০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৫ মাঘ ১৪৩১, ৮ শাবান ১৪৪৬
`

দেশের চলমান পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করবে বিএনপি

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠকে এমন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে - ছবি : নয়া দিগন্ত

সম্প্রতি দেশজুড়ে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। একইসাথে দেশজুড়ে ভাংচুরের এই পরিস্থিতি সমর্থন না করে বরং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রলম্বিত করার চক্রান্ত হিসেবে দেখছে দলটি। এই ইস্যুতে আগামী সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করে নিজেদের উদ্বেগ ও অবস্থান তুলে ধরবে বিএনপি।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠকে এমন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়।

নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির ঘটনার পেছনে দেশবিরোধী চক্রান্তকারীদের উস্কানি থাকতে পারে। তবে বিএনপি কাউকে সরাসরি দোষারোপ করবে না। এই ইস্যুতে কোনো কর্মসূচিও দেবে না। কিন্তু বিষয়টিকে যে তারা সমর্থন করে না, সেটি বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরবে দলটি।

বৈঠকে বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের ছয় মাস পরে এসে এই ধরনের ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তার দায় অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বর্তায়। কারণ, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তাই সরকারকেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির প্রসার ঘটবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ সারা দেশে ভাংচুরের ঘটনা, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি দেশজুড়ে সংঘটিত ভাংচুরের ঘটনাগুলোকে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে প্রলম্বিত করার এক ধরনের ফাঁদ হিসেবে মনে করছেন তারা। তাই নেতাকর্মীদের কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা-হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জড়িত না হওয়ার জরুরি নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি। ইতোমধ্যে কেন্দ্র থেকে এমন নির্দেশনা তৃণমূলে দেয়া হয়েছে।

নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো বিরোধী পক্ষের বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, ম্যুরাল ভাংচুরসহ কোনো হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে দলীয় নেতাকর্মীরা যেন কোনো প্রকার জড়িত না হয়। আমাদের প্রত্যাশা, দেশ এবং দলের বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিটি নেতাকর্মীকে কঠোরভাবে এই নির্দেশনা পালন করতে বলা হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দেশবাসীসহ দলের নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানাই। শেখ হাসিনার কোনো উস্কানিতে পা দেয়া যাবে না। চারদিকে ষড়যন্ত্র চলছে। এখন সতর্ক থাকতে হবে। দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। কোনো উসকানিতে কেউ যেন নৈরাজ্য সৃষ্টি না করে সেই আহ্বান জানাচ্ছি আমরা।’

স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘চারদিকে অরাজকতা চলছে। শুধু বিএনপি কেন গণতান্ত্রিক কোনো শক্তি এসব অরাজকতা পছন্দ করে না। সাম্প্রতিক ভাংচুরের কর্মকাণ্ড দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। হঠাৎ করে কেন এই অরাজকতা? এর পেছনে নিশ্চয়ই বড় কোনো অপশক্তি কাজ করছে। বিএনপি এসব প্রশ্রয় দেবে না।’

স্থায়ী কমিটির বৈঠকে একজন সদস্য বলেন, ‘একটি দেশে গণঅভ্যুত্থানের পরপরই নানা ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু এত দিন পরে এসে কেন হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটবে। তাহলে কি দেশ অস্থিতিশীল থাকবে? এর পেছনে কারণ খুঁজে বের করতে হবে।’

তখন আলোচনায় অংশ নিয়ে দু’জন সদস্য বলেন, ‘এসব অরাজকতার মূল টার্গেট সেই বিএনপি, সেই নির্বাচন। একটি রাজনৈতিক দলের ইন্ধনে ছাত্ররা তাদের শক্তি প্রদর্শন করছে। উদ্দেশ্য নির্বাচনকে প্রলম্বিত করা, যাতে দ্রুত সময়ে রোডম্যাপ ঘোষণা না করা হয়। কারণ, ছাত্ররা নতুন দল গঠন করে সারা দেশে সংগঠনকে সুসংহত করার জন্য যথেষ্ট সময় চায়। অন্যদিকে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। নির্বাচন দিতে দেশী-বিদেশী চাপও বাড়ছে। তাই বিএনপি মনে করে, এমন অবস্থায় নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেশজুড়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাছাড়া ভাংচুরের ঘটনায় সময় বিএনপিকে টেনে উত্তেজিত যুবকদের বক্তব্যেও উস্কানি দেখছে বিএনপি।’

বৈঠকে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির প্রতিবাদে ও শিগগিরই নির্বাচন দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েও আলোচনা হয়। এর মধ্যে আছে বিভাগীয় সমাবেশ ও জেলায় সমাবেশ। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘আমরা মনে করছি, কিছু রাজনৈতিক দল এসব ঘটনায় পরোক্ষভাবে মদদ দিচ্ছে। উস্কানি দিয়ে পরিস্থিতি বেগতিক করছে। যাতে নির্বাচন প্রলম্বিত হয়। দেশের বাইরে থেকে কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টও এতে জড়িত। তারা আসলে কি চায় বোঝা মুশকিল। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কয়েকজন উস্কানিদাতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে। বিএনপি পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।’

এ দিন সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস (অনলাইনে), গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (অনলাইনে), আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী (অনলাইনে), সালাহউদ্দিন আহমদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু (অনলাইনে), হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, এ জেড এম জাহিদ হোসেন (অনলাইনে)।

‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা দৃশ্যমান করুন’

দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এক বিবৃতিতে দলটি বলেছে, এর ব্যত্যয় হলে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির প্রসার ঘটবে। কঠোরভাবে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা দৃশ্যমান করা এখন সময়ের দাবি।

বিএনপির বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা প্রকাশ করতে না পারলে রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে উগ্র নৈরাজ্যবাদী গণতন্ত্রবিরোধী দেশী-বিদেশী অপশক্তির পাশাপাশি পরাজিত ফ্যাসিস্টদের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে, যার উপসর্গ ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান।

বিবৃতিতে বিএনপি বলে, এখনো প্রশাসনকে পতিত ফ্যাসিস্ট শাসকের দোসরমুক্ত করা হয়নি, বিচার বিভাগে কর্মরত ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনো বিদ্যমান, পুলিশ প্রশাসনে গণঅভ্যুত্থানবিরোধী সক্রিয় সদস্যরা এখনো কর্মরত। এমতাবস্থায় সরকার জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে সফলতা অর্জন করতে পারবে কি না, তা যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে।

এতে আরো বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার গত ছয় মাসেও পলাতক স্বৈরাচার ও তাদের দোসরদের আইনের আওতায় আনতে কার্যকর পদক্ষেপ জনসম্মুখে দৃশ্যমান করতে সফল হয়নি। ফলে জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার মতো বেআইনি কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হচ্ছে। একটি সরকার বহাল থাকা অবস্থায়, জনগণ এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নিলে দেশ-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নানান ধরনের দাবি-দাওয়া নিয়ে যখন-তখন সড়কে ‘মব কালচারের’ মাধ্যমে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করছে। যা সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে মুনশিয়ানা দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল