আট বছর ধরে প্রহর গুনছেন স্ত্রী, অভিমানী ছেলের আত্মহত্যা
ঘরে ফেরে না ওরা পর্ব- ১- শাহেদ মতিউর রহমান
- ২৪ এপ্রিল ২০১৯, ১১:১০, আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৯, ১৬:৪৩
নিখোঁজের আট বছর পর লিটনের পরিবারে এখন শুধুই দুঃখের অমানিশা। স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় এখনো পথ চেয়ে থাকেন মুক্তা বেগম। অপেক্ষার পরও বাবা ফিরে না আসায় আত্মহত্যা করেছে অভিমানী ছেলে আকাশ। ছোট্ট মেয়ে স্নেহা এতদিনে ভুলেই গেছে বাবার আদরমাখা সব স্মৃতি। স্বামী গুম আর ছেলের আকস্মিক মৃত্যুতে মা মেয়ের ছন্নছাড়া জীবন চলছে কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে। ভাই আর দেবর ভাসুরদের আর্থিক সহায়তায় অসহায় এ দু’জনের দিন কাটে নিদারুণ কষ্টে।
২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকার তোপখানা রোডের নিউ ইয়র্ক হোটেলের নিচ থেকে নিখোঁজ বা গুমের শিকার হন নড়াইলের আমিনুল ইসলাম লিটন। বয়স ৩৮। পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী। লোহাগড়ার লুটিয়া গ্রামের মৃত শেখ তারা মিয়ার ছয় ছেলের মধ্যে লিটন ছিলেন দ্বিতীয়। নিখোঁজ হওয়ার পর সাড়ে সাত বছরে পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও দফতরে খোঁজাখুঁজি করেও কোনো সন্ধান না পেয়ে এখন ভাগ্যের হাতেই সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন। বিধাতার অমোঘ নিয়মকেই যেন মেনে নিয়েছেন তারা। মানবাধিকার কমিশন, আইন ও শালিশ কেন্দ্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার, র্যাব সদর দফতরসহ সব জায়গাতেই লিটনের খোঁজ পেতে দৌড়ে বেড়িছেন পবিরারের সদস্যরা। সব শেষে গুম হওয়া লিটনের খোঁজ পেতে তারা এখন (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) পিবিআইয়ের দারস্থ হয়েছেন। কিন্তু সেখান থেকেও আশার কোনো খবর তারা পাচ্ছেন না।
নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে গুম হওয়া লিটনের পরিবারের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে। লিটনের ভাই শেখ ফিরোজ আলম জানিয়েছেন, ২০১১ সালের ২৯ অক্টোবর লিটন ও তার এক বন্ধু ব্যবসায়ের কাজে ঢাকায় এসে পল্টন এলাকায় তোপখানা রোডের হোটেল নিউ ইয়র্কে উঠেন। দু’দিন ঢাকায় ব্যবসায়ের বিভিন্ন কাজকর্মও করেছেন তারা। সর্বশেষ ৩১ অক্টোবর রাত সাড়ে ১০টার দিকে হোটেল থেকে নিচে নেমে গেটের গার্ডকে ১০ মিনিটের কথা বলে বন্ধু আনিসুর রহমানসহ বাইরে বের হন লিটন। এরপর থেকে দু’জনেরই আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ঘটনার পর শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরিও হয়েছে। (জিডি নং ১৫০ তাং ০৩/১১/২০১১ইং)। এ-ঘাট ও-ঘাট ঘুরে এভাবেই কেটে গেছে সাড়ে সাতটি বছর। লিটনের খোঁজ আজো মেলেনি।
এ দিকে লিটনের ফিরে আসার দীর্ঘ অপেক্ষার পরেও বাবার আদর আর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে ছোট ছেলে আকাশ। চাওয়ার আগেই বাবার কাছে সবই পেয়ে যেত আকাশ। বাবার অবর্তমানে মায়ের কাছেও যেন আকাশের বায়নার অন্ত ছিল না। এটা চাই ওটা চাই, যেন সবই চাই তার। এরই একপর্যায়ে ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর মায়ের সাথে অভিমান করে গলায় দড়ি দেয় বাবার স্নেহ বঞ্চিত আকাশ। ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করে সে। একদিকে স্বামীর অনুপস্থিতি, অন্য দিকে ছেলের এই আকস্মিক মৃত্যুতে লিটনের স্ত্রী মুক্তা বেগমের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়–য়া একমাত্র মেয়ে স্নেহাকে অবলম্বন ভেবে খুলনায় কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন মুক্তা বেগম।
গুম হওয়া ভাই লিটনের খোঁজ পেতে অন্য ভাইয়েরা প্রশাসনিক বা আইনানুগ কোনো পন্থাই বাদ দেননি। তারা শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করার পরে ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর পেনাল কোডের ৩৬৫ ধারায় একটি মামলাও রুজু করেন। (মামলা নং ৪০)। ২০১২ সালের ১৮ জানুয়ারি লিটনের স্ত্রী জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবরে নিখোঁজ বা গুম হওয়া স্বামীর সন্ধান পেতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে লিখিত আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২২ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক শামীম আহমেদ স্বাক্ষরিত পত্রের মাধ্যমে তৎকালীন র্যাবের ইন্টেলিজেন্স বিভাগের পরিচালক কর্নেল জিয়াকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনাও দেয়া হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, মহাপুলিশ পরিদর্শক- সদর দফতর, র্যাবের মহাপরিচালক, উপ পুলিশ কমিশনার রমনা বিভাগ বরাবরেও মুক্তা বেগম স্বামীর সন্ধান পেতে আবেদন করেন (তারিখ ১৬ নভেম্বর ২০১১ ইং)।
গুম হওয়া লিটনের ভাই শেখ ফিরোজ আলম অভিযোগ করেন, আমার ভাই তার বন্ধুসহ রাত সাড়ে ১০টায় নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন দু’টিও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শাহবাগ থানায় জিডি ও পরে মামলা এজাহারভুক্ত হওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা লিটনের বন্ধু আনিসের মোবাইল ফোনের কললিস্ট ধরে অনুসন্ধান করে দেখেছেন র্যাবের এক কর্মকর্তা এই মোবাইলটি একাধিকবার ব্যবহার করেছেন। মোবাইলের সেই আইএমই নম্বর পুলিশ এবং আমাদের কাছেও সংরক্ষিত আছে। র্যাবের ওই সদস্যের নাম-ঠিকানাও যথাযথ জায়গায় জানানো হয়েছে। কিন্তু তারপরেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অদ্যাবধি আমার ভাইয়ের খোঁজও মেলেনি।
নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে তোপখানা রোডের হোটেল নিউ ইয়র্কের ২০১১ সালের রেজিস্টার থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, আমিনুল ইসলাম লিটন নিজেই ২৯ অক্টোবর ২০১১ সালে হোটেলে উপস্থিত হয়ে ৩০৯ নং কক্ষ পাঁচ দিনের জন্য বুকিং দিয়ে রুমে উঠেন। রেজিস্টারে লিটন তার ঠিকানা ও তার ব্যবহৃত ব্যক্তিগত গাড়ি নম্বর (গ- ১১-৪১৮১) এন্ট্রি করেছেন। কিন্তু তিন দিন পরই রাতে হোটেল থেকে নিচে নেমে এসে আর হোটেলে ফিরে আসেননি।
এ দিকে আমিনুল ইসলাম লিটন নিখোঁজ বা গুম হওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে শাহবাগ থানায় জিডি (জিডি নং ১৫০ তাং ০৩/১১/২০১১ইং) এবং পরে যে মামলা (২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর পেনাল কোডের ৩৬৫ ধারায় একটি মামলাও রুজু করেন, মামলা নং ৪০) দায়ের করা হয়েছিল সে বিষয়ে নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে সর্বশেষ তথ্য জানতে শাহবাগ থানায় যোগাযোগ করা হলে প্রথমে জানানো হয়, অনেক দিনের পুরনো ঘটনা, তারা (শাহবাগ থানা) এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তবে মামলার তারিখ ও নম্বর নিয়ে মামলার নথির বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলে শাহবাগ থানার এস আই পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা রেকর্ড রুমে রক্ষিত পুরনো নথির সূত্র ধরে জানান, এই মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন (২০১১ সালে) এসআই হুমায়ুন কবির। তিনি বর্তমানে পোস্টিং নিয়ে মাদারীপুরে কর্মরত আছেন। মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছিল বলে ওই কর্মকর্তা মামলার রেকর্ড রুমের নথি সূত্রে জানান।
অন্য দিকে লিটনের গুমের বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে আবেদনের পর নতুন করে তদন্ত শুরু করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই।
লিটনের ছোট ভাই সাগর শেখ জানান, মামলাটি পিবিআইয়ের আলমগীর নামে এক কর্মকর্তা তদন্ত শুরু করছেন। নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে আলমগীরের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা