বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের সঙ্কট
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৪
গণঅভ্যুত্থানের ফলে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে, সরকার এবং তার সমর্থকরা আশা করছেন যে এই ভোট কেবল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে না বরং পনের বছরের ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী ও দমনমূলক শাসনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।
রাষ্ট্রযন্ত্রের বেশিভাগ অংশ তাদের দলীয় নিয়ন্ত্রণে রাখা আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গেছে। ফলে সাংবিধানিক, নির্বাচনী, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু হাসিনার পতনের পরপরই অন্তর্বর্তী সরকার যে বিপুল সমর্থন পেয়েছিল তা ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করেছে এবং ড. ইউনূস এখন সুনির্দিষ্ট ফলাফল প্রদানের জন্য চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। তার সরকার কেবল অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সাথে বিরোধ নিয়ন্ত্রণ করতেই লড়াই করছে না, বরং তার দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা নিয়ে জনসাধারণের সমালোচনারও মুখোমুখি হচ্ছে। আগামী বছরে অন্তর্বর্তী সরকার আরো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। কারণ বিরোধী দল, ছাত্রনেতা, ইসলামপন্থী গোষ্ঠী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা নির্বাচনী সুবিধার জন্য লড়াই করছে। শেষ অবধি হাসিনার শাসনকে দৃঢ়ভাবে সমর্থনকারী বাংলাদেশের বিশাল প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে তার টানাপোড়েন স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আরো একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে পরিচালনা করার পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের সীমান্তে অস্থিতিশীলতা মোকাবেলার দায়িত্বও বহন করছে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো থাকা সত্ত্বেও, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে (ইইউ) বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণকে সমর্থন করার এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের একটি অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারের সাথে তার অবস্থান উন্নত করার একটি বিরল সুযোগ প্রদান করে।
বাংলাদেশকে সমর্থন করার জন্য ইইউ এবং এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উচিত উচ্চস্তরের সফরের আয়োজন করা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের প্রতি সমর্থন জোরদার করা। যাতে ইউনূস প্রশাসনের ভাবমূর্তি জনসাধারণের কাছে অভ্যন্তরীণভাবে উজ্জ্বল হয় এবং এর অ্যাজেন্ডাকে দুর্বল করার চেষ্টাকারী শক্তিগুলোকে দুর্বল করা। একইসাথে ইইউর উচিত একটি নতুন অংশীদারিত্ব এবং সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া।
অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, শাসনব্যবস্থা উন্নত করা এবং মানবাধিকার রক্ষা করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা করার জন্য ইইউ উপযুক্ত অবস্থানে রয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য একটি নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশনও পাঠানো উচিত।
আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইউরোপের প্রভাব ব্যবহার করে বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা সংগ্রহ করে জাতীয় অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে অবদান রাখা। অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরো আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করা। পোশাক উৎপাদন ছাড়াও অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পদ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করা এবং ২০২৯ সালের পরেও ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার সম্প্রসারণের জন্য ঢাকার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া।
ভারতকে নীরবে উৎসাহিত করার মাধ্যমে ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে উত্তেজনা কমাতে কাজ করা। ২০২৫ সালে ইইউ যে উচ্চস্তরের যোগাযোগের পরিকল্পনা করছে, তা বাংলাদেশের সংস্কারের প্রতি আরো সমর্থন জানানো। অবিশ্বাস কাটিয়ে উঠতে ও সম্পর্ককে আরো ভালো করতে ইইউর উভয়পক্ষের ওপর তার প্রভাব ব্যবহার করা উচিত।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের জন্য তহবিল বজায় রাখা, যাতে শরণার্থী ও স্থানীয় সম্প্রদায় উভয়কেই সহায়তা করা যায়। একইসাথে রোহিঙ্গা সঙ্কটের ওপর জাতিসঙ্ঘের একটি উচ্চস্তরের সম্মেলনের জন্য ঢাকা যে তদবির করেছে তাতে সহায়তা প্রদান করা এবং মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে আরাকান সেনাবাহিনীর সাথে জড়িত থাকার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎসাহিত করা।
সংস্কারের জন্য একটি সম্ভাবনা
আগস্টের শুরুর দিকে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন ঘেরাও করলে, তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। এর মাত্র এক মাস আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন শুরুর মাধ্যমে বিক্ষোভ শুরু হয়। সে সময় অস্থিরতা দমনে হাসিনার নৃশংস প্রচেষ্টা বিপরীতমুখী হয়। তার শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষের মধ্যে কোটার জন্য শুরু হওয়া বিক্ষোভ একটি গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়, যা তাকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। তার পতন বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হলেও দেশের বিতর্কিত ও প্রায়শই সহিংস রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে তা ছিলো অনিশ্চয়তায় মোড়া। অবশেষে সেনাবাহিনী, ছাত্র নেতা ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একটি চুক্তিতে ড. ইউনূসকে ছাত্র ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্বদের পাশাপাশি সাবেক আমলা এবং জেনারেলদের সমন্বয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
দেশে এবং বিদেশে ড. ইউনূসের প্রতি যে শ্রদ্ধা রয়েছে তা অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠা, উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য সমর্থন সংগ্রহ ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ঐকমত্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির সাথে যে উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল তা ড. ইউনূসের প্রশাসনের শুরুতে ব্যাপক সমর্থনে রূপান্তরিত হলেও, সেই উচ্ছ্বাসে এখন কিছুটা ভাটা পড়েছে । কেবল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সংস্কারগুলোই নয়, বরং দৈনন্দিন শাসনব্যবস্থার উন্নতির জন্যও সরকারের ওপর জনগণের চাপ বেড়েছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নতুন জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচী নির্ধারণ। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশকে তার সংবিধান অনুসারে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ডিসেম্বর থেকে দেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) অন্তর্বর্তী প্রশাসনকে ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে রেখেছিল। ড. ইউনূস ১৬ ডিসেম্বরে বলেছিলেন যে ভোট ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে, অর্থাৎ তার প্রশাসন দুই বছরেরও কম সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকবে। ভোটের দিনটি খুব দূরে হলেও, বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল (যেমন জামায়াতে ইসলামী) এবং ছাত্র নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা এখন একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা নিশ্চিত করেছে।
তারিখ ছাড়াও নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের অনেক বিবরণ অনিশ্চিত রয়ে গেছে। উচ্চাভিলাষী সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ড. ইউনূস এক ডজনেরও বেশি কমিশন গঠন করেছেন, যার মধ্যে একটির দায়িত্ব সংবিধান সংশোধন করা এবং অন্যটি নির্বাচনী ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা। এই কমিশনগুলোর মধ্যে চারটি কমিশন জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে রিপোর্ট দেয় এবং ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারের প্রস্তাব দেয়। ড. ইউনূস নিজেই আরেকটি কমিশনের নেতৃত্ব দেন যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির সাথে আলোচনা করবে যে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর মধ্যে কোনটি এগিয়ে নেয়া উচিত এবং কোনটি বাতিল করা উচিত বা ভবিষ্যত সরকারের কাছে ছেড়ে দেয়া উচিত। এই প্রক্রিয়া সফল করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ঐকমত্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক টানাপোড়েনের বাইরেও অন্তর্বর্তী সরকার অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। হাসিনার সরকারের প্রতি অসন্তোষের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ব্যাপক দুর্নীতি এবং তার সমর্থকদের আর্থিক খাত লুটপাটের মাধ্যমে অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা। একটি সরকারি তদন্তের তথ্য মতে, কমপক্ষে দশটি ব্যাংক ’প্রকৃতপক্ষে দেউলিয়া’ হয়ে পড়েছে। ড. ইউনূস যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছিল এবং খাদ্যের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৫ শতাংশে ছিল। নীতি নির্ধারণের উন্নতি ও আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়গুলোতে দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগসহ তার পদক্ষেপগুলো অর্থনৈতিক সঙ্কট এড়াতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি যে অনিশ্চয়তা বপন করেছে তার কারণে অর্থনীতি এখনো উঠে দাঁড়াতে পারেনি। বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য খাতে, ক্রমাগত বাড়ছে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ব্যাপক সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আশা করছে যে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দ্রুত ফিরে আসবে এবং মুদ্রাস্ফীতি অর্ধেক হয়ে যাবে। তবে একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্র মোকাবেলা করার জন্য এবং নতুন খাতে বৈচিত্র্য আনার জন্য সংস্কারের প্রয়োজন হবে। বিপরীতে বাংলাদেশের তরুণ, ক্রমবর্ধমান সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থতা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অস্থিরতার বীজ বপনের ঝুঁকি তৈরি করে।
বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং প্রতিবেশী উত্তেজনা
ড. ইউনূসের ‘নতুন বাংলাদেশ’ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছে - বিশেষ করে হিন্দুরা, যারা জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ইসলামপন্থী শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে উৎসাহিত না করলেও, তা উপেক্ষা করার অভিযোগও রয়েছে। তবে এই অভিযোগগুলোর বেশিভাগই আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে আসা ভারত থেকে এসেছে। তবে অভিযোগগুলো যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেরও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সেখানকার সমালোচকরা দাবি করেছেন যে বাংলাদেশ ‘তালেবান-নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের মতো অস্থিরতার দিকে ঝুঁকছে।’
হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর প্রথম কয়েকদিনে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, যখন পুলিশ তাদের দায়িত্ব থেকে সরে গিয়েছিল। কিন্তু বেশিভাগ ভুক্তভোগী তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে বরং পূর্ববর্তী সরকারের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে আক্রমণের শিকার হয়েছেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বিরোধীরা এই ঘটনার মাত্রা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। একটি মানবাধিকার গোষ্ঠী ২০২৪ সালে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ১২৭টি সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে - যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, কিন্তু ২০২১ সালে রেকর্ড করা সংখ্যার চেয়ে কম। একইভাবে বিদ্রোহের পিছনে ইসলামপন্থী শক্তির হাত ছিল এবং এখন সরকারের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করছে এমন অভিযোগও বিভ্রান্তিকর। ইসলামোফোবিয়াকে কাজে লাগিয়ে ঢাকার প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন দুর্বল করার জন্যই তারা এটি তৈরি করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই আক্রমণাত্মক ধারার বেশিভাগ দায় ভারতের মিডিয়া ও রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি শক্তিশালী হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রবাসী গোষ্ঠীগুলোর, যারা এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রচারণার শেষ সপ্তাহে একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিষয়টি উল্লেখ করতে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিল।
এই অভিযোগের উৎস ও ধরণ ভারতের সাথে সম্পর্ক পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকারের অসুবিধাগুলোকেই তুলে ধরে। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থন বাংলাদেশীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছিল। বিপ্লবের পর থেকেই ভারত ড. ইউনূসের সরকারকে দুর্বল করে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে এমন ধারণা থেকে ভারত-বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কেবল হাসিনাকে আশ্রয় দেয়নি, বরং বাংলাদেশীদের ভিসা পাওয়াও কঠিন করে তুলেছে এবং সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় অধিকার নিয়ে নিয়মিত ঢাকার সমালোচনা করেছে। ভারতের অন্যতম বৃহৎ সংগঠন আদানি গ্রুপ, যার প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, মূলত হাসিনার অধীনে জমা হওয়া ঋণ পরিশোধ না করার কারণে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানি কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতি আরো বেড়েছে। সীমান্ত বেড়া নিয়ে বিরোধ কেবল উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
ঢাকা আঞ্চলিক পরাশক্তিকে বিচ্ছিন্ন করার সামর্থ্য রাখে না। কারণ এটি এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার। তবে ঢাকা অভ্যন্তরীণ জনমতকেও উপেক্ষা করতে পারে না এবং কিছু ক্ষেত্রে, এটি নয়াদিল্লির আচরণের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সেপ্টেম্বরে, পূজার আগে ইলিশ মাছের রফতানি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এছাড়াও ভারতের উত্তর-পূর্বে ইন্টারনেট সংযোগ উন্নত করার জন্য একটি প্রকল্প বাতিল করে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের চেষ্টাকারী বাংলাদেশীদের হত্যা করার বিষয়টিও তুলে ধরে ঢাকা, যা হাসিনা সরকার উপেক্ষা করে গেছে।
বাংলাদেশের আরেকটি আন্তর্জাতিক সীমান্ত মিয়ানমারে অবস্থা আরো অস্থির। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে সহিংসতা তীব্র আকার ধারণ করেছে। পশ্চিম মিয়ানমার বেশ কয়েক বছর ধরে সহিংসতার মধ্যে রয়েছে। বৌদ্ধ রাখাইন জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী একটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ধীরে ধীরে রাখাইন রাজ্যের প্রায় পুরো এলাকা থেকে সামরিক শাসনকে বিতাড়িত করছে। ডিসেম্বরে মংডু শহর দখলের পর এই গোষ্ঠীটি এখন বাংলাদেশের সাথে সমগ্র সীমান্ত এবং ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে প্রায় সাত লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম যে সমস্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল সে সমস্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও ঢাকা জোর দিয়ে বলেছে যে তারা যে লাখেরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে তাদের প্রত্যাবাসন এগিয়ে নেয়া উচিত। তবে তারা আরাকান আর্মির সাথে সরাসরি কথা বলতে অনিচ্ছুক। কারণ এটি রাষ্ট্রীয় গোষ্ঠী নয়। এদিকে, শরণার্থীদের কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ ঢাকার নীতিগুলো বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি করেছে এবং রোহিঙ্গা সঙ্কটের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল হ্রাসের পরিবেশের জন্য উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে না।
ইইউর কী করা উচিত
হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সামনে তার জাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং এটিকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জবাবদিহিমূলক করার একটি বিরল সুযোগ এসেছে। এই সংস্কারের সাফল্যের জন্য প্রযুক্তিগত ও আর্থিক দিক দিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে এবং এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার জন্য ইইউর যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত। ইউনূস প্রশাসনের সংস্কার অ্যাজেন্ডার প্রতি জনসমর্থনের প্রকাশের মাধ্যমে একটি ইতিবাচক সূচনা হতে পারে, যার মধ্যে বাংলাদেশ ও ইউরোপ উভয় স্থানে উচ্চ পর্যায়ের সফর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ইইউর উচিত একটি নতুন অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, যা জুলাই মাসে সহিংসতার তীব্রতার সময় স্থগিত করা হয়েছিল কিন্তু নভেম্বরে পুনরায় শুরু হয়েছিল। আগামী মাসগুলোতে এ ধরনের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হবে কারণ অন্তর্বর্তী সরকার ফলাফল প্রদানের জন্য ক্রমবর্ধমান চাপের সম্মুখীন হচ্ছে এবং এর বিরোধীরা সংস্কার অ্যাজেন্ডাকে লাইনচ্যুত করার বা আগাম নির্বাচনের জন্য চাপ দেয়ার চেষ্টা করছে।
ইইউ ইতোমধ্যেই বিক্ষোভ আন্দোলন ও হাসিনার সরকারের পতনের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রোধে বেশ কয়েকটি স্বল্পমেয়াদী প্রকল্পে সমর্থন জানিয়েছে। এর মধ্যে নাগরিক সমাজের প্রতি সমর্থনও রয়েছে। ব্রাসেলসের নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা জোরদার করার লক্ষ্যে সংস্কারের জন্য সমর্থন প্রদানের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো দমনমূলক আইন সংশোধনের মাধ্যমে মানবাধিকার জোরদার করার প্রচেষ্টাও করা উচিত। ব্রাসেলস ও ইউরোপীয় রাজধানীগুলো যখন তাদের সহায়তা প্রদান করে, তখন তাদের ‘টিম ইউরোপ’ পদ্ধতিতে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা উচিত। ইইউ ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর যৌথ প্রচেষ্টায় যাতে একসাথে আরো ভালভাবে কাজ করা যায় এবং সম্পদ ও দক্ষতা একত্রিত করা যায়। পাশাপাশি অন্যান্য দাতাদের সাথেও ওভারল্যাপ এড়ানো যায় এবং সরকারের সীমিত মানব ও প্রশাসনিক সম্পদ প্রসারিত করা থেকে বিরত থাকা যায়।
বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে ইইউ জাতীয় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ও উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে অগ্রগতি অর্জন করেছে, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে। তবুও এটি এখনো অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে পারে, বিশেষ করে এর নিম্ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং পোশাক রফতানির ওপর নির্ভরতা (যা দেশের মোট রফতানির ৮০ শতাংশেরও বেশি) বিবেচনা করে। ইইউ বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতে পারে। প্রথমত, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অতিরিক্ত সহায়তা সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার প্রভাব ব্যবহার করা উচিত। দ্বিতীয়ত, এটি বিদেশী বিনিয়োগের জন্য আরো আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা উন্নত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শুল্ক ব্যবস্থা ও আইনি কাঠামোর সংস্কারের পাশাপাশি পোশাক উৎপাদন ছাড়াও অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে। ইইউ সমর্থিত সাম্প্রতিকতম ব্যবসায়িক উদ্যোগ, একটি স্থানীয় ইউরোচ্যাম চালু করা, ইইউর গ্লোবাল গেটওয়ের অধীনে আরো প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী অবকাঠামোতে বিনিয়োগের একটি উদ্যোগ। তৃতীয়ত, এটি ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ প্রকল্পের মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলোতে নিরাপদ ও বৈধ অভিবাসনের পথ সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করতে পারে। পরিশেষে, ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উচিত হাসিনা সরকারের অংশ বা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের অবৈধভাবে অর্জিত অসংখ্য সম্পদ পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করা। এই সম্পদের অনেকগুলো ইউরোপে রয়েছে।
পরিশেষে, ইইউ ও এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উচিত রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কটের মানবিক প্রতিক্রিয়ার জন্য তাদের সমর্থন বজায় রাখার চেষ্টা করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক তহবিল হ্রাস পাচ্ছে, জাতিসঙ্ঘের ২০২৪ সালের প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনায় মাত্র ৫৬ শতাংশ অর্থায়ন করা হয়েছে। যদিও ইইউ বৃহত্তম দাতাদের মধ্যে একটি, তবে কিছু ইউরোপীয় দেশ সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন সাহায্য বাজেট কমিয়ে দেবে এমন প্রবল সম্ভাবনার কারণে এই প্রবণতা আরো তীব্র হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যার ফলে ইউরোপীয় তহবিল আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর পুনর্বাসনের জন্য গ্রহণ করা শরণার্থীর সংখ্যা হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইইউর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উচিত আরো রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের জন্য প্রচেষ্টা করা।
তবে সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিশাল অংশ অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ বাংলাদেশের বিস্তৃত শিবিরে থেকে যাবে এবং যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সীমান্ত পেরিয়ে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করায় মিয়ানমার থেকে আরো বেশি লোক সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে। ইইউর উচিত ঢাকার সাথে কাজ করে এমন নীতি গ্রহণ করা যা শরণার্থীদের স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি করে এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা প্রদানের খরচ কমিয়ে আনে। ২০২৫ সালের শেষের দিকে একটি উচ্চ-স্তরের রোহিঙ্গা সম্মেলন আয়োজনের জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে এবং ঢাকাকে আরাকান সেনাবাহিনীর সাথে তার সম্পৃক্ততা বাড়াতে উৎসাহিত করে, যা এখন যেকোনো প্রত্যাবাসন পরিকল্পনার জন্য একটি অনিবার্য মধ্যস্থতাকারী।
সূত্র : ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আর্কাইভ)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা