প্রবৃদ্ধি নয় জনজীবন রক্ষা ও জীবিকায় অগ্রাধিকার দিন
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ০৯ জুন ২০২০, ১৬:২৬, আপডেট: ০৯ জুন ২০২০, ২৩:৪০
করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে সরকারকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে জোর না দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা ও জীবিকার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার আহবান জানিয়ে ১৩ দফা বাজেট প্রস্তাবনা দিয়েছে বিএনপি। আগামী ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার দুই দিন আগে মঙ্গলবার সকালে উত্তরার নিজের বাসা থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দলের বাজেট ভাবনা তুলে ধরতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই প্রস্তাবনা দেন।
তিনি বলেন, করোনা সঙ্কটকালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে জোর না দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা ও জীবিকার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। করোনা সংক্রমণ রোধ করতে না পারলে কোনোভাবেই অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যখাতে এহেন ঝুঁকি থাকলে অর্থনীতির স্বস্তির কোনো অবকাশ নেই। বিএনপি’র পক্ষ থেকে আমরা মনে করি তিন বছর মেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার আলোকে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের মধ্য মেয়াদি বাজেট কাঠামোয় মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির সমন্বয়ে নতুন ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে, অর্থনীতির ক্রমহ্রাসমান সংকোচন রোধে কর্মসংস্থান ধরে রাখতে হবে, আয় সংকোচন রোধ করতে হবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
গত ৪ এপ্রিল করোনা মহামারি মোকাবিলায় বিএনপির পক্ষ থেকে ৮৭ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তার যে প্যাকেজ প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো তাকে বাজেট প্রণয়নে প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় নেয়ার আহবান জানান বিএনপি মহাসচিব। ১৩ দফা প্রস্তাবনার মধ্যে অগ্রাধিকার হিসেবে স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রমকল্যাণ, কৃষি, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্ধ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা পূর্ণগঠন ও স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার, সার্বজনীন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গঠন, সরকারি বিনিয়োগ ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতের বরাদ্ধ বৃদ্ধি, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কৃষি ও গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, কর্মহীন, কর্মক্ষম, বেকার, দরিদ্র মানুষদের নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান প্রভৃতি।
স্বাস্থ্যখাতে চরম দুরাবস্থার কথা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, করোনাকালে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সারাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কীভাবে ভেঙে পড়েছে। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে রিস্টোর করতে হবে, পুনর্গঠিত করতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল করতে হবে। এমন টেকসই ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি করোনা জাতীয় মহামারির মতো সঙ্কট মোকাবিলায় পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়, যারা যুদ্ধকালীন সময়ের মতো সর্বদা প্রস্তুত থাকবে একটি ইন বিল্ড সিস্টেমের আওতায়। স্বাস্থ্যখাতে তথা প্রত্যেকের জন্য পারিবারিক ডাক্তার, নার্স ও অবকাঠামোসহ সামগ্রিক ব্যয় জিডিপি‘র ৫ শতাংশ বরাদ্ধ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে স্বাস্থ্য ভাতা আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে বিএনপির বাজেট প্রস্তাবনায়।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠি বিশেষ করে ‘দিন আনে দিন খায়’ শ্রেণির মানুষজনদের সার্বজনীন সামাজিক কর্মসূচির আওতায় এনে তাদের নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান, বেকার ভাতা-প্রতিবন্ধী ভাতা-শিশু প্রতিপালন ভাতা-পেনশন ভাতা-আবাসন সুবিধা, স্বাস্থ্য ভাতা প্রদানে এই খাতে জিডিপির ৬-৭ শতাংশ বরাদ্দ, আইটি প্রযুক্তি ও গবেষণা খাতে বিশেষ বরাদ্ধ, কৃষি ও খাদ্য খাতে জিডিপি ও বাজেটের কমপক্ষে ১ দশমিক ৫ ও ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ বরাদ্ধ, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবাখাতে বরাদ্ধ জিডিপির দশমিক ৭৩ শতাংশ ও বাজেটের ২ দশমিক ৮১ শতাংশ বৃদ্ধি, সবুজ শিল্পায়ন ও গ্রামীন অর্থনীতি উজ্জীবন, সমন্বিত শিল্পায়ন ও অবহেলা উন্নয়নের ইকুইটি ম্যাচিং তহবিল ও কৃষি কমিশন গঠন, প্রবাসীদের সহজশর্তে ঋণ প্রদান, সুপারিশও করা হয়েছে বিএনপি’র এই প্রস্তাবনায়।
পোশাক শিল্পখাতে মালিক সমিতির শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, মহামারি সঙ্কটকালে শ্রমিকরা যাতে কর্মহীন হয়ে না পড়ে সেজন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা আর্থিক প্রনোদনা নেয় মালিকেরা। প্রণোদনাও নেবেন, ছাঁটাইও করবেন- এই দুইটা একসাথে চলতে পারে না। মোদ্দাকথা, এই সঙ্কট চলাকালে শ্রমিক ছাঁটাই হবে অমানবিক ভুল সিদ্ধান্ত।
মহামারি পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস, বিদ্যুৎখাতে ক্যাপাসিটি চার্জ ভর্তুকি বাদ দেয়া, অতিরিক্ত জনবলের বিষয়ে ব্যবস্থাগ্রহণ, দ্বি-পক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উৎস থেকে বিদেশী অনুদান বৃদ্ধি, দীর্ঘমেয়াদি কম সুদের ও গ্রেস পিরিয়ড সম্পন্ন বিদেশী ঋণ নেয়া, অভ্যন্তরীন ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ না দেয়া ট্রেজারি বিল ও সঞ্চয়পত্রের ঋণ পরিশোধ ব্যয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্র্রার আমদানি তহবিল গঠন, সহজে কর আদায়ের খাতসমূহ এক্সপ্লোর করা, দেশে অবস্থানরত কর্মরত অনিবন্ধিত প্রায় আড়াই লাখ বিদেশী নাগরিকদের কাছ থেকে ওয়ার্ক পারমিট ও আয়কর বাবদ প্রায় দেড় মিলিয়ন অর্থ আদায় করা, ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল সক্রিয় করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো থেকে কর বৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা অদলবদল বা কারেন্সি সোয়াপ, বার্টার ব্যবস্থা চালুর পদক্ষেপ গ্রহণ, পূঁজিবাজার বর্হিগমন নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতি কঠোরভাবে মনিটরিং করার মাধ্যমে বাজেটে অর্থসংকুলানের ব্যবস্থা করার সুপারিশও করা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবনায়।
মির্জা ফখরুল বলেন, অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ায় আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর কমবে। ফলে রাজস্ব আশানুরুপ হবে। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য বিদেশী ঋণের ওপর জোর দিতে হবে। বাজেট ঘাটতি ও জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত সহনীয় কোঠায় রাখতে হবে। শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে তারল্য যোগানের মাধ্যমে এই মহামারির সঙ্কটকাল থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। প্রয়োজন সক্রিয় রাজস্ব নীতির। ঋণ খেলাপি ও সুশাসনের অভাবে অনেকেই ঋণ নিয়ে তার পরিশোধ না করে অবৈধভাবে বিদেশে পাঁচার, ভর্তুকি ও দুর্ণীতির বিস্তারে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনাও করেন তিনি।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি সব কিছুর মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। আমূল পরিবর্তন না করলে অর্থনীতি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থবির হয়ে যাবে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের আঘাত আসবে। এই পরিবর্তন কীভাবে ঘটবে তা নির্ভর করবে রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সম্পর্কের ওপর। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের কাছে সরকার কতটুকু জবাবদিহি তার ওপর। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নেই। কারণ তারা জনগণের ভোটের তোয়াক্কা করে না। একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কারণে সরকারের কোনো বৈধ্যতা নেই। তারপরও এই মহাসঙ্কটের সময়ে বৃহত্তর স্বার্থে আমরা দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় প্রয়াসের আহবান জানাচ্ছি। করোনা সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যর্থতা ও সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিণতির দায় বর্তমান সরকারকেই নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা