাথে কথা বলেছে। নিশ্চয়ই পুলিশ খোঁজখবর করছে, আমাকে তো আর সব তথ্য জানাচ্ছে না।’

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশের উপ-দূতাবাস যে তথ্য পেয়েছিল, সে অনুযায়ী ১৭ মে আজিমের মোবাইল নম্বরটি কিছুক্ষণের জন্য বিহারে অবস্থান করছিল।

আবার এটাও জানতে পেরেছে তারা যে মোবাইল সেট থেকে সিম কার্ডটি আলাদা করে রাখার কারণে সঠিক অবস্থান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এর আগে, ঢাকায় ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘তার দুটি বাংলাদেশী নম্বর আছে আর একটি ভারতের নম্বর। আমরা ভারতীয় পুলিশের সহযোগিতায় তার ভারতীয় নম্বরটি দেখলাম মুজাফফরাবাদ অর্থাৎ বিহারের দিকে।’

ঘটনাচক্রে বিহারে মুজাফফরাবাদ নামের জায়গা নেই। পাকিস্তান শাসিত জম্মু-কাশ্মিরের রাজধানীর নাম মুজাফফরাবাদ, আর প্রায় কাছাকাছি যে নামের জায়গা বিহারে আছে, সেই জায়গার নাম মুজফ্ফরপুর।


আরো সংবাদ



premium cement