৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১, ২৯ রজব ১৪৪৬
`

নেতৃত্ব সঙ্কটে আওয়ামী লীগ, ভেঙে যেতে পারে দল

-

আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে ভাবমূর্তি ও নেতৃত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি। এ অবস্থায় শেখ হাসিনা ছাড়া দল পুনর্গঠন চ্যালেঞ্জিং। এমনকি আওয়ামী লীগ ভেঙে অন্য দল গঠন হতে পারে।

সোমবার (২৭ জানুয়ারি) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেছেন, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ ও নেতৃত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ বিভাজন দেখা দিতে পারে।

তিনি বলেন, হাসিনা নির্বাসন বা প্রত্যাবর্তনের সাথে অপরিচিত নন। তবে এবারের প্রত্যাবর্তন অনেক কঠিন হয়ে যাবে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের বেশিভাগ সদস্যকে হত্যার পর, তার মেয়ে শেখ হাসিনা বেশ কয়েক বছর ভারতে ছিলেন।

এরপর ১৯৮১ সালে তিনি আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বাংলাদেশে ফিরে আসেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নিহতের পর দল পুনর্গঠন করতে এবং ক্ষমতায় ফিরে আসতে তার সময় লেগেছিল ২১ বছর।

হাসানুজ্জামান বলেন, তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন; সেনাসমর্থিত রক্তাক্ত ছাত্র-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এতে তার ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়।

তিনি বলেন, দেশের অন্য দুটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও জামায়াত, উভয়ই বলেছে যে তারা চায় গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতা হত্যার সাথে জড়িত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক। তারা এ যুক্তিও দিয়েছে যে আওয়ামী লীগের ভাগ্য দেশের জনগণই নির্ধারণ করবে।

তবে, হাসিনাকে অপসারণের প্রচারণার নেতৃত্বদানকারী ছাত্র আন্দোলন আওয়ামী লীগের বিষয়ে আপসহীন অবস্থান নিয়েছে।

২৫ জানুয়ারি এক পথসভায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাহফুজ আলমের কথায় বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যায়।

উপদেষ্টা মাহফুজ বলেন, আওয়ামী লীগকে পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে না। ২০২৬ সালের প্রথম দিকে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস।

উপদেষ্টা মাহফুজ আরো বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো সংস্কার বাস্তবায়নের পাশাপাশি খুন, গুম ও ধর্ষণের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করা। একইসাথে বাংলাদেশপন্থী সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা।’

এ বিষয়ে হাসানুজ্জামান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দৃষ্টিকোণ থেকে এ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, তাহলে দলটির রাজনীতিতে ফিরে আসার একটি ভিত্তি তৈরি করবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘তবে নেতৃত্ব, সংগঠন ও তৃণমূল পর্যায়ের সংযোগের মাধ্যমে জনসাধারণের আস্থা পুনর্নির্মাণ করতে না পারলে আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন খুবই কঠিন।’

প্রফেসর হাসানুজ্জামান যুক্তি দেন যে দলটির কঠোর অবস্থান এবং সিদ্ধান্ত জনগণকে ক্ষুব্ধ হতে উৎসাহিত করেছে। এর মধ্যদিয়ে গণ-অভ্যুত্থানকে সফল হওয়ার পথ করে দেয়া হয়েছে। ধর্মীয় পদক্ষেপগুলো শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তায় আঘাত করেছে, যার ফলে একক দাবিতে পরিণত হয় তার পদত্যাগ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ আওয়ামী লীগকে সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনের যেকোনো সম্ভাবনার জন্য চারটি শর্ত তুলে ধরেছেন। যে শর্তগুলো পূরণ করতে পারলেই দলটির প্রত্যাবর্তন সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

তার তুলে ধরা শর্তগুলো হলো- ১৬ বছরের ক্ষমতায় থাকাকালীন সংঘটিত অপরাধের জন্য, বিশেষ করে ২০২৪ সালের বিদ্রোহের জন্য, স্পষ্টতই ক্ষমা চাওয়া; বর্তমান আদর্শ ত্যাগ করা; হাসিনার পরিবারের কোনো সদস্য যাতে আবার দলকে নেতৃত্ব না দেয় তা নিশ্চিত করা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধসহ জঘন্য অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি করা।

আলী রীয়াজ আল জাজিরাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনাসহ জুলাই আন্দোলনের সময় নৃশংসতার জন্য সরাসরি দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এই শর্তগুললো পূরণ হলেই তাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে যেকোনো আলোচনা হতে পারে।’

ইউনূসের নেতৃত্বাধীন একটি সরকারি কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যানেরও দায়িত্বে রয়েছেন আলী রীয়াজ। তাকে প্রস্তাবিত সংস্কারের একটি ধারাবাহিক বিষয়ে ঐক্যমত্য তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

তবে এটাও সত্য, অনেক আওয়ামী লীগ কর্মী হাসিনার প্রতি বিশ্বাস রাখেন, যদিও তারা মাঝে মাঝে ব্যক্তিগতভাবে তার পরিবারের ক্ষমতার অপব্যবহারের সমালোচনা করেন।

এদিকে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিদেশে বসে সামাজিক মাধ্যম ও টক শো’তে নেতা-কর্মীদের পুনর্গঠিত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন এবং ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ‘ব্যর্থ হতে চলেছে’ বলে তারা মনে করছেন।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, দলীয় কর্মীদের পুনর্গঠিত হওয়া খুবই কঠিন। কারণ নির্বাসিত নেতাদের জন্য বিদেশে বসে কথা বলা সহজ কিন্তু দেশের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এবং লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে।

মাঠের চিত্র হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনেকেই প্রকাশ্যে তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে খুব ভয় পান। রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন তো অনেক দূরের কথা।

আল-জাজিরায় প্রকাশিত ‘আফটার দ্য ব্লাডশেড : ক্যান বাংলাদেশ’জ আওয়ামী লীগ রিসারেক্ট ইটসেল্ফ?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, যখন ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে রংপুরে নিহত হন আবু সাঈদ, তখনো আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ঠান্ডা মেজাজে আরাম করছিলেন।

তাদের কাউকে কাউকে তার অফিসে কোনো স্থানীয় কবি কবিতা পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন। আবৃত্তি শেষে তিনি বলে ওঠেন, ‘ওয়ান্ডারফুল’। এর কিছু সময় পরে আবু সাঈদ হত্যার তথ্য কোনো এক সহযোগী একজন নেতাকে জানান। কিন্তু তিনি তা উড়িয়ে দেন। বলেন- ওহ, কিছুই হবে না। নেতা (হাসিনা) সব কিছু ঠিক করে ফেলবেন।

এর মধ্যদিয়েই প্রকাশ পেয়ে যায় ওই সময় আওয়ামী লীগের উপরিমহলের মনোভাব। অর্থাৎ মাঠপর্যায়ে কী হচ্ছে, তা তারা মোটেও আমলে নেননি।

এর তিন সপ্তাহেরও কম সময় পরেই নৃশংসতা চালানোর অভিযোগে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থান। আইনপ্রয়োগকারীদের হামলায় বিক্ষোভকারী এবং পথচারীদের কমপক্ষে ৮৩৪ জন প্রাণ হারান। এই বিক্ষোভ শুরু হয় ১ জুলাই। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে যাওয়ার মধ্যদিয়ে তার ইতি ঘটে।

এ হামলায় আহত হন কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ। তার মধ্যে আছেন শিশু ও নারী। দলটির এই পরিণতির জন্য দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা।

অজ্ঞাত স্থান থেকে ১৬ জানুয়ারি আল-জাজিরাকে ফোনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। এটা শিগগিরই প্রমাণ হবে। তবে তিনি কাকে বা কোনো দেশকে দায়ী করছেন সুনির্দিষ্টভাবে তা বলেননি।

তার এমন মন্তব্যের পর বিশ্লেষকরা বলছেন, তাদের দলের নেতৃত্বের যে ব্যর্থতা এবং জনগণের অভিযোগগুলো সমাধানে তাদের যে অক্ষমতা- তা ফুটে ওঠে এমন প্রত্যাখ্যানের মধ্যদিয়ে।

পক্ষান্তরে তাদের এমন মন্তব্যে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এসব নেতাকর্মীর অনেকেই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার ভয়ে হয়তো আত্মগোপনে আছেন না হয় আতঙ্কিত। তারা একটি সুসংগঠিত দল থেকে ‘টপ-ডাউন’ কাঠামোতে রূপান্তরের কারণে সমালোচনা করছেন।

তারা বলছেন, এ কারণে দল জনগণের সেন্টিমেন্ট হারিয়েছে। ৫ আগস্ট যখন জনতার বিশাল ঢেউ শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহানার সাথে গণভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে উড়াল দেন।

খুলনায় আওয়ামী লীগের ছাত্রবিষয়ক শাখা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্থানীয় সিনিয়র একজন নেতা বলেন, ‘যখন টেলিভিশনে নাটকীয় ওই পলায়নের দৃশ্য সম্প্রচার হচ্ছিল, তখনো কিছু নেতাকর্মীকে নিয়ে আমি খুলনার রাজপথে অবস্থান করছিলাম। আমি আমাদের একজন সিনিয়র নেতা, স্থানীয় এমপিকে ফোন করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার ফোন ছিল বন্ধ।’

তিনি বলেন, ‘ঠিক ওই মুহূর্তে আমার মনে হলো আমাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে।’

মূলত, বাংলাদেশে সরকারি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলকভাবে কোটা ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ছাত্ররা শুরু করেন কোটা বিরোধী আন্দোলন। কিন্তু তাদের ওপর সরকারের ক্রমবর্ধমান নিষ্পেষণ এবং ব্যাপক রক্তপাতের পর শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

হাসিনা সরকারের সময়ে বিএনপি এবং জামায়াত- উভয়েই ভয়াবহ দমনপীড়নের শিকারে পরিণত হয়। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাপকভাবে জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।

নাসিম স্বীকার করেন, তার দল কৌশলগত ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে তিনি ব্যর্থতার জন্য প্রথমেই দায়ী করেন গোয়েন্দাদের ব্যর্থতাকে।

ওদিকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে সম্প্রতি দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ১১ বছর ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘ইসলামপন্থী গোষ্ঠি এবং সেনাবাহিনী’র ‘যৌথ অভ্যুত্থানে’র শিকারে পরিণত হয়েছে আওয়ামী লীগ।

এদিকে আওয়ামী লীগের ভেতর জবাবদিহিতার অভাব থাকাকে কড়া সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ছেলে ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ।

তিনি বলেন, অবিচার, নিষ্পেষণ, দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা লুট ও পাচারের কারণে বাংলাদেশের জনগণের কাছে অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে আওয়ামী লীগকে।

এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এখনো আমি তাদের দেখিনি আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালোচনা অথবা দোষ স্বীকার করতে।
সূত্র : আল-জাজিরা


আরো সংবাদ



premium cement