ভারত কি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে রাজি হবে?
- ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৬:০৭, আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৬:২৪

বাংলাদেশ শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে প্রয়োজনীয় সকল নথিপত্র পাঠিয়েছে এবং প্রয়োজনে একটি স্মারক জারি করতে প্রস্তুত। গত বছর ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাদেশের মৌখিকভাবে জানানো প্রত্যর্পণের অনুরোধের উত্তর ভারত এখনো দেয়নি। এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের অবস্থান সংযত রেখেছে এবং বারবার জিজ্ঞাসাবাদ সত্ত্বেও প্রাথমিক স্বীকৃতি ছাড়া আর কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রয়েছে।
প্রত্যর্পণের বিষয়ে ভারতের নীরব থাকাতে দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব। ভারত কি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে রাজি হবে? আন্তর্জাতিক অনলাইন নিউজ ম্যাগাজিন দ্য ডিপ্লোম্যাট প্রত্যর্পণের জটিল প্রক্রিয়া ও ভারতের ওপর এর প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনটি বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের আইনগত অধিকার থাকলেও, ভূ-রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক প্রভাব বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে।
ভারত যদি শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে সম্মত হয়, তাহলে ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির চিঠি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির কঠোর বাস্তবতার সাপেক্ষে প্রক্রিয়াটি একাধিক ধাপের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে।
শিক্ষাবিদ ও আইনবিদ ড. সঙ্গীতা তাক বলেন, ‘কারিগরি বিষয়গুলো মূলত প্রত্যর্পণ চুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও মানবাধিকারের বিষয়গুলো এটিকে অবিশ্বাস্যভাবে জটিল ও সংবেদনশীল করে তুলবে।’ তিনি পাঞ্জাবের রাজীব গান্ধী জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
সঙ্গীতা তাক জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণের অনুরোধ জমা দেয়ার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ অনুরোধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ থাকতে হবে এবং বিচারিক আদেশ, গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং অন্যান্য প্রমাণপত্রসহ সহায়ক নথির একটি শক্তিশালী সংগ্রহ থাকতে হবে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘অনুরোধে অবশ্যই এটা নিশ্চিত করতে হবে যে বাংলাদেশে বিচার সুষ্ঠু হবে এবং এটি পক্ষপাতদুষ্ট হবে না।’
অর্থাৎ কেবল অভিযুক্ত অপরাধের তালিকাভুক্তির পাশাপাশি অনুরোধে অবশ্যই এই নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনা হবে না। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যা ভারত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আগে যাচাই করবে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এ শর্ত পূরণ করেছে। কিন্তু এরপর কী হবে?
আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জমা দেয়ার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চুক্তির সমস্ত বাধ্যবাধকতা পূরণ হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা শুরু করবে।
সঙ্গীতা তাক ব্যাখ্যা করেন, ‘বাংলাদেশের সাথে ভারতের ইতোমধ্যেই একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। তাই ভারত সরকার চুক্তি অনুসারে প্রত্যর্পণ চুক্তিটি যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে কিনা তা পর্যালোচনা করবে এবং নিশ্চিত করবে।’
পর্যালোচনা প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো উভয় দেশেই আইনত ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত কিনা তা নির্ধারণ করা হবে। এটি দ্বৈত অপরাধ হিসেবে পরিচিত। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে এটিও পরীক্ষা করতে হবে যে কোনো অভিযোগ রাজনৈতিক, সামরিক বা ধর্মীয় অপরাধের জন্য ছাড়ের মধ্যে পড়ে কিনা। এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত যা শেষ পর্যন্ত প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার কারণ হতে পারে।
প্রাথমিক প্রশাসনিক পর্যালোচনা অনুকূল হলেও বিষয়টি এখানেই শেষ হবে না। প্রত্যর্পণের অনুরোধটি পরবর্তীতে ভারতে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার বিষয় হবে। সেখানে বিশেষায়িত প্রত্যর্পণ আদালতগুলো এর বৈধতা ও যোগ্যতা যাচাই করবে।
সঙ্গীতা তাক আরো বলেন, ‘ভারত প্রত্যর্পণের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনাও করবে। ভারতে প্রত্যর্পণের জন্য গঠিত বিশেষ আদালতগুলো প্রত্যর্পণের অনুরোধের বৈধতা ও যোগ্যতা পরীক্ষা করবে। যদি আদালত দেখে যে রাজনৈতিক মামলার বিশ্বাসযোগ্য হুমকি রয়েছে। তাহলে প্রত্যর্পণ আটকে দিতে পারে।’
রাজনৈতিক প্রতিশোধের জন্য প্রত্যর্পণ আইনের অপব্যবহার রোধ করার জন্য এই বিচারিক সুরক্ষা অপরিহার্য। এতে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের যেকোনো সিদ্ধান্ত আইনের শাসনের ভিত্তিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত বলে নিশ্চিত করা যাবে।
ভারতের আদালত ও নির্বাহী বিভাগ চূড়ান্তভাবে প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্ত নিলে পরবর্তী পদক্ষেপ হবে স্থানীয় পুলিশ অথবা কেন্দ্রীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা। গ্রেফতারের পর শেখ হাসিনাকে নিরাপদ স্থানে রাখা হবে, যতক্ষণ না তার প্রত্যর্পণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সঙ্গীতা তাক বলেন, ‘প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ধাপ হবে হাসিনাকে ভারতীয় হেফাজত থেকে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের কাছে সশরীরে হস্তান্তর করা। এ পর্যায়ে দুই সরকারের মধ্যে একটি সতর্কতার সাথে সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে সমস্ত আইনি ও কূটনৈতিক প্রোটোকল মেনে চলা হচ্ছে।’
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘যাচাই-বাছাইয়ের পর শেখ হাসিনাকে ভারতীয় হেফাজত থেকে বাংলাদেশীদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বা বিমানবন্দরে হস্তান্তর প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হতে পারে।’
তবে তিনি উল্লেখ করে বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শই কিছু নির্দিষ্ট সুরক্ষা ভোগ করেন, যা প্রত্যর্পণকে আরো জটিল করে তোলে।’
তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার সংস্থাগুলো হস্তক্ষেপ করতে পারে। তারা যুক্তি দিতে পারে যে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে অন্যায্য আচরণ বা সম্ভাব্য ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন, যা আন্তর্জাতিক আইনি চ্যালেঞ্জের দিকে নিয়ে যেতে পারে।’
এ ধরনের হস্তক্ষেপ প্রক্রিয়াটিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। এটি ভারতের ওপর মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, ‘শেখ হাসিনা নিজেও ভারতে আশ্রয় চাইতে পারেন। এটি তখন প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়াকে আরো জটিল করে তুলবে।’
এই আইনি জটিলতার বাইরেও শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ভারতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের দাবিতে রাজি হলে ভারতের সাথে অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে যেসব দেশ এটিকে সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে দেখে। ফলে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়টি অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে।
তবে সরাসরি প্রত্যাখ্যান আরো বেশি বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের ‘মনসুন আপরাইজিং’ প্রতিবেদনের কারণে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাদের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত।
প্রত্যর্পণের অনুরোধে রাজি হওয়া বা প্রত্যাখ্যান করা উভয়ই নয়াদিল্লির ওপর প্রভাব ফেলবে। ঠিক এই কারণেই শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের ব্যাপারে নীরব থাকা এবং অপেক্ষা করা ভারতের জন্য আপাতত সবচেয়ে সম্ভাব্য বিকল্প বলে মনে করা হচ্ছে।