২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩ মাঘ ১৪৩১, ২৫ রজব ১৪৪৬
`

প্রিয়জন হারিয়ে মানুষ ছাড়াও শোক পালন করে যেসব প্রাণী

-

বিষাদকে দীর্ঘদিন ধরে মানবজীবনের বৈশিষ্ট্য বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। অর্কা বা ঘাতক তিমি থেকে শুরু করে কাক পর্যন্ত অনেক পশুপাখিই তাদের সন্তান ও সঙ্গীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে।

সম্প্রতি এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সাক্ষী হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেটের একটি উপকূলের লোকজন। সৈকতের কাছেই চোখে পড়ে এক মা অর্কা (কিলার হোয়েল বা এক জাতীয় তিমি) তার মৃত নবজাতক সন্তানকে ক্রমাগত ঠেলে নিয়ে চলছে।

গবেষকদের কাছে ‘তালেকোয়া’ নামে পরিচিত ওই তিমি। তাকে এর আগেও একইভাবে শোক পালন করতে দেখেছিলেন সেন্টার ফর হোয়েল রিসার্চের কর্মকর্তারা।

২০১৮ সালে আরেক নবজাতকের মৃত্যুর পর টানা ১৭ দিন ধরে তাকে ঠেলে নিয়ে শোক পালন করতে দেখা যায় তালেকোয়াকে। দিনে গড়ে ১২০ কিলোমিটার সাঁতরাতে পারে এই প্রজাতির তিমি।

তবে তিমিই যে একমাত্র প্রজাতি যারা নিজেদের মৃত সন্তানের দেহ বহন করে শোক পালন করে, এমনটা নয়।

২০২১ সালে এডিনবার্গের চিড়িয়াখানার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, সেখানকার এক শিম্পাঞ্জি মৃত শিশুর জন্ম দেয়। লিয়ান নামে ওই শিম্পাঞ্জি এই ক্ষতি মেনে নিতে পারেনি, সে তার মৃত সন্তানকে ছাড়তেও চায়নি। চিড়িয়াখানার ভেতরেই সন্তানের মৃতদেহ কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে।

‘বুদ্ধিমান’ হিসেবে বিবেচিত স্তন্যপায়ী প্রাণী ডলফিন ও বানরকেও একই ধরনের আচরণ করতে দেখা গেছে।

কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলসফি অফ কগনিটিভ সায়েন্সের বিশেষজ্ঞ গবেষক বেকি মিলার ব্যাখ্যা করেছেন, ‘প্রাণীদের এই আচরণকে শোকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার না করতে পারাটা কঠিন। মানুষ হিসেবে আমরা যখন কাছের কাউকে হারাই তখন যে কোনোভাবেই তাকে আঁকড়ে থাকতে চাই। প্রিয়জনের সাথে বন্ধনটা ধরে রাখার যে আকুতি, মূলত এটাই এখানে স্পষ্ট হয়।’

মিলারের মতে, পশুপাখিদের ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন নয় যে তাদের কোনো স্বজনের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে এবং তারা মৃত্যুর বিষয়টা অনুধাবন করতে পারছে না।

বেকি মিলার ব্যাখ্যা করেন, ‘এসব ক্ষেত্রে এমন একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয় যেটা থেকে পশুপাখিরা বেরিয়ে আসতে পারে না। যে ক্ষতির সম্মুখীন তারা হয়েছে সেটার সাথে লড়াই করার চেষ্টা করছে, আবার অন্যদিকে নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও চালাচ্ছে।’

স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে গ্রেফায়ার্স ববি নামে টেরিয়ার প্রজাতির এক কুকুর তার মালিকের কবর রক্ষা করে ১৪ বছর কাটিয়েছিল।

জাপানে মালিকের মৃত্যুর পরও দিনের পর দিন তার জন্য এক রেল স্টেশনে বসে অপেক্ষা করতো আকিতা প্রজাতির কুকুর হাচিকো।

নিকটজনকে হারানোর পর প্রাণীদের তীব্র যন্ত্রণা প্রকাশের অনেক কাহিনী রয়েছে। সন্তানকে ঘাতক তিমি খেয়ে ফেলছে এই দৃশ্য দেখে মা সি লায়ন হাহাকার জুড়েছে এমন খবরও পাওয়া যায়। এমন আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে।

নৃতত্ত্ববিদ বারবারা কিং তার বই ‘হাও অ্যানিমালস গ্রিভ’-এ ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে বিড়াল, কুকুর ও খরগোশরা প্রিয়জনের মৃত্যুর পর কান্নাকাটি করে এবং তাদের (মৃতদের) খুঁজতে থাকে। ঘোড়ার পালের কোনো সদস্যের মৃত্যু হলে তার কবরের চারপাশে অন্যদের জড়ো হওয়ার বিষয়েও তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন তিনি।

ভারতেও একই ঘটনা দেখা গেছে। ১৯৯৯ সালে ভারতের এক চিড়িয়াখানায় দামিনী নামে এক বয়স্ক স্ত্রী হাতির মৃত্যু হয়েছিল মনকষ্টের কারণে। তার তুলনায় কম বয়সী অন্য এক সন্তান সম্ভবা হাতির সাথে সখ্য গড়ে উঠেছিল দামিনীর।

সন্তান প্রসবের সময় ওই হাতির মৃত্যুর পর বন্ধুর দেহকে আগলে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল দামিনীকে। খাবারের প্রতি অনীহা জন্মায় তার এবং একসময় খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়ায় দামিনীরও মৃত্যু হয়।

১৯৭২ সালে জেন গুডল নামে এক ইংরেজ প্রাইমেটোলজিস্ট, যারা মূলত বানরের মতো স্তন্যপায়ী প্রজাতি নিয়ে গবেষণা করেন, শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে প্রথম এমন লক্ষণ দেখতে পান যেমনটা মানুষের ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে দেখা যায়। গুডল ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জঙ্গলে শিম্পাঞ্জি নিয়ে গবেষণা করেছেন।

ফ্লিন্ট নামে পরিচিত এক অল্পবয়সী শিম্পাঞ্জি তার মাকে হারানোর পর তার মধ্যে ওই লক্ষণ দেখতে পান গুডল। ফ্লিন্ট তার দলের অন্যান্য শিম্পাঞ্জিদের সাথে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দেয় সে এবং শেষ পর্যন্ত এক মাস পর তার মৃত্যু হয়।

শুধু পশু নয়, পাখিরাও দুঃখ পায়। অস্ট্রিয়ান প্রাণিবিদ কনরাড লরেঞ্জ বর্ণনা করেছেন, সঙ্গী হারানোর পর গ্রেল্যাগ গিজ বা ধূসর রাজহাঁসের মধ্যে যে আচরণ দেখা যায় তা অনেকটা শোকসন্তপ্ত মানুষের আচরণের মতোই।

হতাশায় এই রাজহাঁসদের মাথা নুয়িয়ে রাখতে দেখা যায়। তারা খাবারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং চারপাশের জগতের প্রতি উদাসীনও হয়ে যায়।

শুধু চোখের দেখাই নয়, গবেষণাতেও দেখা গেছে যে প্রাণীরা দুঃখের মতো আবেগ অনুভব করে। ল্যাবরেটরির গবেষণায় দেখা যায়, মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর শিশু প্রাইমেটরা (বানর, শিম্পাঞ্জির মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীরা) হাহাকার বা কান্নাকাটি করে। তারা পারিপার্শ্বিক পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অন্যদের সাথে আর খেলাধুলা করে না, নতুন কোনো জিনিস দেখলে তা এড়িয়ে যায় এবং নিজের মধ্যেই কুঁকড়ে থাকে।

অন্য একটা গবেষণায় দেখা গেছে, নিকটাত্মীয়কে হারানো স্ত্রী বেবুনদের মধ্যে স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এমনটা কিন্তু শোকাহত মানুষের মধ্যেও লক্ষ্যণীয়।

মানুষ যেভাবে কারো মৃত্যুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করে থাকে অনেকটা তেমন আচরণ করতে দেখা যায় কিছু কিছু প্রাণীকেও।

যেমন হাতিদের দেখা যায় মৃতদের দেহ যেখানে রয়েছে, সেই স্থান তারা পরিদর্শন করতে আসে; তা সে তাদের নিকট কেউ হোক, দলের সদস্য কিংবা একেবারে অপরিচিত হাতি। তারা মৃত হাতির দেহাবশেষ স্পর্শ করে, মৃদু ধাক্কা দেয় এবং কঙ্কালের পাশে দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন দেহাবশেষকে পাহারার দিচ্ছে তারা।

শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মৃত শিম্পাঞ্জির মুখ ও শরীর পরিষ্কার করে দিতে। শোনা যায় কাক, ম্যাগপাইরা তাদের স্বজনের মৃতদেহের চারপাশে জড়ো হয়, কখনো কখনো মৃতদেহের কাছে পাতা বা ডালপালা রাখে, যেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হচ্ছে।

কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশনারি বায়োলজির এমেরিটাস অধ্যাপক মার্ক বেকফ বলেন, ‘কয়েক বছর আগে আমি আমার এক বন্ধুর সাথে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন লক্ষ্য করি একটা মৃত ম্যাগপাইকে বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছিল চার-পাঁচটা ম্যাগপাই।’

তারা মাথা নিচু করে মৃতদেহকে ঘিরে রেখেছিল, যেন হালকা খোঁচা দিচ্ছে। তারপর একটা ম্যাগপাই উড়ে গিয়ে কিছু ডালপালা আর গাছের পাতা নিয়ে আসে। তার দেখাদেখি আরেকটা পাখি একই কাজ করল এবং এরপর তারা সবাই এটাই করে। তারপর এক সময় তারা থেমে যায়, মাথা সামান্য নিচু করে রাখে ও উড়ে যায়।’

তবে এই সমস্ত আচরণকে সত্যিই দুঃখপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হবে কি না তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে আপনি কিভাবে বিষয়টাকে দেখছেন তার ওপর। এই দার্শনিক প্রশ্ন নিয়েও বিস্তর বিতর্ক রয়েছে।

সম্প্রতি এই বিষয়ে নিবন্ধ লিখেছেন বেকি মিলার। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, দুঃখ সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয়, কিন্তু শোক দীর্ঘাস্থায়ী যা কয়েক মাস বা বছর ধরে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে আরো একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো অনেক সময় একাধিক অনুভূতি ঘিরে ধরে শোকাহত ব্যক্তিকে।

মিলারের কথায়, ‘আপনি দুঃখ অনুভব করতে পারেন এবং একইসাথে রাগ বা অন্যান্য আবেগও অনুভব করতে পারেন। এমনকি আশার মতো আবেগও অনুভব করা যায়।’

দার্শনিকদের মধ্যে কেউ কেউ যুক্তি দেখান, কিছু প্রাণী নিঃসন্দেহে সঙ্গী হারানোর পরে কষ্ট অনুভব করে। তবে শোক অনুভব করতে গেলে যতটুকু বোধ থাকা উচিত তার অভাব রয়েছে পশুপাখিদের মধ্যে।

মিলার উল্লেখ করেছেন, এই সংজ্ঞা অনযায়ী শুধু যে পশুপাখিদের বাদ দেয়া হয়েছে তাই নয়, শিশু ও কিছু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষও বাদ রয়ে গেছেন।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না শোকাহত ব্যক্তিদের সবাই মৃত্যুর মতো বিচ্ছেদ ব্যাথার সাথে কুলিয়ে পারেন। শিশুদের অনেকেই কাছের কাউকে হারানোর পর ক্ষতিটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু তার মানে এটা বলা ভুল হবে যে তাদের দুঃখ কোনো অংশে কম।’

তার নিবন্ধে বেকি মিলার দুঃখকে ব্যাখ্যা করেছেন, ওই অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার পর ব্যবহারিক জীবনে (বিশেষত আমূলভাবে পরিবর্তিত বিশ্বে) কিভাবে মানিয়ে নেয়া শিখতে হয়, তার সাথে।

মিলারের মতে, অভিযোজনের এই ব্যবহারিক প্রক্রিয়া পশুপাখিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। কারণ এই বিষয়গুলো বোঝার জন্য বিরাট জ্ঞান বা বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না।

সব মিলিয়ে শেষ মিলার বিশ্বাস করেন, অনেক পশুপাখিই দুঃখ অনুভব করতে সক্ষম।

তার কথায়, ‘আমি মনে করি, পশুপাখিরা একে অপরের সাথে তাদের জীবন ভাগ করে নিতে পারে এবং সেই অপর পশু বা পাখির ওপর তাদের আচরণও নির্ভর করতে পারে।

সুতরাং সঙ্গীর মৃত্যু হলে, তাদের (সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে) জগতকে বোঝার এবং পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সব কিছু নতুনভাবে শেখার যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া রয়েছে তার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement