৩০ জুন ২০২৪, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ২৩ জিলহজ ১৪৪৫
`

বিশ্বের সবচেয়ে বিষধর ৭ সাপ সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

কিং কোবরা, যেটি বাংলাদেশে শঙ্খচূড় এবং রাজ গোখরা নামেও পরিচিত - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে দুই দশক আগে বিলুপ্ত ঘোষণা করা রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ অন্যগুলোতেও সাপটি নিয়ে বেশ আলোচনা হতে দেখা যাচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই দাবি করছেন, রাসেল ভাইপার বিশ্বের দ্বিতীয় ভয়ানক বিষধর সাপ। যার কামড়ে অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের মৃত্যু হয়।

কিন্তু এটি আসলেই কি বিশ্বের দ্বিতীয় ভয়ানক বিষধর সাপ? শীর্ষ বিষধর সাপের তালিকায় আর কোন কোন সাপ রয়েছে? সেগুলোর সবক’টি কি বাংলাদেশে দেখা যায়?

এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক, পৃথিবীতে ঠিক কত প্রজাতির সাপ আছে এবং সেগুলোর মধ্যে বিষধর সাপের সংখ্যাই বা কত?

বিশ্বে বিষধর সাপের সংখ্যা কত?
সাপ-বিষয়ক গবেষকরা বলছেন, বিশ্বে এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারের কিছু বেশি প্রজাতির সাপের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সাত শ’র কিছু বেশি প্রজাতির সাপের বিষ থাকলেও সবগুলোর কামড়ে মানুষ মারা যায় না।

এক ছোবলে মানুষের মৃত্যু হতে পারে, প্রকৃতিতে এমন বিষধর সাপের সংখ্যা মাত্র আড়াই শ’র কাছাকাছি বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৫৪ লাখ মানুষকে সাপে কামড়ায় বা দংশন করে, যার মধ্যে প্রায় ৮১ হাজার থেকে এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন।

এছাড়া যারা প্রাণে বেঁচে যান, তাদের মধ্যে কয়েক লাখ মানুষ অঙ্গহানি, পঙ্গুত্ববরণসহ শারীরিক ও মানসিক নানা ক্ষতির মুখে পড়েন।

গবেষকরা বলছেন, সাপে কাটার পর যথাসময়ে চিকিৎসা না দিতে পারার কারণে অনেকের অঙ্গহানি এবং মৃত্যু হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, সাপের কাপড়ে আহত বা নিহত হওয়া মানুষের মধ্যে বড় অংশই কৃষিকাজের সাথে যুক্ত।

তবে বয়স বিবেচনায় শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলেও জানাচ্ছে সংস্থাটি।

বিজ্ঞানীদের মতে, আনুমানিক ছয় কোটি বছর আগে বিবর্তনের একটি পর্যায়ে সাপের শরীরে প্রথমবার বিষ তৈরি হয়েছিল।

বর্তমানে পৃথিবীতে যে আড়াই শ’ প্রজাতির বিষধর সাপের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে শীর্ষ বিষধর সাপের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে বিজ্ঞান-বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘লাইভ সায়েন্স’।

নিউইয়র্ক-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির ওই তালিকায় রাসেল ভাইপারের নাম রয়েছে ছয় নম্বরে। আর তালিকার শীর্ষে দেখা যাচ্ছে, তাইপান প্রজাতির দু’টি সাপের নাম।

ইনল্যান্ড তাইপান
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব নিউরোফার্মাকোলজির বরাত দিয়ে লাইভ সায়েন্স জানাচ্ছে, ইনল্যান্ড তাইপানই এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বিষধর সাপ।

যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণি-বিষয়ক সাময়িকী ‘বিবিসি ওয়াইল্ড লাইফ ম্যাগাজিনের’ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক ছোবলে এই সাপ যে পরিমাণ বিষ বের করে, তা প্রাপ্তবয়স্ক অন্তত ১০০ জন মানুষকে মারার জন্য যথেষ্ট।

ইনল্যান্ড তাইপান

ইনল্যান্ড তাইপানের বসবাস অস্ট্রেলিয়ায়।

দেশটির সরকারের তথ্যমতে, কুইন্সল্যান্ড এবং দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার প্লাবনভূমি এলাকায় এদের দেখা পাওয়া যায়।

লোকালয় থেকে দূরে নির্জন এলাকায় এদের বসবাস। ফলে মানুষের সাথে খুব একটা দেখা হয় না। জীবনের জন্য হুমকি বোধ না করলে ইনল্যান্ড তাইপান সাধারণত আক্রমণ করে না বলেও জানাচ্ছে লাইভ সায়েন্স।

তবে কখনো আক্রমণ করতে হলে প্রথমে নিজেকে গুটিয়ে কুণ্ডলি আকার ধারণ করে, যা দেখতে অনেকটা ইংরেজি অক্ষর ‘এস’-এর মতো।

কোস্টাল তাইপান
তাইপান পরিবারের এই সাপটিরও আবাসভূমি অস্ট্রেলিয়ায়। দেশটির নাতিশীতোষ্ণ এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের উপকূলবর্তী স্যাঁতসেঁতে বনভূমিতে এদের বসবাস।

অস্ট্রেলিয়ার সরকারের তথ্যমতে, কোস্টাল তাইপান অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতিতে দৌঁড়াতে পারে।

কোস্টাল তাইপান

ফলে বেশিভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু বুঝে ওঠার আগেই এরা কামড় বা বিষদাঁত বসিয়ে দিয়েছে। আক্রমণ করার সময় এদেরকে অনেক সময় পুরো শরীর বাতাসে ভাসিয়ে লাফ দিতেও দেখা যায়।

১৯৫৬ সালে বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত এই সাপের কামড় খাওয়া মানুষ খুব একটা বেঁচে ফিরত না বলে অস্ট্রেলিয়ার সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে।

কিং কোবরা
লন্ডনের ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম’-এর তথ্যমতে, কিং কোবরা হচ্ছে বিশ্বের দীর্ঘতম বিষধর সাপ।

বাংলাদেশে এদেরকে শঙ্খচূড় এবং রাজ গোখরা নামেও ডাকা হয়ে থাকে।

এরা সর্বোচ্চ ১৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।

কিং কোবরা

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চীন, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইনসহ এশিয়ার অনেক দেশেই এদের বিচরণ রয়েছে। এই সাপ সাধারণত ঘন জঙ্গল ও পাহাড়ি এলাকায় থাকতে পছন্দ করে।

অন্যান্য সাপের তুলনায় বেশ দূর থেকেই যেকোনো জীবের উপস্থিতি টের পাওয়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে কিং কোবরার। এমনকি প্রায় ১০০ মিটার দূর থেকেও এরা শিকারের নড়াচড়া টের পায়।

নিজের জীবনের জন্য হুমকি মনে করলে কিং কোবরা আক্রমণ করে বসে। আক্রমণের আগে এরা শরীরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মাটি থেকে ওপরে তোলে এবং ফনা তুলে ‘হিসহিস’ শব্দ করে।

এভাবেই তেড়ে গিয়ে এরা শিকারের শরীরে পরপর বেশ কয়েকবার দংশন করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের শিক্ষক ও জীববিজ্ঞানী শন ক্যারল বলেন, প্রতিবার ছোবলে একটি কিং কোবরা যে পরিমাণ বিষ ঢেলে দেয়, সেটি একটি পূর্ণবয়স্ক হাতিকে কয়েক ঘণ্টায় এবং একজন মানুষকে মাত্র ১৫ মিনিটেই মেরে ফেলতে পারে।

কিং কোবরার বিষে নিউরোটক্সিক রয়েছে। এটি শরীরকে ধীরে ধীরে অবশ করে ফেলে এবং মানুষ মারা যায়।

ব্যান্ডেড ক্রেইট
লাইভ সায়েন্সের শীর্ষ বিষধর সাপের তালিকায় চার নম্বরে রয়েছে ব্যান্ডেড ক্রেইট। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এটি ডোরা কাটা শঙ্খিনী, ডোরাকাটা কাল কেউটে, শাঁকিনী, শাঁখামুটি ইত্যাদি নামেও পরিচিত।

বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং ভুটান ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই এদের বিচরণ লক্ষ্য করা যায়।

ব্যান্ডেড ক্রেইটের শরীরে কালো এবং হলুদ রঙের ডোরাকাটা দাগ থাকে, যার মাধ্যমে সহজেই এদেরকে চিহ্নিত করা যায়।

ব্যান্ডেড ক্রেইট

সমতল এবং পাহাড়ি- উভয় এলাকায় এদের দেখা যায়। বাড়ির আশপাশের বিভিন্ন ঝোপঝাড়, কাঠের মাঁচা ইত্যাদি শুকনো জায়গায় এরা থাকতে পছন্দ করে।

ব্যান্ডেড ক্রেইট সাধারণত শান্ত স্বভাবের হয়ে থাকে।

দিনের বেলা এরা ধীরগতিতে চলাচল করে এবং রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করতে পছন্দ করে। এই সাপ অন্য প্রজাতির সাপ ধরে খেয়ে ফেলে।

এর বিষে শরীরের পেশিগুলো ক্রমশঃ অবশ হয়ে আসে এবং মানুষ নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মারা যায়।

স-স্কেলড ভাইপার
ভারতে প্রতিবছর সাপের কামড়ে যত মানুষ মারা যান, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশই মারা যান স-স্কেলড ভাইপারের কামড়ে।

মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও ভাইপার প্রজাতির এই সাপ দেখা যায়।

এরা দ্রুতগতিতে চলাচল করতে পারে। এরা সাধারণত মানুষজন এড়িয়ে চলে। তবে আক্রান্ত বোধ করলে দ্রুত আক্রমণ করে বসে।

হুমকি মনে করলে ভাইপার প্রজাতির অন্যান্য সাপ ‘হিসহিস’ শব্দ করলেও, এরা সেটি করে না। তার বদলে শরীরের আবরণ বা খোলসে ঘষা দিয়ে ভিন্নরকম শব্দ করে।

স-স্কেলড ভাইপার

এই সাপে কামড়ানোর পর ক্ষতস্থানটি ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়ে থাকে। এর বিষে স্নায়ু অবশ হয়ে আসে এবং শরীরের অভ্যন্তরে রক্তপাত ঘটে।

এতে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যায়।

রাসেল ভাইপার
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মানুষ সবচেয়ে বেশি যে চারটি সাপের দংশনের শিকার হয়, রাসেল ভাইপার সেগুলোরই একটি।

ভারতীয় কোবরা বা গোখরা সাপ, ক্রেইট বা কেউটে, স-স্কেলড ভাইপার এবং রাসেল ভাইপারকে গবেষকরা একত্রে ‘দ্য বিগ ফোর’ নামে ডেকে থাকেন।

এর মধ্যে রাসেল ভাইপারকে বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া এবং উলুবোড়া নামেও ডাকা হয়ে থাকে।

কয়েক দশক আগে বাংলাদেশে এই সাপটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকায়, বিশেষ করে পদ্মা তীরবর্তী জেলা ও চরাঞ্চলে এই সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

গবেষকরা বলছেন, রাসেলস ভাইপার ভালো সাঁতার কাটে।

এই সাপ এক সাথে তিন থেকে ৬৩টি পর্যন্ত বাচ্চা দিয়ে থাকে। এদের গর্ভধারণকাল ছয় মাস এবং বাচ্চা দু’বছরের মধ্যে পরিপক্ব হয়ে ওঠে।

এই সাপটি সাধারণত নিশাচর বা রাতে চলাচল করতে পছন্দ করে এবং এরা মানুষের বসতবাড়ি এড়িয়ে চলে।

থাকার জন্য ঝোপ-ঝাড়, ফসলের গোলা কিংবা জমির বড় গর্ত এদের পছন্দ।

রাসেল ভাইপার

কাছাকাছি কেউ গেলে এরা ‘হিসহিস’ শব্দ করে। ইঁদুরসহ অন্যান্য শিকার ধরার জন্য এরা ধানক্ষেত এবং এর আশপাশের এলাকাতেও এরা বসবাস করে থাকে।

ফলে ভারত এবং শ্রীলঙ্কায় কৃষকরাই এই সাপের দংশনের শিকার হয় বেশি। ইদানিং বাংলাদেশেও একই ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

এই সাপ কাটলে স্নায়ু অবশ হয়ে আসে এবং ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ বাড়তে থাকে। এর ফলে ক্রমান্বয়ে ফুসফুস এবং কিডনি আক্রান্ত হয়ে ব্যক্তি মারা যায়।

ইস্টার্ন টাইগার
দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার পার্বত্য এবং তৃণভূমি এলাকায় ইস্টার্ন টাইগার সাপ দেখা যায়।

গবেষকরা বলছেন, এই প্রজাতির সাপের শরীরে হলুদ এবং কালচে রঙের ডোরাকাটা দাগ দেখা যায়, যা অনেকটা বাঘের মতো। আর সে কারণেই এদের টাইগার নামে ডাকা হয়।

ইস্টার্ন টাইগার

অস্ট্রেলিয়ার দ্য ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেডের এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই সাপের বিষ এতটাই ভয়ানক যে এটি দংশনের মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই মানুষের শরীর অবশ হয়ে পড়ে।

তবে এরা নির্জন স্থানে বসবাস করায় মানুষের সাথে খুব একটা দেখা হয় না। ফলে মৃত্যুও খবরও সচরাচর পাওয়া যায় না।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement