৭ বছর পর দেখা হচ্ছে মা ও ছেলের
জটিলতা না থাকলে মঙ্গলবার বিদেশ যাচ্ছেন খালেদা জিয়া- বিশেষ সংবাদদাতা
- ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:৩৬
আগামী ৭ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বড় কোন জটিলতা না হলে দলটির বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই তারিখটিই চূড়ান্ত বলে জানানো হয়েছে। সব ঠিক থাকলে ওইদিন রাত ১০টায় কাতার এয়ারলাইন্সের একটি এয়ার-অ্যাম্বুলেন্সে করে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন তিনি। লন্ডনে পৌঁছে সরাসরি তার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা রয়েছে। বড় ছেলে তারেক রহমানের সাথে লন্ডনে কিছুদিন থাকার পর যাবেন যুক্তরাষ্ট্রে। মেরিল্যান্ডের পূর্ব বাল্টিমোরে অবস্থিত জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে চিকিৎসা নিবেন তিনি।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার লিভার প্রতিস্থাপন জরুরি। ধারণা করা হচ্ছে, বেগম জিয়ার এই চিকিৎসায় কমপক্ষে দুই মাস সময় লাগতে পারে।
দলীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসা সম্পন্ন হলেই বেগম জিয়া দেশে ফিরবেন। ফেরার পথে সৌদি আরবে পবিত্র ওমরাহ পালন করতে পারেন তিনি। এমনও আলোচনা আছে, চিকিৎসা শেষে মায়ের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও একত্রে দেশে ফিরতে পারেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের বিদেশযাত্রা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনা যেমন চলছিল, তেমনি চলছিল প্রস্তুতিও। বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি দুটি একসঙ্গে না এগুনোয় একাধিকবার বিদেশ যাত্রার তারিখ পরিবর্তন করতে হয়েছে। তবে নতুন করে আর তারিখ পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বলে চিকিৎসক এবং দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে শনিবার (৪ জানুয়ারি) বলেছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়া আগামী ৭ জানুয়ারি লন্ডনে যেতে পারেন। এখন পর্যন্ত এটা ঠিক আছে, সেভাবেই কাজ চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ওইদিন রাতে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের রি-ফুয়েলিংয়ের জন্য দোহাতে থামা হতে পারে। পরদিন ভোরে বা সকালে লন্ডন পৌঁছে সোজা হাসপাতালে যাবেন তিনি।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান খালেদা জিয়া। পরবর্তীতে ২০২০ সালের মার্চে তৎকালীন সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি পান তিনি। মূলত এই সাময়িক কারামুক্তির পর থেকেই বেগম জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য তার পরিবার এবং দল থেকে একাধিকবার দাবি জানানো হচ্ছিল। তবে প্রতিবারই শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তির কথা বলে তাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি সরকার।
এদিকে সাময়িক কারামুক্তির পর থেকে খালেদা জিয়া গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় থাকলেও এই সময়ে তাকে একাধিকবার জরুরি ভিত্তিতে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার হার্টে রিং পরানো হয়েছে, লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিকিৎসক এনে ‘টিপস’ করানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও তার বিদেশে চিকিৎসার দরজা উন্মুক্ত হচ্ছিল না। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট খালেদা জিয়া মুক্তি পান। এর পরপরই তার বিদেশযাত্রা নিয়ে প্রস্তুতি শুরু হয়। তিনি কোন দেশে যেতে পারেন, সেটা নিয়ে খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ড ও পরিবার একাধিকবার বৈঠক করেছে। এই সময়ের মধ্যে বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থাও দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য পারমিট করছিল না। এমন অবস্থায় তার শারীরিক অবস্থা দীর্ঘ ভ্রমণের উপযোগী করে তোলা, কোনভাবে তাকে বিদেশে নেয়া যায় এবং তার পাসপোর্ট জটিলতা নিরসনের ব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়া হয়। ইতোমধ্যে বেগম জিয়ার নতুন পাসপোর্ট করানো, ভিসা জটিলতা সব কিছু কেটে গেছে। তিনি যুক্তরাজ্য ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের ভিসাও পেয়েছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, বিশেষ বিমানে তিনি এখন ভ্রমণেরও উপযোগী। ফলে বেগম জিয়াকে বিদেশে নিতে তার পরিবার এখন সব দিক থেকে প্রস্তুত। জানা গেছে, খালেদা জিয়ার সাথে ৫/৬ জন চিকিৎসকসহ ১৫/১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল যাবে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন গত ২৯ অক্টোবর বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে প্রথমে ‘দীর্ঘযাত্রার বিশেষায়িত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে’ লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর সেখান থেকে তাকে তৃতীয় একটি দেশে মালটিডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হবে। পরবর্তীতে তৃতীয় সেই দেশটি যুক্তরাষ্ট্র বলে জানান তিনি।
২০২৩ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে খালেদা জিয়ার সফল অস্ত্রোপচার করা হয়। পেটে পানি আসা ও রক্তক্ষরণ বন্ধে তার শরীরে ট্রান্সজুগলার ইন্ট্রাহেপাটিক পোরটোসিসটেমিক সান্ট (টিপস) প্রতিস্থাপন করা হয়। সে কারণে বেগম জিয়ার মেডিকেল বোর্ড যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই হাসপাতালেই লিভার প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিয়েছে। জটিল এই অপারেশন প্রক্রিয়ায় টিপস সম্পাদনকারী যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকরা তো থাকবেনই, খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের কয়েকজন চিকিৎসকও সেখানে অংশগ্রহণ করবেন।
৭৮ বছর বয়সী খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস ছাড়াও কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। ২০০৭ সালে থেকে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে রয়েছেন। খালেদা জিয়ার এই সফরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পরে সেখানে মা-ছেলের সাক্ষাৎ হতে যাচ্ছে। এটিও একটি আবেগঘন পরিবেশ তৈরি করবে বলে পরিবারের সদস্যরা বলছেন। এই কারণে খালেদা জিয়া সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে না গিয়ে প্রথমে লন্ডনে যাচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, চোখ ও পায়ের ফলোআপ চিকিৎসার জন্য ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন খালেদা জিয়া। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে তিনি যাত্রাবিরতি করেন। ১৬ জুলাই বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে বেগম জিয়া লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এ সময় বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান। লন্ডনে মা-ছেলের এ সাক্ষাৎকালে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান উভয়ই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারেক রহমান তখন নিজের গাড়িতে করে মা খালেদা জিয়াকে গন্তব্যে নিয়ে যান।