হেফাজতের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে সরকার
- মনিরুল ইসলাম রোহান
- ১০ এপ্রিল ২০২১, ০৬:১৮
হেফাজতে ইসলামের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। এর আগে রাজধানীর দোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ ইস্যুতে হেফাজতে ইসলামের তীব্র বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও কিছুটা নমনীয় নীতি অবলম্বন করেছিল সরকার। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন ঠেকাতে রাজপথে সক্রিয় অবস্থান ও বড় বড় সভা সমাবেশ করে ইসলামী সমমনার অরাজনৈতিক এ জোট। বিশেষ করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে বায়তুল মোকাররমসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুর, সরকারি স্থাপনায় হামলা ও আগুন লাগার ঘটনা ভালোভাবে নেয়নি ক্ষমতাসীনরা। এরই মধ্যে সহিংসতাপূর্ণ এলাকার হেফাজত নেতাদের একটি তালিকা করার জন্য স্থানীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড।
সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও বর্তমানে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের রাজপথে সক্রিয় অবস্থান দেখা যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে রাজধানীর দোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ ইস্যুতে হেফাজতে ইসলাম তীব্র বিরোধিতা করে বেশ কিছু দিন রাজপথে সক্রিয় ছিল। তখন সরকার কিংবা সরকারি দল তেমন একটি প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু মোদি বিরোধী আন্দোলন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি সরকার। যদিও সরকারের তরফ থেকে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হয়েছিল, ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদিকে দাওয়াত দেয়া হয়নি, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে হেফাজতে ইসলাম তীব্র বিরোধিতা করে বায়তুল মোকাররমসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা শুধু এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি, একপর্যায়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি পরবর্তীতে কঠোরভাবে হরতাল পালন করার মধ্য দিয়ে তাদের শক্তি প্রদর্শন করে, যা নিয়ে কিছুটা হলেও সরকার চিন্তিত ছিল।
ফলে সরকার মনে করছে, এখনই অরাজনৈতিক ইসলামী এ সংগঠনটির লাগাম টেনে ধরা দরকার। এখনই রাশ টেনে না ধরলে সরকারবিরোধী দলগুলো সুযোগ নিতে পারে। তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। এসব বিবেচনা করেই এরই মধ্যে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে সারা দেশে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। শিশু বক্তা হিসেবে পরিচিত মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানীসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পল্টন থানার একটি মামলায় হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককেও গ্রেফতার করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের পরে হেফাজতের নেতাকর্মীদের মধ্যে পরবর্তীতে কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া পারে সে বিষয়টি নিয়ে এখন মাঠ পর্যালোচনা চলছে। ইতিবাচক-নেতিবাচক বিশ্লেষণ করে এবং প্রতিক্রিয়ার ধরন মাথায় রেখেই সামনের দিকে এগোতে চায় সরকার।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য লে. কর্নেল (অব:) ফারুক খান নয়া দিগন্তকে বলেন, হেফাজতের ব্যাপারে আমরা কখনোই শিথিলতা দেখায়নি। সরকারের কিছু নিজস্ব নীতি থাকে, চিন্তাভাবনা থাকে সে অনুযায়ী কাজ করতে হয়। হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। তিনি বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনসহ পরবর্তী সময়ে হেফাজতে ইসলাম যে সহিংসতা চালিয়েছে এ জন্য আইনি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকটি মামলা হয়েছে, সহিংসতার সাথে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যারাই বিশৃঙ্খলা করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকে সরকারের সাথে একটি সুসস্পর্ক তৈরি হয় হেফাজতে ইসলামের। ওই সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরই কওমি মাদরাসাকে শিক্ষাব্যবস্থার মূল ধারায় আনার জন্য ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবি- এ দু’টি বিষয়কে মাস্টার্সের সমমান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। তখনকার হেফাজতে ইসলামের আমির ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। সম্প্রতি আহমদ শফীর ইন্তেকালের পর হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে। তা ছাড়া হেফাজতে ইসলামের সাথে সরকারের তরফ থেকে লিয়াজোঁ মেইনটেইন করার জন্য ছিলেন আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মো: আবদুল্লাহ এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি শামীম মোহাম্মদ আফজাল। তারা দু’জনই বৈশ্বিক মহামারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
এর পর থেকেই হেফাজতে ইসলামের সাথে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী ওলামা লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব মুফতি মাসুম বিল্লাহ নাফেয়ী নয়া দিগন্তকে বলেন, আহমদ শফী থাকাকালে হেফাজতের সাথে সরকারের সুসম্পর্ক ছিল। উনি মারা যাওয়ার পর হেফাজতের নতুন যে কমিটি হয়েছে, ওই কমিটির সাথে সরকারের সম্পর্ক ভালো না। আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীসহ তার সমর্থকরা হেফাজতে ইসলামে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। হেফাজতের নীতি-নির্ধারকদের ওপর ওই অংশের কোনো প্রভাব নেই। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যেও একটি অংশ হেফাজতে ইসলামের বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে; যে কারণে হেফাজত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করলেও দল ও সরকারের পক্ষ থেকে কিছুটা শিথিলতা দেখানো হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তাদের কাছে টানতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু শেষমেশ হেফাজতের মোদি বিরোধী আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নেয়ায় সরকার নমনীয় নীতি থেকে সরে এসে কঠোর অবস্থানে চলে গেছে।
হেফাজতের ব্যাপারে সরকারের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কোর কমিটির জরুরি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি কঠোর অবস্থানে যাবো। জেলা পর্যায়ে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বসে যেখানে যা প্রয়োজন, তারা সে ব্যবস্থা করবেন। হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনি অপরাধ করলে মামলা তো হবেই, মামলা মামলার গতিতে চলবে। সেখানে কারো হাত নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় চিহ্নিত নাশকতাকারীদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, হেফাজত ইসলাম নামে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশের বিদ্যমান স্বস্তি ও শান্তি বিনষ্টে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে অব্যাহত তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে, তা সহনশীলতার সব মাত্রা অতিক্রম করেছে। আওয়ামী লীগসহ সব অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উসকানিদাতাদের তালিকা প্রস্তুত করে এদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে।