‘এক-এগারো নিয়ে মিছেই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই’
- অসীম আল ইমরান, লক্ষ্মীপুর থেকে
- ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:০৫
‘বাংলাদেশে সেনাশাসন আসার কোনো প্রেক্ষিত নেই’ রাজনৈতিক দলগুলোকে এমন অভয় দিয়ে অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, আমরা তেসরা আগস্টেই বলেছিলাম, এক-এগারো চাই না। এক-এগারো নিয়ে মিছেই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এ সময় তিনি দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানান, আসুন বাংলাদেশ পন্থার ভেতর দিয়ে আমরা যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি আছি, ঐক্যবদ্ধ হই, সরকারকে সহযোগিতা করি সংস্কার করার জন্য। প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার হলেই উপকৃত হবে দেশের মানুষ।
শনিবার (২৫ জানুয়ারি) লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ সরকারি কলেজে মাঠে এক গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মাহফুজ আলম বলেন, ‘আমি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছি, কোনো রকম রাজনৈতিক পক্ষপাত করতে চাই না। বরং রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিকভাবে করবেন। বাংলাদেশপন্থী কারো সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু দিল্লির তাবেদারি করার কোনো প্রচেষ্টা হলে বিরোধ হবেই, হবে।’
তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে লক্ষ্মীপুরে যারা শহীদ হয়েছেন আমরা তাদেরকে পাব না। কিন্তু তাদের যে স্পিড, চেতনা, তা আমাদের রক্তের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হবে। আমরা তাদেরই উত্তরসূরি। তারা যে স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জীবন দিয়েছেন সেই ধারণা থেকে আমাদের পথচলা।’
তিনি আরো বলেন, ‘৫ আগস্ট এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা একটি রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ পেয়েছিলাম কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের মধ্যে ঐক্যের ঘাটতি রয়ে গেছে। আমরা এখনো বুঝতে পারিনি, আওয়ামী লীগ শুধু রাজনৈতিকভাবে পরাজয় বরণ করে তারা শেষ হয়ে যায়নি বরং দিল্লির কোলে আশ্রয় নিয়ে তারা ফোঁস ফোঁস করছে।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বলতে চাই এটা আমাদের প্রজন্মের লড়াই। এটা আমাদের ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ও রাজনীতির স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার লড়াই। কোনোভাবে যদি আবার আওয়ামী লীগ ভারতের কোল থেকে আমাদের দিকে চোখ রাঙ্গায় আমরা কি বসে থাকব? তখন উপস্থিত জনগণ বলে, না না না। আমরা বসে থাকব না আমরা শহীদদের শাহাদাতের পথ ধরে রক্ত দিব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের শাসনব্যবস্থা উৎখাত করে সন্তুষ্ট নই। আওয়ামী লীগের যতদূর আছে রাষ্ট্রীয় সেক্টরে সমাজে সংস্কৃতিতে প্রত্যেককেই আমরা বিচার করব। তাদের বিচার করেই আমাদের শহীদের যে আকাঙ্ক্ষা আছে সেদিকে আমরা এগোবো।’
বিচারের সাথে সাথে আমরা সংস্কারের কথা বলছি এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সংস্কার কমিশন থেকে যেগুলো রিপোর্ট এসেছে রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে যে সংস্কারগুলো না করলেই নয়, নির্বাচনের আগে সে সকল সংস্কার করতে চাই। সংস্কার শুধু মুখের বুলি নয়। যেসব প্রতিষ্ঠানগুলো আপনাকে টিকিয়ে রেখেছিল সেই প্রতিষ্ঠানগুলো একই রকম রেখে আমরা নির্বাচনে যেতে পারি না। যেসব প্রতিষ্ঠানে হাসিনা দালালরা আছে তাদের বিচার করেই আমাদেরকে নির্বাচনের দিকে এগোতে হবে।’
তিনি জানান, এবার আমরা কারো মদদে, কোনো রাষ্ট্রের মদদে হাসিনাকে উৎখাত করিনি। আমরা ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে হাসিনাকে উৎখাত করেছি। আর কারো তাবেদারি করার আমাদের কোনো দরকার নেই। আমরা শেখ হাসিনার তাবেদারি করার প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে এ স্বাধীনতা এনেছি। আমরা আর কারো কাছে মাথা নত করব না।
রামগঞ্জে গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন রামগঞ্জে সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: দিদারুল ইসলাম।
উপজেলা ডাকবাংলাতে গার্ড অব অনার দেয়া হয় অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার পর এই প্রথম নিজ এলাকায় সফরে আসেন তিনি।
এর আগে, দুপুরে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে এক পথসভায় উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা যদি ন্যূনতম সংস্কারগুলো না করে নির্বাচন করি, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যাবে এবং জনগণ কখনোই বৈষম্যমুক্ত হতে পারবে না। সুতরাং সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে খুব শিগগিরই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে এবং সকল অংশীজনের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে ন্যূনতম সংস্কার করে গণতান্ত্রিকভাবে পটপরিবর্তন এর জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থা করা হবে। সেইসাথে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশপন্থীদের হাতে থাকবে। এ দেশে দিল্লিপন্থীদের আর স্থান হবে না।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রামগঞ্জ উপজেলার আমির নাজমুল হাসান পাটোয়ারী বলেন, ‘১৭ বছর পর আমরা আমি জাহেলিয়াত থেকে মুক্ত হয়েছি। ভারতের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েছি কিন্তু বৈষম্য থেকে মুক্ত হইনি। আগামীতে সকলে মিলে ভারতের আধিপত্যবাদকে রুখে দিব, ইনশাআল্লাহ।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ লক্ষ্মীপুর জেলার সহ-সভাপতি আলহাজ্ব জাকির হোসেন বলেন, ‘বিজয় এখনও অসম্পূর্ণ। পুরো বিজয় এনে আমাদেরকে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
বাংলাদেশ হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ রামগঞ্জ উপজেলা সভাপতি অপূর্ব কুমার সাহা অপু বলেন, ‘২৪-এর আন্দোলন বৈষম্যের বিরুদ্ধে হয়েছে। বিশ্বাস রাখি, আগামীতে এদেশে যেন কোনো বৈষম্য থাকবে না, কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সবাইকে মিলিত হয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করতে হবে। আগামী সমৃদ্ধির বাংলাদেশ গড়বে এ সরকার এমন প্রত্যাশা রাখেন তিনি।’
গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী লক্ষ্মীপুরের শূরা সদস্য আমিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে কি পরিস্থিতি ছিল তা কেউ ভুলেনি। আমরা ভাবিনি আওয়ামী সরকারের পতন হবে দিল্লির দাসত্ব থেকে মুক্তি মিলবে।’
এ সময় তিনি উপদেষ্টা মাহফুজকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘ভয় হতাশ হওয়ার কিছু নেই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষপত্র দিতে হবে, বিচার ও সংস্কার করতে হবে, সংস্কার করে ইনসাফভিত্তিক বাংলাদেশ গড়তে হবে।’
রামগঞ্জ উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতারা বলেন, ‘আমরা একটি দলকে অপসারণ করে অন্য একটি দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য এত প্রাণ দেই নাই। সংস্কার এবং বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন হতে দিব না, দিব না, দিব না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবু বকর বলেন, ‘হত্যাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো নির্বাচন চাই না। আগামী বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাঁধে কাঁধ রেখে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে চাই।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত শাহ মুহাম্মদ সাগর বলেন, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৪-এর সকল শহীদদের স্বীকৃতি দেয়া হোক। পরিবারের ভরণপোষণ দায়-দায়িত্ব নেয়া হোক। পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সহযোগিতা প্রদানের দাবি জানান তিনি।’
এছাড়াও এ সময় উপস্থিত ছিলেন নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুর রহমান তুহিন, জয়নাল আবেদীন শিশির প্রমুখ।
উল্লেখ্য, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রামগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমির নাজমুল হাসান পাটোয়ারী ফুল দিয়ে উপদেষ্টাকে সংবর্ধনা জানান। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও সমাজসেবকরা ফুল দিয়ে সংবর্ধনা জানান। দেখা গেছে, উপদেষ্টাকে শুভেচ্ছা জানাতে, রাস্তায় পাশে ধর্মীয়প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে লক্ষ্মীপুরে শহীদ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেষে এলাকার শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন এবং শহীদ পরিবারগুলোর সাথে মতবিনিময় করেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।