কেন ওভারটোন সেতুতে আত্মহত্যা করে কুকুররা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৭ অক্টোবর ২০২১, ১৭:২৬, আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৪৫
ওভারটোন সেতু। স্কটল্যান্ডের ডাম্বার্টন শহরের কাছেই অবস্থিত এটি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এইচ ই মিলনারের করা নকশায় ১৮৯৫ সালের জুন মাসে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় সেতুটির। নির্মাণের সময় কারো কাছে এর আকর্ষণ না থাকলেও ৬০-এর দশকে সাধারণ মানুষ ও মিডিয়ায় বেশ আলোচনায় আসে সেতুটি। সেই সময় অজানা কোনো কারণে ৫০ ফুট উঁচু এই সেতু থেকে লাফিয়ে কমপক্ষে ৫০টি কুকুর আত্মহত্যা করে।
এই সেতুকে বলা হয়ে থাকে ‘মৃত্যুর সেতু’। জানা যায়, ৫০টি কুকুর লাফিয়ে পড়ে মারা গেলেও আজ পর্যন্ত ৬০০ কুকুর সেতুটি থেকে লাফিয়ে পড়েও বেঁচে যায়। তবে বেঁচে যাওয়া কুকুরগুলো আবারো লাফিয়ে পড়েছিল বা লাফ দেয়ার চেষ্টা করেছিল।
অ্যালিস ট্রিভরো ও তার ছেলে থমাসের সাথে সেতুটিতে গিয়েছিল ৩ বছর বয়সী কুকুর ক্যাসি। গাড়ির দরজা খোলা মাত্রই হঠাৎ ক্যাসি সেখান থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে যায়। এরপর থমাস নিচের দিক তাকিয়ে শুধু বিন্দু বিন্দু কিছুর উপস্থিতি বুঝতে পারেন। তবে কিভাবে কুকুরটি বেঁচে যায় তা অ্যালিস ও থমাস কেউই জানতে পারেননি।
এ দিকে ক্যাসি বেঁচে গেলেও সেতু থেকে লাফিয়ে পড়ে বাঁচেনি ডনা কুপারের কুকুর বেন। সে সময় বেনের পা, চোয়াল ও কোমর ভেঙে গিয়েছিল। চিকিৎসকের পরামর্শে কুকুরটির ইউথেনেশিয়া বা ব্যথাবিহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা করা হয়।
তবে লাফানো কুকুরগুলোর কিছু নির্দিষ্ট ধরণও চিহ্নিত করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কুকুরগুলো লাফিয়ে অমসৃণ পাথরের উপর পড়ে এবং তাদের সলিল সমাধি ঘটে। তবে সব ধরনের কুকুরের মাঝে লাফিয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায় না। সাধারণত লম্বা নাকের অধিকারী জাতের কুকুরগুলোই লাফ দেয়। এই কুকুরগুলোর ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রখর। এছাড়াও সবগুলো ঘটনা সেতুটির ডানপাশের একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে ঘটে থাকে। আর ঘটনার দিনটি হয় রৌদ্রোজ্জ্বল দিন।
কেন বা কি কারণে কুকুরগুলো লাফিয়ে আত্মহত্যা করে সে বিষয়ে সঠিক কোনো ধারণা না থাকলেও স্থানীয়রা মনে করেন, ভূতুড়ে কোনো আত্মার দেখা পেয়ে অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে কুকুরগুলো এমনভাবে লাফিয়ে পড়ে। তাদের দাবি, সেতুটির পাশে অবস্থিত শত বছরের পুরনো গোথিক প্রাসাদটিই দায়ী। ওই প্রাসাদটি ওভারটোন হাউজ নামেও পরিচিত। জানা যায়, ওভারটোন হাউজটি প্রায় ১৬০ বছর সিনেমার শুটিং, মাতৃসদন হাসপাতাল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।
প্রচলিত বিশ্বাস হলো- এই ওভারটোন হাউসেও প্রেত-আত্মার দেখা মেলে। স্থানীয়দের ধারণা, সেই প্রেত-আত্মার দেখা পেয়েই কুকুরগুলো লাফিয়ে পড়ে।
পল ওয়েন্স ধর্ম ও দর্শনের শিক্ষক। তিনি একবার সেতুটির উপর একাকি দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ তিনি দৃঢ় ও কঠিন আঙ্গুলের মতো কিছু একটা অনুভব করেন। পরে তার মনে হতে থাকে, কিছু একটা বা কেউ একজন তাকে সেতুটি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে!
ওই শিক্ষক মনে করেন ‘লেডি ওভারটোনের আত্মা এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে, যারা স্বামী-স্ত্রী একসাথে ওভারটোন হাউজে থাকতেন। ১৯০৮ সালে লেডি ওভারটোনের স্বামীর মৃত্যুর পরও তার স্ত্রীকে সেতু বরাবর হাঁটতে দেখা যায়।
মেরি আর্মোর। ভৌতিক বিষয়ে কাজ করেন তিনি। ওভারটোন সেতুর ঘটনার সত্যতা পরীক্ষায় তিনি তার কুকুর নিয়ে যান সেখানে। তবে প্রেত- আত্মার কোনো প্রমাণ পাননি তিনি। তিনি বলেন, জায়গাটিতে খুবই নীরবতা ও প্রশান্তি মেলে। তবে অজানা কোনো কারণে তার কুকুরটি তাকে সেতুর ডানদিকে টানছিল!
তবে সেতুটিকে ভূতুড়ে বলেই বিশ্বাস করেন বেশিরভাগ মানুষ। স্থানীয়দের এই বিশ্বাস আরো বৃদ্ধি পায় ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর এক ঘটনার পর। সে সময় কেভিন ময় নামক ৩২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি, তার ২ সপ্তাহ বয়সী শিশুকে সেতু থেকে হঠাৎ ছুঁড়ে ফেলে দেন! কারণ তিনি ভাবতেন তার সন্তানটি ছিল শয়তান। ময় বলেন, তার সন্তানের মাথায় শয়তানের আঁকা জন্মদাগ ছিল। শিশুটি বেঁচে থাকলে ভাইরাস ছড়িয়ে বিশ্বকে ধ্বংস করবে। ছুঁড়ে ফেলার এক দিন পর হাসপাতালে মৃত্যু হয় শিশুটির।
পরে ওই সময় পুলিশ ও আদালত এ ঘটনায় ময়কে তেমন কোনো শাস্তি দেয়নি। কারণ মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, ঘটনার সময় ময় উন্মত্ততা ও বিণ্ণতায় ভুগছিলেন। কিন্তু বাচ্চার জন্মের পর, হাসপাতালে স্ত্রী এয়লিন এবং ছেলে শিশু ইওঘানকে যেদিন দেখতে যান সেদিনও কোনো বিষণ্ণতার ছাপ দেখা যায়নি ময়ের। আর ঘটনার দিন স্ত্রী, পুত্র নিয়ে দাঁড়ান ওভারটোন সেতুর উপর। হঠাৎ ছেলেকে ছুঁড়ে ফেলে দেন উঁচু সেতু থেকে। পরে নিজেও লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্ত্রী তাকে টেনে ধরে লাফ দেয়া থেকে বিরত রাখেন। এই ঘটনাটিও ঘটেছিল রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে।
ড. ডেভিড স্যান্ডস কুকুরের আত্মহত্যার কারণ উদঘাটন করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ওভারটোন সেতুতে হেনড্রিক্স নামের একটি কুকুর নিয়ে যান। কুকুরটি পূর্বে সেতু থেকে লাফিয়ে পড়লেও বেঁচে গিয়েছিল। কুকুরটির বয়স ছিল ১৯ বছর। ফলে শরীরের শক্তি অনেক কমই ছিল। সেতুর উপর কুকুরের আচরণ পর্যবেক্ষণ করার জন্য হেনড্রিক্সকে ছেড়ে দিয়েছিলেন ডেভিড। তিনি লক্ষ্য করেন কুকুরটি খুশিমনে সেতুর উপর দিয়ে হাঁটছে। তবে কুকুরটি যখন সেই লাফিয়ে পড়ার স্থানটিতে পৌঁছায় তখন তা কিছুটা বিচলিত হয়ে ওঠে। কিন্তু কুকুরটি সেতু থেকে লাফিয়ে পড়ার মতো শক্তিশালী ছিল না। তাই লাফ দিতে পারেনি বলে মনে করেন ডেভিড।
ড. ডেভিড কুকুরগুলোর লাফিয়ে পড়ার জন্য তিনটি বিষয়কে দায়ী করেন। বিষয়গুলো হচ্ছে – সেতুর নিচের দৃশ্য, শব্দ ও কুকুরের ঘ্রাণশক্তি। কিন্তু র্যালিংয়ের গঠনশৈলীর জন্য কুকুরগুলো নিচে থাকা পাথরগুলো ঠিকমত দেখতে পারে না। তাই দৃষ্টির বিষয়টিকে শুরুতেই বাতিল করা হয়।
ডেভিড ও স্থানীয়দের অনেকেই মনে করেন, সেতুর অদূরে থাকা নিউক্লিয়ার প্লান্ট থেকে নির্গত শব্দ কুকুরের লাফিয়ে পড়ার জন্য দায়ী। তাছাড়াও নিকটেই থাকা টেলিফোনের উঁচু খুঁটি থেকে উদ্ভুত শব্দ, যা কেবলমাত্র কুকুরই বুঝতে পারে সেটির জন্যও এমনটি ঘটে বলে মনে করেন তারা। শব্দকে দায়ী করা হলে শব্দ বিশেষজ্ঞরা সেখানকার শব্দ পরীক্ষা করেন। কিন্তু তারা সেখানে তেমন কোনো শব্দ পাননি যার জন্য কুকুরগুলো মৃত্যুর মুখে লাফিয়ে পড়বে।
ডেভিডের দৃষ্টি ও শব্দের বিষয় দুটি প্রমাণিত না হলেও অনেকেই কুকুরের ঘ্রাণশক্তির বিষয়টি সঠিক বলে মনে করেন। ডেভিড দেখান সেতুর নিচে মিন্ক বা বেঁজির মতো একজাতীয় প্রাণী রয়েছে। প্রাণীগুলো পানিতেও কিছুক্ষণ সময়ের জন্য থাকে। সেগুলোর পায়ুসংক্রান্ত গ্রন্থী থেকে ঘ্রাণ বের হয়, যার দরুন কুকুরগুলো আকৃষ্ট হয়ে লাফিয়ে পড়ে। এই ঘ্রাণ রৌদ্রে আরো বেড়ে যায়।
যদি ঘ্রাণের বিষয়টা সত্যও হয় তথাপিও কিছু বিষয় প্রমাণিত হয় না। কারণ স্কটল্যান্ডে ২৬ হাজার মিন্ক রয়েছে। তাহলে অন্যান্য স্থানে কুকুরগুলো মিন্ক এর উপর লাফিয়ে পড়ে না কেন? এছাড়াও কুকুরগুলো কেন শুধুমাত্র সেতুটির একটি নির্দিষ্ট স্থান ও ডানপাশ থেকেই লাফিয়ে পড়ে? কাজেই ওভারটোন সেতু থেকে কুকুরের লাফিয়ে পড়ার কারণ আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। আর সে কারণে এখনো সেতুটিতে কুকুরকে সাবধানে রাখার সতর্ক বার্তা শোভা পাচ্ছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা