ঐকমত্য কমিশনের যাত্রা শুরু হচ্ছে, কী অবস্থান নিচ্ছে বিএনপি ও অন্যান্য দল
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৮
সংস্কার প্রশ্নে চার্টার বা সনদ তৈরির লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সূচনা বৈঠকে আজ বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ ও জামায়াতে ইসলামীসহ বর্তমানে সক্রিয় সব দল ও জোটের নেতারা অংশ নিচ্ছেন। যদিও এই বৈঠককে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ শুরুর আনুষ্ঠানিকতা বলা হচ্ছে, কিন্তু এই বৈঠকেও নির্বাচন এবং এর রোডম্যাপের তাগিদ আসতে পারে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে।
নির্বাচনী ব্যবস্থা, সংবিধান, বিচারবিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম দফায় যে ছয়টি কমিশন গঠন করে, তারা তাদের সংস্কারের সুপারিশসহ প্রতিবেদন ইতোমধ্যে জমা দিয়েছে। এই ছয় কমিশনের প্রধানদের নিয়ে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক আজ শনিবার বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা সময় ধরে চলবে বলে আমন্ত্রিত রাজনৈতিক দলগুলোকে জানানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে অংশ নেয়ার জন্য দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ, ১৪ দলীয় জোট এবং এর মিত্র হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টিকে বাদ দিয়ে অন্য সব দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
প্রথম বৈঠকে আনুষ্ঠানিকতার পর এই কমিশন দল ও জোটগুলোর সাথে আলাদা আলাদা বৈঠক করে সংস্কারের সুপারিশের ব্যাপারে মতামত নেবে। দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে সংস্কারের জন্য একটি ন্যাশনাল চার্টার বা জাতীয় সনদ তৈরির জন্য কমিশনকে আগামী অগাস্ট মাস পর্যন্ত ছয় মাসের সময় দেয়া হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ছয় মাস সময় দেয়া হলেও এর আগেই দলগুলোর সাথে দফায় দফায় আলোচনা করে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা তাদের থাকবে।
ছাত্র নেতৃত্ব ও দলগুলোর অবস্থানে ফারাক
জাতীয় নির্বাচনের আগে ন্যূনতম সংস্কার নাকি সার্বিকভাবে সংস্কার করা হবে, এই প্রশ্নে এখনো বিতর্ক রয়েছে। যদিও বিএনপিসহ বেশিভাগ দল ন্যূনতম সংস্কার করে নির্বাচন চাইছে। জামায়াতে ইসলামীও এখন নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করার কথা বলছে।
কিন্তু নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের অনেকে সার্বিকভাবে সংস্কার শেষ করার পরই নির্বাচন করার কথা বলে আসছেন।
সংস্কার নিয়েও তাদের সাথে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের অবস্থানের ফারাক দেখা যাচ্ছে।
এই দুই সংগঠনের প্রভাব রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। ছাত্রদের তিনজন প্রতিনিধিও রয়েছেন এ সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে।
ফলে পুরো সংস্কার শেষ না করে নির্বাচন নয়, এই অবস্থানেই অটল থাকতে পারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
সংগঠন দুটির যুক্তি হচ্ছে, সংস্কার কাজ শেষ করা না হলে পুরোনো ধারাতেই রাজনীতি চলবে।
রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসে সংস্কার কতটা করবে, সেই প্রশ্ন বা সন্দেহ তাদের রয়েছে।
কিন্তু এই দুই সংগঠনের অবস্থান নিয়েই সন্দেহ রয়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের।
তারা মনে করছে, নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা কেন্দ্রিক কিছু লোকজন ছাড়া সাধারণ মানুষের সমর্থন সেভাবে দৃশ্যমান নয়।
এমন বাস্তবতায় নতুন দল গঠনের পর সেই দলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আনার কৌশলের অংশ হিসেবে নির্বাচন প্রলম্বিত করার চিন্তা থাকতে পারে।
আর এমন চিন্তা থেকেই নির্বাচনের আগে সার্বিকভাবে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে।
নির্বাচিত সরকার ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংশোধন করাসহ সার্বিকভাবে সংস্কারের এখতিয়ার নেই বলেও বিএনপিসহ বিভিন্ন দল বলে আসছে।
সরকার কী বিএনপির অবস্থান উপেক্ষা করতে পারবে
যদিও সরকারের কেউ কেউ মনে করেন, দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার অভিযোগ এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের মুখে থাকলেও সক্রিয় থাকা দলগুলো সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
এরপরও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারের বড় একটি শক্তি হিসেবে পাশে রয়েছে। সেজন্য তাদের প্রতি সরকারেরও সমর্থন থাকছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, ছাত্র নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের মূল শক্তি বা ভিত্তি যাই বলা হোক না কেন, দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির অবস্থান উপেক্ষা করা এ মুহূর্তে সরকারের জন্য বেশ কঠিন।
বিএনপি এবং সরকার, কোনো পক্ষই এখন নিজ নিজ স্বার্থে একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানে যেতে চায় না।
কারণ বিএনপির সহযোগিতা না করলে এ সরকারের জন্য নির্বাচন ও দেশ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে কোনো সঙ্কট হলে তাতে বিএনপিই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেজন্য সরকার ও ছাত্র নেতৃত্বের অনেক কর্মকাণ্ড পছন্দ না হলেও ধৈর্য্য ধরছে বিএনপি।
দলটি শেষপর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করে নির্বাচনমুখী কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে সরকারের একাধিক উপদেষ্টা বিবিসি বাংলার সাথে আলাপকালে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এখন দলগুলোর সাথে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় বা ন্যূনতম সংস্কার করা হবে। নির্বাচিত সরকারের জন্য রাখা সার্বিক সংস্কারের দায়িত্ব।
আর এমন চিন্তা থেকে প্রধান উপদেষ্টা এখন প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। সর্বশেষ দু’দিন আগে দুবাই সফরে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে ওই বক্তব্য দেন।
আবারো রোডম্যাপের তাগিদ কেন
সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য তৈরির জন্য গঠিত কমিশনের আজ প্রথম বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে কয়েকজন নেতা অংশ নেবেন।
মির্জা ফখরুল বিবিসি বাংলাকে বলেন, এই বৈঠকেও তারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাগ ঘোষণার তাগিদ দেবেন। ন্যূনতম সংস্কারের ব্যাপারে আলোচনা চলবে। কিন্তু এখন দেশকে নির্বাচনমুখী করতে রোডম্যাপ প্রয়োজন।
বিএনপিসহ বিভিন্ন দল দ্রুত নির্বাচন দাবি করে আসছে। সম্প্রতি ঢাকায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
এই 'অরাজকতা বা নৈরাজ্যকর' পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সেই পটভূমিতে গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করে ভবিষ্যতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এড়াতে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দেন বিএনপি নেতারা।
সেদিনের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি নেতাদের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারে আশ্বাস দেন। আর ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য দিতে পারেন, এমনটাও বিএনপি নেতাদের জানানো হয়েছিল।
আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক যেহেতু হচ্ছে, সেখানে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য দেয়া হবে, দলগুলো এমন আশা করছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা না করার প্রশ্নে পুরোনো মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপির দূরত্ব আরো বেড়েছে।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন চায় না।
তবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান। আজকে বৈঠকে তারা তাদের এই অবস্থান তুলে ধরবেন।
ফলে সংস্কারের জন্য ঐকমত্য তৈরির বৈঠক হলেও দলগুলোর কথায় রোডম্যাপ ও নির্বাচনের বিষয়ই প্রধান্য পাবে।
সংস্কার সনদ তৈরি করা কি সম্ভব হবে?
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একাধিক সূত্র বলছে, নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম সংস্কার ও দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কার, এই দুই ভাগে ভাগ করে দলগুলোর সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখা হবে।
নির্বাচনের আগে কোন কোন বিষয়ে ন্যূনতম সংস্কার করতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা ঠিক করে বাস্তবায়ন করা হবে।
আর দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কারের বিষয়গুলোও একইভাবে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা হবে। নির্বাচিত সরকার এসে তা বাস্তবায়ন করবে।
নির্বাচিত সরকার এলে সংস্কারের জায়গা থেকে যাতে সরে না যায়, সেজন্য দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে চার্টার বা সনদ তৈরির চেষ্টা থাকবে। যেখানে থাকবে সব দলসহ অংশীজনদের সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার।
যদিও ঐকমত্য কমিশন বলছে, নির্ধারিত ছয় মাস সময়ের আগেই তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে।
কিন্তু সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের যত সুপারিশ এসেছে, তার অনেক ক্ষেত্রেই দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য আছে। সেখানে ঐকমত্যে ভিত্তি সংস্কারের জাতীয় সনদ বা চার্টার তৈরি করা কতটা সম্ভব হবে, এ নিয়ে সন্দেহ আছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
লেখক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, সংস্কার কিছু করতে হবে দলগুলোর ওপরও সেই তাগিদ আছে। দলগুলোও তা স্বীকার করে। এরপরও সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য তৈরির ক্ষেত্রে দলগুলো কতটা সহযোগিতা করবে, সেই প্রশ্ন থাকছে।
সূত্র : বিবিসি