খাদ্যকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া দরকার : পানিসম্পদ উপদেষ্টা
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:৪৫
খাদ্যকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া দরকার মন্তব্য করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘আমরা হাইব্রিড যুগে পৌঁছে গেছি। খাদ্য বলেন আর যা কিছু বলেন আমাদের সবকিছু বেশি করে উৎপাদন করতে হবে। রাষ্ট্রও অধিক পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনে পুশ করছে। আমাদের অধিক খাদ্য উৎপাদনের সাথে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনেও মনোযোগ দিতে হবে।’
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএআরএফ) আয়োজিত ‘কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএআরএফ সভাপতি রফিকুল ইসলাম সবুজের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক কাওসার আজমের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্যাহ মিয়ান। প্রধান আলোচক ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। বৈঠকে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সীড অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কৃষিবিদ ড. আলী আফজাল। এ সময় আরো বক্তব্য দেন কৃষিবিদ খন্দকার রাশেদ ইকবাল ও শেখ ফজলুল হক মনি।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘কৃষিকে পানি থেকে বা পানিকে কৃষি থেকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমাদেরকে একসাথে কাজ করতে হবে। একটি দেশের মানুষের প্রধান চাহিদাই হচ্ছে খাদ্য। করোনায় মানুষ বা রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী স্থান থেকে অস্থিরতা শুরু হলো ধান কাটবে কে, শ্রমিক কোথায় পাওয়া যাবে। এখন যেহেতু সংবিধান সংস্কার কমিশন কাজ করছে তাদের কাছে এ দাবি তুলতে হবে, খাদ্যের অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া দরকার।’
তিনি বলেন, ‘এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে আগে প্রতি হেক্টরে আট দশমিক পাঁচ কেজি কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার ব্যবহার করা হতো বর্তমানে তা ৭০০ কেজিতে পৌঁছেছে। এটি একটি ভয়ংকর অবস্থা। ২০০৫ সালে ১২ হাজার টন কীটনাশক আমদানি করা হয়েছিল কিন্তু ২০২০ সালে তা ২৭ হাজারে টনে উন্নীত হয়। অর্থাৎ আমরা দ্বিগুণের বেশি কীটনাশক আমদানি করছি। এসব কীটনাশক আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের প্রতি হেক্টর জমিতে যেখানে ৯৮ টাকার কীটনাশক লাগার কথা বর্তমানে তা লাগছে ৮৮২ টাকার। এর সবকিছু খাদ্যচক্রের মাধ্যমে আমাদের শরীরে যাচ্ছে। তাই শুধু খাদ্য উৎপাদন করলাম এটাতে হবে না বরং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষি জমি সুরক্ষা আইনসহ বেশকিছু নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পথে। এগুলো চূড়ান্ত হলে আমরা আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন আনতে পারব।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় জলবায়ু সহিষ্ণু জাত যেমন ব্রী ধান-৫২, বীনা-১১ ধানের জাত উৎপাদন করা হচ্ছে। স্মার্ট প্রযুক্তি, যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে এর প্রভাব মোকাবেলা করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা খামারি নামের একটি অ্যাপ তৈরি করছি। যেখানে জমির পরিমাণ অনুযায়ী মাটির উর্বরতা বিবেচনায় নিয়ে কোন ফসল ভালো ফলবে, কতটুকু সার লাগবে, কী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে এবং সর্বোপরি আবহাওয়া উপযোগী একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে চাষাবাদের ক্ষেত্রে। দ্রুতই এই অ্যাপটির কার্যক্রম শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজ এত ব্যাপক, সারাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব যে মন্ত্রণালয়ের হাতে। তাদের জন্য প্রতি বছর যে বরাদ্দ থাকে সেটা অনেক বড় একক প্রকল্পের চেয়েও কম। এই জায়গায় পরিবর্তন দরকার। সারের মজুদের বিষয়ে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত সার রয়েছে। কোনো কোনো কৃষক হয়ত একসাথে পুরো মৌসুমের সার কিনতে চায়, সেখানে কিছুটা গ্যাপ হচ্ছে।’
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘একেক দেশে কৃষি উৎপাদনের ধরন একেকরকম। উন্নয়নশীল দেশে উৎপাদনে যারা জড়িত তারা নিজের জন্য খাবার রাখেন। আমাদের দেশেও। বাকিটা বিক্রি করেন। অধিকাংশ কৃষক শিক্ষিত নন। কৃষিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। এটা আবহাওয়া ও বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এ কারণে প্রাচীন পদ্ধতিতে তারা চাষাবাদ করেন। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে চান না। তারা সাহস করেন না।’
কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর শূন্য দশমিক চার শতাংশ হারে জমি কমছে। আরো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ কারণে সব অংশীদার মিলে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অধিক কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি মাটির স্বাস্থ্যও ধরে রাখতে হবে। উৎপাদন দু’ভাবে বাড়ানো যায়। এক হলো জমি বাড়ানো। আর অন্যটি হলো উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। জমি বাড়ানোর যেহেতু সুযোগ কম এ কারণে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।’
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বাংলাদেশ সীড অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ড. আলী আফজাল বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন উপকূলীয় অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, খরা, হঠাৎ বন্যার মত সংকটগুলো প্রকট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে মাটির লবণাক্ততা, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের অত্যন্ত ভয়ঙ্করভাবে বাড়তে থাকা পরিবেশগত সমস্যা। বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ হেক্টর বা ৩০ শতাংশেরও বেশি উপকূলীয় ভূমি লবণাক্ততা দ্বারা প্রভাবিত। মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ফসলের ধানের ফলনের প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করেছে। ফলে বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় তিন হাজার ৮৪০ থেকে পাঁচ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা।’
তিনি বলেন, ‘রাজশাহী, রংপুর এবং দিনাজপুরসহ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, পানির সংকট, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত দীর্ঘ সময়ের খরা এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস এবং উল্লেখযোগ্যভাবে কৃষি উৎপাদনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতি সাধন করছে। খরা প্রবণ এলাকাগুলোতে ফসলের ফলন বিশেষ করে ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে, কারণ ধান মূলত পানি-নির্ভর শস্য। ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরার কারণে কৃষি উৎপাদনে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, খরার তীব্রতার পরিপ্রেক্ষিতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ক্ষতির পরিমাণ বছরে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা।’
ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টন, উচ্চ তাপমাত্রার আবির্ভাব, বন্যা ও আকস্মিক বন্যার কারণে শস্য বিন্যাসের উপর প্রতিনিয়ত প্রভাব পড়ছে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার দীর্ঘসূত্রিতা যেখানে তিন ফসল হওয়ার কথা বা চার ফসল হওয়ার কথা সেখানে দু’ফসল বা তিন ফসল হচ্ছে। এছাড়া ফসলে পোকামাকড় ও রোগের প্রাদুর্ভাবের প্রতিনিয়ত স্বরূপ পরিবর্তন হচ্ছে।’
এ সময় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা দেশে কীটনাশকের ভয়াবহ ব্যবহারের কথা তুলে ধরেন। এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্যসেবাও ঝুঁকিতে বলে মনে করেন, বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দেয়ার দাবি জানান বক্তারা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা