আবরারকে নিয়ে মর্মস্পর্শী বর্ণনা স্বজনদের
- ইকবাল মজুমদার তৌহিদ, কুষ্টিয়া থেকে ফিরে
- ১৯ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:২৫, আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৯, ২১:১৫
আবরারের মতো ভালো ছেলে এ পৃথিবীতে হয় না। সে দেশের একটা সম্পদ ছিল। সে কোন রাজনীতি করতো না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। কারো সাথে উচ্চস্বরে কথা বলত না। বই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আমরাই তার মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছি না। আর বাবা-মা মানবে কিভাবে? আমরা আমাদের ছেলেকে হারিয়েছি এখন আমাদের একটাই চাওয়া। আমাদের সন্তানকে জানোয়ার গুলো যেভাবে কষ্ট দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে ঠিক সেভাবে ওদেরকে মারা হলেই আমাদের মন শান্তি পাবে। আমরা মরেও শান্তি পাবো।
কান্না জড়িত কণ্ঠে নয়া দিগন্তের সাথে মনের ভেতরে জমে থাকা কষ্টগুলো প্রকাশ করেছেন বুয়েটে নিহত আবরার ফাহাদের চাচী শিউলি আক্তার। গত ৭ অক্টোবর বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
দাদা-দাদীর সাথে শিশুকালে আবরার ফাহাদ
শিউলি আক্তার নয়া দিগন্তকে জানান, আবরার দুই ঈদে বাড়িতে আসত। তাছাড়া কোনো বাড়িতে অনুষ্ঠান থাকলে তখন আসতো। দাদা দাদীর কথা মনে পড়লে মাকে সাথে নিয়ে বেড়াতে আসত। বাড়িতে আসলে বেশিরভাগ সময় ছোট ভাইবোনদের নিয়ে মোবাইলে গেমস খেলতো এবং গল্প করতো। এখানে আসলে ও ভাজা পিঠা খেতে খুব পছন্দ করত এবং গোশত ও রুটি খেত। আবরার মায়ের সাথে মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করতেও খুব পছন্দ করত।
গত বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) কুষ্টিয়ার রায়ডাঙ্গায় আবরার ফাহাদের গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পুরো গ্রামটি যেন আবরারের মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন। আবরারের মৃত্যু সারাদেশের মানুষকে যেভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে তার ছাপ কোন অংশে কম পরেনি তার নিজ গ্রামে। আবরারের বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় উঠানে বসে মহিলারা কথা বলছিল। এ সময় কথা হয় আবরারের চাচী শিউলি আক্তারের সাথে। তার সাথে যখন কথা হয় এই প্রতিবেদকের পাশ থেকে গ্রামের মহিলারা বলছিল ‘এমন সোনার ছেলেরে মানুষ ক্যামনে মারে?’
আবরারের পাশের বাড়ির এক নারী বলেন, আবরার খুব ভালো ছেলে ছিল। আমরা ওকে নিয়ে খুব গর্ব করতাম। আমার মেয়েকে সবসময় আবরারের মতো হওয়ার জন্য বলতাম। আবরারের মৃত্যু আমি কোনভাবে মেনে নিতে পারছি না। আবরারের মৃত্যুর খবর শুনে এলাকার খুব কম মানুষ আছে যারা কান্না করেনি। আবরারের মতো ছেলে লাখে একটাও হয় না।
প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়্ ৭ বছর বয়সী আবরার ফাহাদের চাচাতো ভাই মো. আবির নয়া দিগন্তকে জানায়, ভাইয়া যখনই বাড়িতে আসতো আমার জন্য চকলেট ও চিপস্ নিয়ে আসতো। ভাইয়া বেশিরভাগ সময় টিভি দেখতো। যখন নামাজে যেতো তখন আমাকে সাথে নিয়ে যেতো। মাঝে মধ্যে বিকেলে তাকে কাঁধে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে বের হতেন বলেও জানায় সে।
আবরারের ফুফু শামসুন্নাহার নয়া দিগন্তকে জানান, আবরারের বাবারা ৫ ভাই ও ৫ বোন। চাচা ও ফুফুদের নয়নের মনি ছিল আবরার। ছোট বেলা থেকে আবরার শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিল। তিনি বলেন, আবরারের মাঝে আমি সবসময় এক প্রকার আল্লাহ ভীতি লক্ষ্য করতাম। ও ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত নামাজ পড়তো।
ফুফু ও ছোট ভাইয়ের সাথে আবরার ফাহাদ
তিনি আরো জানান, আবরার বেশিরভাগ সময় বাড়িতে আসলে ঘরে বসে থাকতো, টিভি দেখতো এবং নামাজে যেত। বাড়িতে ও যখন নামাজে যেতো তখন ছোট সব কাজিনদের সাথে করে মসজিদে নিয়ে যেতো। এটা ছিলো আবরারের একটি বড় গুণ। মাঝে মধ্যে বিকেলে আবরার চাচাতো-ফুফাতো ভাই বোনদের নিয়ে ঘুরতে বের হতো বলেও জানান তিনি। এ সময় শামসুন্নাহার আবরারের ছোটবেলার কিছু ছবি বের করে দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
আবারের ফুফু শামসুন্নাহার নয়া দিগন্তকে আরো জানান, ছোটবেলা থেকে আবরারের ৪ নম্বর চাচা আমিরুল ইসলাম তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। আমিরুল ইসলামের সাথেই আবরার সবচাইতে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল। আবরারের চাচা আমিরুলের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আবরারের বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না, বলেই কান্না করে দেন। কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, আবরার যখন ছোট ছিল, আমি তখন কুষ্টিয়ায় ছিলাম। প্রায় প্রতিদিন আমি ওকে দেখার জন্য যেতাম। ও খুব শান্ত স্বভাবের হওয়ায় আমার খুব ভালো লাগতো। আবরার কখনো কোন বাজে আবদার করতো না। এমনকি ওকে কখনো কোথাও আমি আড্ডা দিতে দেখিনি। আবরার স্কুলে যেতো, স্কুল থেকে সরাসরি বাসায় চলে আসতো। এটাই ছিল ওর নিয়মিত রুটিন। ওকে না দেখলে বুঝা যাবে না যে মানুষ কতটা নিয়মতান্ত্রিক জীবন পরিচালনা করতে পারে।
আবরারের চাচা রবিউল আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের স্বপ্ন ছিল আবরার বড় হয়ে দেশের জন্য কোন কিছু আবিষ্কার করবে। ওকে নিয়ে আমাদের পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস আমাদের সেই সন্তান লাশ হয়ে ঘরে ফিরেছে। আমাদের স্বপ্নগুলো একটা ঝড় এসে ধ্বংস করে দিল। ওর সাথে কাটানো দিনগুলো সারাজীবন সৃতি হয়েই থাকবে। কখনো যা ভুলতে পারব না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা