একজন আল মাহমুদ
- রহিমা আক্তার মৌ
- ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:২০
যিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনা ও বাকভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি কবি আল মাহমুদ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবিও তিনি। তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক তিনি।
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই প্রবল বর্ষণের এক রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ‘সোনালী কাবিনের’ এই কবি। তার পিতার নাম মীর আবদুর রব এবং মাতার নাম রওশন আরা মীর। বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাইস্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডু হাইস্কুলের পড়াশোনা করেন। মূলত এই সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু। বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য অনন্য অপার বিরল সৃষ্টি কালজয়ী কাব্য ‘সোনালী কাবিনে’র স্রষ্টা বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ প্রতিভাবান ও শক্তিমান কবি এবং এক প্রবাদতুল্য অনিবার্য কিংবদন্তি হিসেবে আল মাহমুদই পরিচিত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা বেগম আর তাদের পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়েই সংসার।
মাত্র ১৮ বছর বয়স ১৯৫৪ সালে সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে কবি ঢাকা আসেন। তখন থেকেই তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। ঢাকা আসেন এবং পত্রিকায় কাজ নেন, তখনই সাহিত্যে পুরোদমে মনযোগী হন। আজীবন আত্মপ্রত্যয়ী কবি ঢাকায় আসার পর কাব্যসাধনা করে একের পর এক সাফল্য লাভ করেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলায় লেখালেখি শুরু করেন। পাশাপাশি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর ‘কালের কলস’, ‘সোনালী কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো’ কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, যুদ্ধের পরে দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ নামক পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। এই পত্রিকায় সামসুদ্দিন পেয়ারা, মরহুম আসফউদ দৌলা, ফজলুল বারী প্রমুখ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। মূলত এই সময় তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এক বছরের জন্য একবার জেল খাটেন। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালে অবসর নেন।
‘দ্য ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় প্রকাশিত ইমরান মাহফুজের নেয়া এক সাাৎকারে গ্রাম থেকে শহরে আসা নিয়ে কবি বলেন-
‘আমি ঢাকায় এসেছিলাম খদ্দরের পিরহান গায়ে, পরনে খদ্দরের পাজামা, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল এবং বগলের নিচে গোলাপফুল আঁকা ভাঙা সুটকেস নিয়ে। এসেছিলাম অবশ্যই কবি হতে। আজ অনেক বছর শহরে আছি। আমার সুটকেসের ভেতর আমি নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশের সবগুলো নদী, পাখি, পতঙ্গ, নৌকা, নর-নারীসহ বহমান আস্ত এক বাংলাদেশ। যেমন, যাদুকররা তাঁদের দ্রষ্টব্য দেখান। আমার ভাঙা সুটকেস থেকে জাতিকে দেখিয়েছি। আমার দ্রষ্টব্য দেখে বাংলার মানুষ কখনও কখনও হাততালি দিয়েছেন, আবার কখনও অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। আমি এখনো এই শহরেই আছি। আমি যখন এসেছিলাম তখন আমার বন্ধুদের বগলের নিচে থাকতো সিলেক্টেড পয়েমস জাতীয় ইউরোপের নানা ভাষার নানা কাব্যগ্রন্থ। আমি যেমন আমার ভাঙা সুটকেস থেকে আমার জিনিস বের করে দেখিয়েছি তারাও তাঁদের বগলের নিচের পুঁজি থেকে নানা ভেলকি দেখিয়েছেন। আমার সেসব বন্ধুদের সৌভাগ্য হয়নি। এই মহানগরীতে তাঁদের নাম তরুণরা উচ্চারণ করেন না।
একটি কথা মনে রাখবে- সাহিত্য কোন প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিলো না, এখনো নেই। এটা ছিলো আনন্দের বিষয়, ভষ্যিতেও তাই থাকবে।’
আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তিনি কবিতায় অবলম্বন করেন। ১৯৯০-এর দশক থেকে তার কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে; এর জন্য তিনি প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হন। তবে স্রষ্টানুগত্যের কারণে তার কবিতার কাব্যগুণ আহত বা তিগ্রস্ত হয়নি একটুও। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি।
সমকালীন বাংলা সাহিত্যাকাশে আল মাহমুদের সমতুল্য মেলা ভার। বিগত কয়েক দশক বাংলা কবিতা তার হাত ধরে আজ চরম উৎকৃষ্ট ও উন্নত শিখরে অবস্থান করছে। তিনি কবিতার সোনার চামচ মুখে নিয়ে এই বাংলায় জন্মেছেন। কবিতার সঙ্গেই গড়ে তুলেছেন একান্তে ঘর-সংসার। তিনি বলেছেন- ‘কবিতা আমার জীবন।’
আল মাহমুদের কবিতা সম্পর্কে আবিদ আনোয়ার লিখেছেন,
‘পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ। বোদলেয়ারীয় আধুনিকতায় জারিত আমাদের প্রায় সব কবির রচনায় যখন স্বকালের বন্ধ্যত্ব, নৈরাশ্যবাদিতা, পাশ্চাত্যের অনুকরণে মেকি নগর-যন্ত্রণা এবং এক সর্বগ্রাসী বিনষ্টি ও বিমানবিকীকরণের আগ্রাসন ঘটেছিল, তখন আল মাহমুদ তার প্রবেশলগ্নের দেশজতা, মানবিকতা, সাম্যবাদ ও এতে লগ্ন থাকার আকুতি দিয়েই আকৃষ্ট করেছিলেন পাঠককে। কিন্তু এসবের পরিণতিপ্রাপ্তির আগেই তিনি ‘মানবিক নির্মাণের প্রতি’ আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন বলে ঘোষণা দিয়ে কিছু বিশ্বাসের কবিতা লেখার প্রয়াস পান, যা কাব্যরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ এই নয় যে, এগুলোর বিষয়বস্তু ইসলাম ধর্ম এবং আল্লাহ-রাসূলের স্তুতি। এর মূল কারণ তার প্রবেশলগ্নের কবিতার শিল্প-সফলতা এগুলোতে প্রতিফলিত হয়নি। শেষোক্ত কবিতাগুলো তার মধ্যবয়স থেকে শুরু করে শেষ-বয়সে লেখা এবং সম্ভবত বয়স বাড়ার কারণেই কবিত্বশক্তিও হ্রাস পেয়েছে, যেমনটি ঘটে থাকে প্রায় সব কবির েেত্রই। অবশ্য প্রবেশলগ্ন থেকেই আল মাহমুদের অনেক ভালো কবিতাও নির্মাণকলার বিবেচনায় নানারূপ স্খলন-পতনের শিকার হয়েছে। এসব সীমাবদ্ধতা নিয়েও তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন তার কবিতার প্রসাদগুণের কারণে। সব ছন্দেই তিনি পারদর্শী হলেও বিশেষত পয়ারনির্ভর তার কবিতা পাঠককে মুগ্ধ করে সহজ-সচ্ছল ডিকশনের (উচ্চারণের) কারণে। কিন্তু অত্যন্ত বড় মাপের কবি হয়েও ছন্দ ও মিল রার্থে স্বভাবকবিদের মতো তিনি অনেক স্থানে অর্থবিপত্তি তৈরি করেছেন।’
পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখক, সমালোচক শিবনারায়ণ রায় বলেছিলেন, ‘বাংলা কবিতায় নতুন সম্ভাবনা এনেছেন আল মাহমুদ, পশ্চিম বাংলার কবিরা যা পারেনি তিনি সেই অসাধ্য সাধন করেছেন।’
অবশ্য কবি আল মাহমুদ শুধু কবি হিসেবেই নয়, তিনি একাধারে একজন শক্তিমান গাল্পিক,ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক। সাহিত্যের অনেক শাখাতেই তার অবাধ বিচরণ। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’। তার সৃষ্টির পরিধি সাহিত্যের বিশাল এলাকা জুড়ে। কিন্তু এত কিছু ছাড়িয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন কবি এবং শুধুই কবি।
বাংলা কবিতা যাদের হাত ধরে আধুনিকতায় পৌঁছেছে, কবি আল মাহমুদ তাদের অগ্রগণ্য। যেন ঐশ্বরিক মতা রয়েছে তার কলমের কালিতে। আল মাহমুদের কলম বাংলা সাহিত্যকে করেছে আরো উর্বর। সাহিত্যের সব শাখাতেই তার সমান পদচারণা। তার লেখনীর ব্যতিক্রম স্বাদের জন্য তিনি বারবার আলোচিত হয়েছেন। হয়েছেন অসংখ্যবার পুরস্কৃত। মাত্র দু’টি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার মাঝে ছিল সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম ‘সোনালী কাবিন’।
কবি আল মাহমুদের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা। কবিতা, গল্প, উপন্যাসসহ শ’ খানেকের মতো। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছেÑ কবিতা : লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, প্রহরান্তরের পাশ ফেরা, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, মিথ্যেবাদী রাখাল, আমি দূরগামী, বখতিয়ারের ঘোড়া, দ্বিতীয় ভাঙন, নদীর ভেতরে নদী, উড়াল কাব্য, বিরামপুরের যাত্রী, বারুদগন্ধী মানুষের দেশে, তুমি তৃষ্ণা তুমিই পিপাসার জল, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, ইত্যাদি। পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধবনিক, ময়ূরীর মুখ, নীল নাকফুল, কলংকিনী জ্যোতির্বলয়, গন্ধ বণিক, সৌরভের কাছে পরাজিত, আল মাহমুদের গালগল্প ইত্যাদি ছোট গল্পগ্রন্থ। উপন্যাস : কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, চেহারার চতুরঙ্গ, নিশিন্দা নারী, ইত্যাদি। শিশুতোষ : পাখির কাছে ফুলের। প্রবন্ধ : কবির আত্মবিশ্বাস, কবির সৃজন বেদন, আল মাহমুদের প্রবন্ধ। ভ্রমণ : কবিতার জন্য বহুদূর, কবিতার জন্য সাত সমুদ্র। আত্মজীবনীÑ যেভাবে বেড়ে উঠি। আল মাহমুদ পুরো একটি জীবন কবিতার পথে কাটিয়ে এখন প্রায় গোধূলিলগ্নে। কবিজীবনের সঙ্গে দারুণভাবে মিশে আছে বাংলাদেশের বাঁক-বদলের ইতিহাস। স্বদেশের শক্তি বুকে নিয়ে, চোখে জাতির স্বপ্ন দিয়ে এখনো তিনি লিখে চলছেন সমান তালে। কবি হয়েও পাঠকের কাছে চমৎকার ভাষায় পৌঁছে দিয়েছেন গল্প, উপন্যাস। তার গল্প থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে কলকাতায়।
বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে বাংলাকাব্যে অনবদ্য বহুমাত্রিকতার সৃজনশীলতার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য কবি আল মাহমুদ দেশের জাতীয় পদকসহ পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, জয়বাংলা পুরস্কার, হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরস্কার, সুফী মোতাহের হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, সমান্তরাল (ভারত) ভানুসিংহ সম্মাননা পদক, লেখিকা সঙ্ঘ পুরস্কার, হরফ সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার ইত্যাদি।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শুক্রবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে তিনি ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা