২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১, ২৩ রজব ১৪৪৬
`

বিভিন্ন ইস‍্যুতে বিএনপির সাথে সন্দেহ ও টানাপোড়েন

মির্জা ফখরুল, নাহিদ, হাসনাত ও আসিফ - ছবি : সংগৃহীত

গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির সাথে অন্তর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধীদের বিভিন্ন ইস্যুতে টানাপোড়েন দেখা গেলেও নির্বাচন, সরকার ও রাজনৈতিক দল গঠন প্রসঙ্গে রীতিমত মুখোমুখি অবস্থানে দু’পক্ষ।

বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরলে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো: নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান।

বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) তারা তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তিনটি পৃথক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

সন্দেহ ও টানাপোড়েন

বিএনপির সাথে বৈষম্যবিরোধীদের সন্দেহ ও টানাপোড়েনের বিষয়টি প্রথম স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে। বিএনপির আপত্তির কারণে বৈষম্যবিরোধীদের দাবির মুখেও রাষ্ট্রপতির অপসারণ করা যায়নি বলে অভিযোগ করেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।

দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না করা ইস্যুতেও টানাপোড়েন প্রকাশ পায়।

তৃতীয়ত, গত বছরের শেষ দিকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘিরে উত্তেজনা দেখা দেয় রাজনীতিতে। সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরো ঘনীভূত হয় দু’পক্ষের মধ্যে।

চতুর্থ, ‘কিংস পার্টি’ গঠন, নির্বাচন নাকি সংস্কার কোনটি আগে হবে এমন নানা প্রশ্নে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে বুধ ও বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলাকে দেয়া দুই পর্বের সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য এখন তাদের দু’পক্ষকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে।

ওই সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারলে নির্বাচন করতে পারবেন না। একইসাথে অন্তর্বর্তী সরকারে নিজেদের প্রতিনিধি রেখে ছাত্ররা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়টি মেনে নেবে না।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ আসতে পারলে আসবে, না আসতে পারলে আসবে না। দ্যাটস নট মাই পয়েন্ট। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো কথা নেই। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, কোন দল নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, সেটা তো দলগুলো নিজেরাই ঠিক করবে। তখনকার সেটআপ ঠিক করবে, ইলেকশন কমিশন ঠিক করবে। আমরা কথাটা খুব পরিষ্কার করেই বলছি যে, আমরা মনে করি কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব আমাদের না। আমরা চাই যে, জনগণের মাধ্যমে সবকিছু নির্ধারিত হবে।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করলে সরকার থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।’

প্রতিক্রিয়া জানিয়ে যা বলেছেন নাহিদ ইসলাম 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো: নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শেষ দিকে ছাত্রদের পক্ষ থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে একটা জাতীয় সরকারের দাবি জানানো হয়েছিল। জাতীয় সরকার হলে ছাত্রদের হয়তো সরকারে আসার প্রয়োজন হতো না।

বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের বিষয়ে কথা বলেন তিনি।

নাহিদ ইসলাম তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। এক-এগারো এর বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিল। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটা এক-এগারো সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে।’

ছাত্র এবং অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে মাইনাস করার পরিকল্পনা ৫ আগস্ট থেকেই শুরু হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট যখন ছাত্র-জনতা রাজপথে লড়াই করছে, পুলিশের গুলি অব্যাহত রয়েছ, তখন আমাদের আপসকামী অনেক জাতীয় নেতারা ক্যান্টনমেন্টে জনগণকে বাদ দিয়ে নতুন সরকার করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন (অনেকে ছাত্রদের কথাও বলেছেন সেখানে)। আমরা ৩ আগস্ট থেকে বলে আসছি আমরা কোনো প্রকারের সেনা শাসন বা জরুরি অবস্থা মেনে নিব না। আমাদেরকে বারবার ক্যান্টেন্টমেন্টে যেতে বলা হলেও আমরা যেতে অস্বীকার করি।’

ফেসবুক পোস্টে নাহিদ ইসলাম আরো বলেন, ‘জাতীয় সরকার অনেক দিন স্থায়ী হবে এই বিবেচনায় বিএনপি জাতীয় সরকারে রাজি হয় নাই। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরেই দেশে জাতীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি ছিল। অথচ বিএনপি জাতীয় সরকারের কথা বলতেছে সামনের নির্বাচনের পরে। ছাত্ররাই এই সরকারের এবং বিদ্যমান বাস্তবতার একমাত্র ফ্যাক্টর যেটা এক-এগারো এর সরকার থেকে বর্তমান সরকারকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে। বিএনপি কয়েকদিন আগে 'মাইনাস টু'-এর আলোচনা করলেও এখন ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য নিরপেক্ষ সরকারের নামে আরেকটি এক-এগারো সরকারের প্রস্তাবনা করছে।’

এ ধরনের পরিকল্পনা গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে এবং ছাত্র-জনতা কোনোভাবেই এটা মেনে নিবে না জানিয়ে নাহিদ বলেন, ‘আমি মনে করি এটা বিএনপির বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র। আর এই সরকার জাতীয় সরকার না হলেও সরকারে আন্দোলনের সব পক্ষেরই অংশীদারত্ব রয়েছে এবং সব পক্ষই নানান সুবিধা ভোগ করছে। সরকার গঠনের আগেই ৬ অগাস্ট অ্যাটর্নি জেনারেল এবং পুলিশের আগের আইজির নিয়োগ হয়েছিল যারা মূলত বিএনপির লোক। এরকমভাবে সরকারের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত নানান স্তরে বিএনপিপন্থী লোকজন রয়েছে। নির্বাচনের নিরপেক্ষতার কথা বললে এই বাস্তবতায়ও মাথায় রাখতে হবে।’

রাষ্ট্রপতির পরিবর্তন, সংস্কার, নতুন সংবিধান, জুলাই ঘোষণা সব ইস্যুতেই বিএনপি বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে জানিয়েছেন তথ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘অথচ এগুলা কোনোটাই ছাত্রদের দলীয় কোনো দাবি ছিল না। কিন্তু দেশের স্থিতিশীলতা, বৃহত্তর স্বার্থ এবং জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্য ছাত্ররা বারবার তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। কিন্তু এর মানে এই না যে গণতন্ত্রবিরোধী ও অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাবিরোধী কোনো পরিকল্পনা হলে সেখানে আমরা বিন্দু পরিমান ছাড় দিব।’

তিনি তার পোস্টে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বিষয়ে ভারতের প্রধান দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সম্ভব হয়েছে অথচ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিষয়ে আমরা ঐক্য করতে পারি নাই এত হত্যা ও অপরাধের পরেও। হায় এই ‘জাতীয় ঐক্য’ লইয়া আমরা কি রাষ্ট্র বানাব! বাংলাদেশকে দুর্বল করা সহজ কারণ বাংলাদেশকে সহজেই বিভাজিত করা যায়। এ দেশের বড় বড় লোকেরা অল্পমূল্যে বিক্রি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। আমি মনে করি না সমগ্র বিএনপি এই অবস্থান গ্রহণ করে। বরং বিএনপির কর্মী সমর্থকদের বড় অংশই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন চায়। বিএনপির দেশপ্রেমিক ও ত্যাগী নেতৃত্বকে আহ্বান করব, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে না গিয়ে ছাত্র-জনতার সাথে বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির পথ বেছে নিন।

প্রতিক্রিয়া জানিয়ে যা বলেছেন আসিফ মাহমুদ 

উপদেষ্টাদের কেউ রাজনীতি করলে সরকার থেকে বের হয়ে করবে বলে মন্তব্য করেছেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। সরকারের কাজে রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ অনুচিত বলেও জানিয়েছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে এসব কথা বলেন তিনি।

আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘সরকারে থেকে রাজনৈতিক দলের সাথে কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতার বিরুদ্ধে আমরাও। উপদেষ্টাদের কেউ রাজনীতি করলে সরকার থেকে বের হয়েই করবে।’

তিনি বলেন, ‘একইসাথে রাজনৈতিক দলেরও সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করা অনুচিত। বিভিন্ন সরকারি/সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে তদবির/চাপ প্রয়োগ করা অনুচিত।’

প্রতিক্রিয়া জানিয়ে যা বলেছেন হাসনাত আব্দুল্লাহ 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্যায়-অনাচার ও জুলুম-নিপীড়নের দায় এড়িয়ে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক ব্ল্যাঙ্ক চেক দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাও করেননি বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।

তিনি বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিব আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির কোনো দ্বন্দ্ব না থাকার কথা স্বীকার করেছেন অকপটে। অথচ তিনি ভুলে গেলেন, এই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিজম কায়েম করেছে। গুম, খুন ও গণহত্যা করে বাংলাদেশকে অরাজকতার শীর্ষ চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে।’

বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে এসব কথা বলেন তিনি।

ফেসবুক পোস্টে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তিনিই বললেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির কিছু আসে যায় না। অথচ উনি ভুলে গেলেন, এই আওয়ামী লীগই বিগত তিনবারের জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে, এই আওয়ামী লীগের কারণেই তার দল বিএনপি বিগত সময়ের জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলো বর্জন করতে বাধ্য হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশের কাঠামোগত পরিবর্তন করার সময় ও সুযোগ এলো অথচ বিএনপি দেশ পুনর্গঠনের এই সুযোগকে অবমূল্যায়ন করে হাজির হলো এক-এগারো সরকারের ফর্মূলার আলাপ নিয়ে। ওদিকে অন্তর্বর্তী সরকার যখন দেশ সংস্কারের কাজে নিয়োজিত হলো তখন বিএনপি এসে বলল, এই সংস্কার করার ম্যান্ডেট বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। অথচ বিএনপি এ কথা ভুলে গেল, গণঅভ্যুত্থানের ফলে গঠিত হওয়া সরকারের ম্যান্ডেট ষাট-সত্তরভাগ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়া রাজনৈতিক দলের চেয়েও বেশি।’

তিনি আরো বলেন, ‘দেশ ও দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে গণঅভ্যুত্থানের পরে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা উপস্থিত হলো জনসমক্ষে। ঠিক এ কারণেই ফ্যাসিবাদবিরোধী ও জুলাই স্পিরিট ধারণকারী ছাত্র-জনতার সম্মিলনে যখন নতুন একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান হওয়ার আভাস পেল ঠিক তখন বিএনপি সেটিকে চিহ্নিত করল তাদের দলীয় স্বার্থের বিপক্ষে হুমকি হিসেবে।’

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘দৈনিক মানবজমিনের ভাষ্যমতে, ছাত্র-জনতার সম্মিলনে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ বানচাল করতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মাঝে উদ্বেগ ও শঙ্কা আদান-প্রদান হয়েছে। অর্থাৎ, বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনরায় আওয়ামী লীগের অবাধ অনুপ্রবেশ করতে দিলেও ছাত্র-জনতার সম্মিলনে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান দেখতে চায় না।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement