২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সুস্থির হতে সময় লাগছে, সব লণ্ডভণ্ড অবস্থা : ড. ইউনূস

ড. মুহাম্মদ ইউনূস - সংগৃহীত

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলছেন, ‘হঠাৎ করেই এ অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটল। একটু সুস্থির হতে সময় লাগছে। আমরাও বোঝার চেষ্টা করছি কোথা থেকে শুরু করব। সব তো লণ্ডভণ্ড অবস্থা।’

বুধবার (২০ নভেম্বর) বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘একটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ সরকার যাত্রা করল। এর মধ্য দিয়ে স্থিতি আনা ও মানুষকে একত্র করা। এয়ারপোর্টে সবার কাছে আবেদন জানালাম যে আমরা এক পরিবার। আমাদের মাঝে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু আমরা একে অন্যের শত্রু না। আমরা একযোগে কাজ করব। একসঙ্গে থাকি। এ অভ্যুত্থান আমাদের নতুন যাত্রার সুযোগ দিয়েছে। তো সেটি নিয়েই শুরু। তারপর আস্তে আস্তে কাজে নামা। তার মধ্যে বড় সমস্যা হয়ে গেল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি।’

তিনি বলেন, ‘এ অভ্যুত্থানের ধকল সয়ে মানুষ আস্তে আস্তে সুস্থির হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশ পাচ্ছে না। এখনো সব পুলিশ কাজে আসেনি। তারা ভয় পেয়ে গেছে। কাজেই এদিকে পুলিশ নেই, ওদিকে মানুষের অস্থিরতা। কে কোথায় আছে? কী করছে? হঠাৎ করেই এ অভ্যুত্থান ঘটল। একটু সুস্থির হতে সময় লাগছে। আমরাও বোঝার চেষ্টা করছি কোথা থেকে শুরু করব। সব তো লণ্ডভণ্ড অবস্থা। অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড, ব্যাংকিং সিস্টেম লণ্ডভণ্ড। ব্যবসা-বাণিজ্য লণ্ডভণ্ড। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে। এগুলো নিয়ে প্রতিদিনই প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে।’

কিছু কিছু জায়গায় সরকারের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষের অভাব তো থাকবেই। আর আমরা তো এ কাজের মানুষ না। আমাদের তারাই পছন্দ করে নিয়ে আসছে। কাজেই আমরা যতদূর পারি, ততদূর করি। ভুল-ত্রুটি হবে স্বাভাবিক। ভুল-ত্রুটির মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে। যতটুকু আমাদের সাধ্যে কুলায় সেভাবেই চেষ্টা করছি। আর যেগুলো অসম্পূর্ণতা আছে, আমরা চেষ্টা করি কিভাবে সম্পূর্ণ করব।’

সংস্কার কমিশন কমিশনের রিপোর্টের কবে পেতে পারেন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, “আমরা তো প্রথম ছয়টির জন্য সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম, যেগুলো আমাদের বিশেষভাবে দরকার। সেটি ছিল যে ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে আমাদের রিপোর্ট দেবে। সেটিই আমরা আশা করছি। ডিসেম্বর তো প্রায় এসেই গেল। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে। কারণ অনেকগুলোর কাজ শুরু করতে দেরি হয়ে গেছে। আমরা প্রথমে বলেছিলাম, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দিন। কিন্তু দেখলাম যে এটি আর বলা যাচ্ছে না। যেহেতু শুরুতেই তাদের বসার জায়গা দিতে পারছি না। তারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। কাজেই সময় চলে গেছে। ধরে নিচ্ছি জানুয়ারির মধ্যে রিপোর্ট এসে যাবে। রিপোর্ট এসে গেলে তখন একটি দলিল পেলাম; যেটি রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে দেব যে বলুন, কোনটি আপনাদের পছন্দ? যেটি আপনাদের পছন্দ, যেটি করতে চান, সেটি করব। আর যেগুলো অপছন্দ বা কেউ একমত হতে পারছে না; সেগুলো বাদ রাখব। কাজেই এটা তাদের নেগোসিয়েশন বা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার বিষয়। আমরা সাহায্য করব তাদের আলাপ-আলোচনায়। আমরা ধরে নিচ্ছি এখানে ১০০টা প্রস্তাব আছে। যেখানে বলা আছে এটি করতে হবে, ওটি করতে হবে। ১০০টির মধ্যে ১০টির ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি নেই। আর ১০টি একটু এদিক-ওদিক বদল করে দিলে হতে পারে। আমি আন্দাজ করছি। অথবা যদি বলে যে এগুলোর কোনোটিরই দরকার নেই, তাড়াতাড়ি নির্বাচন দেন। এগুলো আমরা করব। আপনাদের এসবের মধ্যে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। রিপোর্ট লিখেছেন, এখন আমাদের কাছে আসবে।’ হতে পারে। আমরা সেটির জন্য অপেক্ষা করব। যদি বলে যে নির্বাচন দিয়ে দিন, তাহলে আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।”

সরকারের মেয়াদ ‘চার বছর’ ইস্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বক্তব্য যেটি আল জাজিরায় ছাপা হয়েছে, সেটি দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। সেটিই বোধ হয় আমার অফিস থেকে বলা হয়েছে। প্রসঙ্গটি নির্বাচন নিয়ে কথা ছিল না। এটি ছিল পার্লামেন্টের চার বছর নিয়ে আলোচনা। ওখানে নির্বাচনের চার বছর নিয়ে আলোচনা হয়নি।’


তিনি বলেন, ‘আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই যে সংস্কার করবেন, সংবিধানের যে সংস্কার করবেন; সেগুলো কী কী হতে পারে? উত্তরে আমি বলেছিলাম বহু হতে পারে; বহু রকমের ইস্যু আছে। যেমন কেউ বলে যে প্রত্যেক সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছরের জায়গায় চার বছর করুন। দু’দফার মধ্যে সীমা এবং পার্লামেন্ট পাঁচ বছরের জায়গায় চার বছর করুন। তখনই চার বছরের প্রশ্নটি এলো। সে সময় আবার প্রশ্ন করা হয় যে তাহলে আপনারা কী চার বছর থাকবেন? কথাটি ছিল পার্লামেন্টের, এখন প্রশ্ন করে ফেলল আপনারা কী চার বছর থাকবেন? ওই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছি, না, না। অনেক কম। এই অনেক কমটাই এসে বলছে চার বছর। চার বছর বলা হলো পার্লামেন্ট নিয়ে। এখন এটি হয়ে গেছে নির্বাচন নিয়ে। অথচ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল না।’


আল জাজিরার প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি আরো বলেন, “আল জাজিরা ভুলভাবে উপস্থাপন করেনি। তারা ঠিকই দিয়েছে। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম সুন্দর রিপোর্ট করেছে। আমাকে তো আল জাজিরা পর্যন্ত যেতে হচ্ছে না। সে পত্রিকাগুলো আল জাজিরা থেকে নিয়ে বলছে। কিন্তু অন্য অনেক কাগজে চার বছর লাগবে উল্লেখ করেছে। আরে চার বছর ওদের তো ধরে-বেঁধে রাখতে পারবেন না। যাদের নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়, উপদেষ্টামণ্ডলী, তারাই বলবে, ‘আজই আমাদের ছেড়ে দিন। আমি কী করে চলব? এ বেতনে আমার ছেলের বেতন দিতে পারছি না। যত তাড়াতাড়ি পারেন নির্বাচন দিয়ে দিন। আমরা চলে যাই।’ কাজেই আমাদের উদ্দেশ্য হলো যে তাড়াতাড়ি যাওয়া। আমরা চার বছর বললে তো লোক এখনই বের হয়ে চলে যাবে। একজন-দু’জন না, আমাদের কয়েকজন আছে যারা বলেন, ‘আমাদের ছেড়ে দেন। আর কতদিন আমাদের রাখবেন?”

দ্রব্যমূল্য না কমার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছয়টি বন্যা গেছে। সে সময় ফসল নষ্ট হয়েছে, সবজি নষ্ট হয়েছে। সেটির ধকল সহ্য করতে হয়েছে। এক জায়গায় তো না। বিভিন্ন জায়গায় এটি হয়েছে। কাজেই সেটির একটি ধকল আছে। তারপর যেগুলো আমদানি করা হচ্ছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে মুদ্রার বিনিময় হারে পরিবর্তন এসেছে। এ টাকা ডলারে পরিবর্তন হয়ে সেখানে খরচ বেশি হচ্ছে। এজন্যই মূল্যস্ফীতিটা বেশি হয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।’

ব্যাংক খাতের সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন , ‘এখন বুঝতে হবে অপশনগুলো কী। একটি হলো যে টাকা দিয়ে দাও, ব্যাংক বন্ধ করে দাও। তার চেয়ে অল্প অল্প দিয়ে ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখো। আমাদের এখন পলিসি হলো ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। অল্প অল্প করে দাও, তাও ব্যাংক বাঁচুক। একটি ব্যাংক ফেল করা আরম্ভ করলে তারপর একের পর এক ফেল করা শুরু করবে। এটি ভয়ংকর জিনিস হবে। কাজেই আমাদের তো একটি উপায় বেছে নিতে হবে। পলিসি বলতে, একটু সহ্য করি সবাই মিলে। যাতে করে ব্যাংক বাঁচে এবং পুরো সিস্টেম ফাংশন করতে আরম্ভ করে। মানুষ আলোচনা করবে এটা ঠিক ছিল, না বেঠিক ছিল। এটা হলো মূল্যায়নের ব্যাপার যে আমার কোন দিকে যেতে হবে। দু’টি অপশন আছে। এদিকে গেলে এমন হবে, ওদিকে গেলে ওমন হবে। আমরা একটা অপশন বেছে নিয়েছি। মনে হয়েছে এটিই ভালো হবে।’

পাচারকৃত অর্থ ফেরানো বিষয়ে তিনি জানান, ‘সবাই বলছে কিন্তু টাকা ফেরত আসছে না। ফেরত আসবে কিনা জানি না। আশা করি যেন আমরা কাজটা শুরু করে দিয়ে যেতে পারি। এ প্রক্রিয়া বড় জটিল প্রক্রিয়া। আইনি প্রক্রিয়া। কেউ কারো টাকা ছাড়তে চায় না। যে ব্যাংকে টাকা গেছে সে ব্যাংক টাকা রাখার জন্য আইনজীবীদের লাগিয়ে রেখেছে। আর যে মালিক নিয়ে গেছে, সেও আইনজীবী লাগিয়েছে। এটা আইনের লড়াই হবে। সাক্ষী-প্রমাণের লড়াই হবে যে কে পাবে আর কে পাবে না। যত রকমের প্রতিষ্ঠান আমাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে, সবাই আশ্বাস দিচ্ছে। বলছে সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এটা করা সম্ভব আংশিকভাবে, পুরো টাকাটা আসবে না।’


আরো সংবাদ



premium cement