নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ করছে সরকারের কাছে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:১২
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে, যা আগামী ৩ জানুয়ারি সরকারের কাছে জমা দেয়া হবে। যেখানে ‘না’ ভোটের বিধান চালু, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ কিংবা নির্দলীয় প্রতীকে ভোটের মতো বিষয়ও রয়েছে।
এই সংস্কার কমিশন বলছে, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে এমন আরো বেশ কিছু প্রস্তাব তারা চূড়ান্ত করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে তাতে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে?
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ইস্যুতে বিএনপির ইতিবাচক অবস্থান থাকলেও ‘না ভোট’ নিয়ে নেতিবাচক অবস্থান দেখা যাচ্ছে বিএনপির মধ্যে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আসলে যারা ভোটকেন্দ্রে যারা যায়, তারা হ্যাঁ ভোটই দিতে যায়। অতীতে একবার চালু হয়েছিল, তখন আমরা দেখছি না ভোটে মানুষের আগ্রহ নেই। এতে পরিস্থিতি জটিলতার দিকে যায়।’
আর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বলছে, তারা এখনো এই বিষয়ে তাদের অবস্থান চূড়ান্ত করেনি। সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পরই এ নিয়ে মত দেবে তারা।
আগামীতে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে যে সব প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন তা কতখানি বাস্তবায়ন সম্ভব সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংস্কার বাস্তবায়ন ও নির্বাচন আয়োজন করতে হবে সরকারকে। সেক্ষেত্রে ঐকমত্য তৈরি না হলে সংস্কার অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে সরকারের জন্য।’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বলছে, গত দেড় দশকে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। যে কারণে তারা যে প্রস্তাব দিচ্ছেন সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রস্তাবনা দেবো। আশা করব রাজনৈতি দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। এখন কেউ একমত না হলেও প্রয়োজনে পরে একমত হবে।’
যে সব প্রস্তাব গুরুত্ব পাচ্ছে
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তার মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও ছিল।
সংস্কার কমিশনগুলোকে কাজ শুরুর ৯০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশও দেয়া হয়।
গত ২৯ ডিসেম্বর সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার জানিয়েছেন আগামী ১৩ জানুয়ারি তারা সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দেবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন অংশীজনের পরামর্শ ও সুপারিশ নিয়েছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন।
দফায় দফায় বৈঠক করে এই কমিশন প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে।
কমিশন যেসব প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে সেখানে- ‘না ভোট’ চালু, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালু, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখা, জাতীয় সংসদসহ সব নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে জেলা প্রশাসকদের বদলে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের যুক্ত করার বিষয়গুলো রয়েছে।
এছাড়াও ভোট বাতিলে ইসির ক্ষমতা বাড়ানো, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল, নির্বাচনী অপরাধের শাস্তিসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত করে প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা হয়েছে বলেও নিশ্চিত করেছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন।
এর আগে নির্বাচনের সময় সাংবাদিক কিংবা পর্যবেক্ষকদের নীতিমালা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। তাই এবার সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবনায় অন্যান্য আইন-বিধি সংস্কারের পাশাপাশি পর্যবেক্ষণ নীতিমালায়ও বেশ বড় ধরনের সংস্কার আনার প্রস্তাব করছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘আমরা একটি শক্তিশালী নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আইন-বিধি, সংবিধান পর্যালোচনা করে প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছি। আমাদের প্রস্তাবনায় সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি।’
কমিশন বলছে, প্রস্তাবনাগুলো এখন চূড়ান্ত রিভিউ পর্যায়ে রয়েছে।
আগামী শুক্রবার অনলাইনে সেটি পাঠানো হবে প্রধান উপদেষ্টার দফতরে এবং পরবর্তীতে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হবে।
প্রস্তাব নিয়ে যে আলোচনা
ওয়ান ইলেভেনের সময় ড. এ টি এম শামছুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন বেশ কিছু সংস্কার এনেছিল দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায়।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ওই নির্বাচন কমিশন ‘না’ ভোটের বিধান চালু করা হয়েছিল। ওই কমিশনই চালু করেছিল ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরের বছরই নির্বাচনে ‘না’ ভোটের বিধান বাতিল করা হয়।
এই সংস্কার কমিশন নতুন করে সেটি আবার যুক্ত করেছে সংস্কার প্রস্তাবে।
সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘প্রত্যেক ভোটারের অধিকার আছে ভোট দেয়ার। তার প্রার্থী পছন্দ না হলে সে না ভোট দিতে পারে। যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। আমাদের দেশেও এক সময় ছিল। আমরা সেটি ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করছি।’
আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে গত দু’মাসে দেশের রাজনীতিতে নানা আলাপ হয়েছে। সংস্কার কমিশন বিভিন্ন অংশীজন ও রাজনৈতিক দলের পরামর্শ নিয়েছে ঠিক এই ইস্যুতে।
তবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সরাসরি আনুপাতিক হারে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু না করে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালুর মাধ্যমে মিশ্র আনুপাতিক নির্বাচনের বিষয়টি যুক্ত করছে সংস্কার প্রস্তাবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো আগে নির্দলীয়ভাবে বা দলীয় প্রতীক ছাড়াই হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৫ সালে এটি পরিবর্তন করা হয়।
এরপর থেকে সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দলীয় প্রতীকে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার শুরুর পর নির্বাচন ঘিরে সহিংসতাও যেমন বেড়েছে, তেমনি নির্বাচনগুলোও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে গত প্রায় ১০ বছরে।
তাই এবার সংস্কার কমিশন বেশ গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার প্রস্তাবে যুক্ত করেছে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ দেয়ার বিষয়টি।
ঐকমত্য তৈরি বড় চ্যালেঞ্জ
সংস্কার কমিশনগুলো এই প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দেয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেগুলো কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, আইন বা বিধি-সংক্রান্ত ছোট ছোট বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে আসা নিয়ে খুব একটা সঙ্কট দেখছে না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে তারা মনে করছে, ‘না’ ভোট কিংবা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালুর মতো বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর সবাই একমত নাও হতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এর আগে ২০০৮ সালে ভোটে জিতে পরের বছর ‘না ভোট’ বাতিল করেছিল আওয়ামী লীগ।
বর্তমানে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিও বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছে না।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘অতীতেও আমরা দেখছি না ভোটে পরিস্থিতি জটিলতার দিকে যায়। সেটা ফলপ্রসূ হয়নি বলেই হয়তো বাদ দেয়া হয়েছিল।’
এছাড়াও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন অন্য অনেক প্রস্তাব দিচ্ছে যেগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কতখানি একমত হবে সেটি নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘সব কমিশনের কাছে আমাদের দলের পক্ষ থেকে আলাদা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কমিশন তার কতটুকু গ্রহণ করবে বা বাদ দিবে সেটি চূড়ান্তভাবে জানানোর পর জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রতিক্রিয়া জানাবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ছাড়া সংস্কার ও নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হবে সরকারের জন্য।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলেন, ‘চাইলেই বিএনপি কিংবা বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করে সংস্কার বাস্তবায়ন করা এই মুহূর্তে সম্ভব না। বেশ কঠিন। আবার যদি সরকার মনে করে সব দলকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাবে, সেটা যেমন অতীতেও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।’
এক্ষেত্রে মাঠে থাকা বিএনপি, জামায়াতের মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিমুখী অবস্থান সরকারের সংস্কার কাজকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা মনে করছেন, পরিস্থিতি এমন হলে নির্বাচনের রোডম্যাপ বাস্তবায়নেও জটিলতা তৈরি হতে পারে।
ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রধানদের নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ গঠন করা হবে, যার প্রধান থাকবেন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এই কমিশনের দায়িত্বে থাকা বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা সব পক্ষের সাথে বসে বোঝানোর চেষ্টা করব। এর মাধ্যমে নতুন কোনো সমাধান বেরিয়েও আসতে পারে।’
সূত্র : বিবিসি