নতুন কর আরোপের সিদ্ধান্তে যে ১০টি আশঙ্কা দেখছে বিএনপি
- অনলাইন প্রতিবেদক
- ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:০০, আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:১৫
অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন ভ্যাট-কর আরোপে দেশে ১০টি সঙ্কটের আশঙ্কা করেছে বিএনপি।
আজ শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির পক্ষ থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেটি তুলে ধরেছেন।
বর্তমান অর্থনীতির বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের এই নতুন করারোপের সিদ্ধান্তের ফলে -
১) প্রায় ১৩ শতাংশ ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি আরো বৃদ্ধি পাবে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ফলে পরিবারের সঞ্চয় কমবে এবং ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হার বেড়ে যাবে।
২) বর্তমানে নিম্নমুখী ৫.৮২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো কমবে। এর অর্থ হলো অর্থনীতির গতি স্থবির বা মন্থর হয়ে পড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুত গতিতে না বাড়লে, কারখানায় উৎপাদন না বাড়লে, আয় বৃদ্ধি পাবে না। কর্মসংস্থান আরো কমে যাবে। বেকারের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। এমনিতেই গত তিন বছর ধরে মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। বিবিএস এর হিসেব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে মানুষের আয় বেড়েছে আট শতাংশ, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ১৪ আগস্ট আশ্বাস দিয়েছিলেন ৫/৬ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে। কিন্তু বাস্তবে তা বরং বেড়েছে। অথচ প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা ও রাজস্বনীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। গোষ্ঠীস্বার্থ উপেক্ষা করতে পারছে না সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমাতে, অন্যদিকে সরকার কর বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। এক মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির অনুমতি দিচ্ছে, আরেক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা তা আটকে দিচ্ছে। এই অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। একদিকে বিশ্বব্যাংক যেমন প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কথা বলছে, তেমনই ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির পাঁচটি বড় ঝুঁকির কথা বলেছে, যেমন মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক বন্যা/তাপপ্রবাহ, দূষণ সুযোগের অভাব এবং অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা।
৩) বিশ্বব্যাংকের ‘Global Multidimensional Poverty Index (MPI) 2024’ অনুসারে, বাংলাদেশের চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় চার কোটি ১৭ লাখ। বর্তমানে আরোপিত নতুন করহার এই দরিদ্র মানুষদের দুর্ভোগ আরো বৃদ্ধি করবে। বিবিএস-এর তথ্য মোতাবেক, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সারাদেশে এ ধরনের কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ছয় কোটির মতো। এছাড়া ২০২২ সালের জানুয়ারির পর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতির সাথে তাল মেলাতে পারেনি মজুরি বৃদ্ধির হার। প্রতি মাসে গড়ে যত মজুরি বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি ছিল তার চেয়ে বেশি। ফলে সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষের বাজার থেকে নিত্যপণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য কমেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান SANEM -এর দেশব্যাপী গৃহস্থালি জরিপ ২০২৩ -এর অন্য সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ৭০ শতাংশ খানা বা পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে। ২০২৪ সাল শেষে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১৩ ছুঁই ছুঁই! অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনের প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক বর্তমানে প্রায় দুই কোটি লোক রয়েছেন, যারা দু’দিন কাজ বা আয় করতে না পারলে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে বাধ্য হবেন। পরিণতিতে জাতীয় দরিদ্রের হার পুনরায় ৪০ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র বিবেচনায় এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, নতুন করে ভ্যাট আরোপে স্বল্প আয়ের মানুষের দুর্দশা চরমভাবে বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। উল্লেখ যে ২০০১-২০০৭ সালে বিএনপি আমলে দারিদ্র্য লাঘবের হার ছিল বার্ষিক এক শতাংশ, দারিদ্র্য লাঘবের যে হার গত দেড় দশক ধরে ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময় ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেতে থাকে। তাছাড়া, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের (১.১২ শতাংশ) তুলনায় বিএনপি সরকারের শাসনামলে (১.৭৬ শতাংশ) দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার বার্ষিক গড় হ্রাসের পরিমাণ বেশি ছিল।
আমাদের মনে রাখতে হবে, গ্রামের দরিদ্র মানুষ না খেয়ে মরে না ঠিকই। কিন্তু তারা অর্ধাহারে দিন কাটায়। বর্তমানে খাদ্যদ্রব্যসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে একজনের আয় দিয়ে সংসার চালানো খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই মা-বাবা কোনো উপায় না দেখে ছেলেমেয়েদের কাজে লাগিয়ে দিচ্ছেন, শুধু খেয়ে বেঁচে থাকার জন্যে। তাই, সরকারের ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব শিক্ষা ক্ষেত্রসহ সকল ক্ষেত্রে পড়তে বাধ্য এবং সার্বিকভাবে হতদরিদ্রের ওপরই পড়বে বেশি।
৪) বর্তমান উচ্চ মূল্যের জ্বালানি খরচ আরো বাড়বে।
৫) পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে বিদ্যমান টার্নওভার ট্যাক্স থ্রেশহোল্ড ৫০ লাখ থেকে ৩০ লাখ এবং ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন থ্রেশহোল্ড তিন কোটি থেকে ৫০ লাখে নির্ধারণ করা ক্ষুদ্র ব্যবসায়িদের ওপর কমপ্লায়েন্স প্রেসার বাড়াবে এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি (Informal Economy) বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের জন্য কোনো অবস্থাতেই মঙ্গলজনক হবে না।
৬) ব্যবসায়িক ব্যয় (Cost of Business) এবং শিল্পকারখানাগুলোতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং মোট উৎপাদন হ্রাস পাবে। এতে বেকারত্ব আরো বৃদ্ধি পাবে। এমনিতেই দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার। যদিও বেকারের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
৭) ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা আরো হ্রাস পাবে।
৮) নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনধারণ আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
৯) ব্যবসায় বিনিয়োগ কমবে।
১০) রফতানি প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হ্রাস পাবে। সর্বোপরি, অর্থনীতি ও দেশের জনগণের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
সরকার নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একদিকে নীতি সুদহার বাড়ানো ও অন্যদিকে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এতে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে, অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে।