২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ফ্যাসিবাদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য

ইতালির মুসোলিনি (বামে) এবং জার্মানির হিটলার (ডানে)। - সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ফ্যাসিস্ট’ এখন বহুল উচ্চারিত শব্দ। আওয়ামী লীগ-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনার সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট সরকার’ হিসেবে বর্ণনা করছে।

যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেছে তাদের ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশর রাজনীতিতে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি কেন ব্যবহার হচ্ছে? প্রকৃতপক্ষে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি কোথা থেকে এসেছে? শেখ হাসিনার শাসনামলের সাথে ফ্যাসিস্টদের কোন মিল আছে?

‘ফ্যাসিজম’ বা ‘ফ্যাসিবাদ’ কী?
ইতালিয় শব্দ ‘ফ্যাসিমো’ এসেছে ‘ফ্যাসিও’ থেকে। অন্যদিকে ‘ফ্যাসিও’ শব্দটি এসছে ল্যাটিন শব্দ ‘ফ্যাসেস’ থেকে। এর অর্থ লাঠি, কাঠ বা রডের আটি, যেটি একত্রে বেঁধে রাখা হয়।

‘ফ্যাসেস’ থেকে ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলের নামকরণ হয়েছে। ঐক্য বোঝাতে এ ধরনের প্রতীক ব্যবহার করা হয়। এর অর্থ হচ্ছে, এক বান্ডেল কাঠ ও রড যখন একসাথে বেঁধে রাখা হয় তখন সেটিকে ভাঙা যায় না। কিন্তু একটি রড বা কাঠ ভেঙে ফেলা যায়।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বলা হয়েছে, ‘ফ্যাসিজম’ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং গণআন্দোলন, যেটি ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সদর্প উপস্থিতি ছিল।

‘ফ্যাসিজম’ বা ‘ফ্যাসিবাদ’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উগ্র-ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটে ইউরোপে। এই মতাদর্শে বিরোধীদের কোন জায়গা ছিল না। কর্তৃত্বময় শাসন ক্ষমতাই ছিল ‘ফ্যাসিবাদ’ এর মূলমন্ত্র।

‘ফ্যাসিবাদ’ সবসময় মন করতো যে রাষ্ট্রই সব, এখানে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের কোনো স্থান নেই। এর মাধ্যমে তারা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করতো, ক্ষমতাকে একটি কেন্দ্রে আবদ্ধ রাখতো।

ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি কিভাবে?
‘ফ্যাসিজম’ বা ‘ফ্যাসিবাদ’ ধারণাটির উৎপত্তি হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালিতে। এরপর এই মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে জার্মানি এবং ইউরোপের আরো বিভিন্ন দেশে।

জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে ‘নাৎসিজম’ বা ‘নাৎসিবাদ’-এর উত্থান হয়। এটি ছিল ‘ফ্যাসিজম’-এর একটি রূপ।

‘ফ্যাসিবাদ’ উত্থানের মধ্য দিয়ে ইউরোপে হিটলার ও মুসোলিনির মতো বিতর্কিত নেতার উদ্ভব হয়।

ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ
ইউরোপের প্রথম ফ্যাসিস্ট নেতা ছিলেন ইতালির বেনিতো মুসোলিনি। ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য একটি আরেকটির চেয়ে আলাদা। যদিও তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য একই রকম।

যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনির্ভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ ২০০৪ সালে প্রকাশিত রবার্ট পেক্সটন তার এনাটমি অব ফ্যাসিজম বইতে লিখেছেন, ১৯১৯ সালের ১৫ এপ্রিল এক বৈঠকের পর মুসোলিনির একদল বন্ধু ও সহচর মিলে ইতালির মিলান শহরে অবস্থিত সমাজতন্ত্র সমর্থিত একটি পত্রিকা অফিসে আক্রমণ করে।

মুসোলিনি ১৯১২ থেকে ১৯১৪ সালে নিজেই পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। ওই হামলায় চারজন নিহত হয়। এ ঘটনা এবং তার পরবর্তীতে সমাজতন্ত্রী ও বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মাধ্যমে ইতালির ‘ফ্যাসিজম’ মতবাদ ইতিহাসে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়।

তাদের যুক্তি ছিল দেশের ভালোর জন্যই তারা এসব করছে। পত্রিকা অফিসে হামলার তিন বছর পরেই মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট পার্টি ইতালির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। এর ১১ বছর পর আরেকটি ফ্যাসিস্ট পার্টি জার্মানির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে।

মুসোলিনি ছিলেন এক স্কুল শিক্ষক, একজন প্রথাবিরোধী লেখক, সমাজতন্ত্রের পক্ষে একজন বক্তা এবং পত্রিকার সম্পাদক।

ক্ষমতার আসার ১৬ বছর পর্যন্ত মুসোলিনির মধ্যে ইহুদি-বিরোধী কোনো মনোভাব ছিল না। বড় শিল্পপতিদের মধ্যে যারা ইহুদি ছিলেন এবং অনেক জমির মালিক ছিলেন তারা শুরুর দিকে মুসোলিনিকে সহায়তা করেছিল।

ফ্যাসিজমকে মনে করা হতো পুঁজিবাদবিরোধী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিস্ট পার্টি ক্ষমতা নেয়ার পর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তেমন কিছুই করেনি। তারা বেশি চড়াও হয়েছে সমাজতন্ত্রীদের ওপর।

ক্ষমতায় আসার পর ফ্যাসিস্টরা ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে, শ্রমিক সংগঠনগুলো ভেঙে দেয় এবং অস্ত্র বানানোর খাতে প্রচুর অর্থ দিতে থাকে।

ক্ষমতায় আসার পরে ফ্যাসিস্টরা রাজনৈতিকবিরোধী, বিদেশী এবং ইহুদিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ ধারণ করা ইউরোপের বড় রাজনৈতিক দলগুলো ভেঙে যায়। ইতালি এবং জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট দলকে নিষিদ্ধ করা হয়।

হিটলারের ন্যাশনাল সোশালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পাটিও ফ্যাসিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিতি ছিল।

ফ্যাসিস্টদের বৈশিষ্ট্য কী ছিল
অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ফ্যাসিজম-এর সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নেই।

ফ্যাসিস্টরা মার্ক্সবাদীদের বিরোধী ছিল। শুধু বিরোধীতা নয় মার্ক্সবাদীদের রীতিমতো ঘৃণা করত ফ্যাসিস্টরা। এই দু’টির মধ্যে বিরোধ থাকলেও অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, ফ্যাসিস্ট এবং সোভিয়েত কমিউনিজমের মধ্যে অনেক মিল ছিল।

ফ্যাসিজম এবং সোভিয়েত কমিউনিজম- দু’টিই এসেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক দশা, গণআন্দোলন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে।

ক্ষমতা গ্রহণের পরে তারা উভয় একচ্ছত্র আধিপত্য সৃষ্টি করেছিল। তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এ দু’টির মধ্যে খুব বেশি মিল খোঁজার চেষ্টা করা ঠিক হবে না।

ফ্যাসিস্টরা সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরোধী ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগে হিটলার ও মুসোলিনি দু’জনেই নির্বাচনের রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার আগ্রহী ছিলেন।

ফ্যাসিস্টরা চায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ। যেমন হিটলার ক্ষমতা নেয়ার পর শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাই নিয়ন্ত্রণ করতে চাননি, এর পাশাপাশি তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন। এসব প্রতিষ্ঠান একসময় স্বাধীন হিসেবে বিবেচিত হতো। যেমন চার্চ, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়, সামাজিক ক্লাব, খেলাধুলার প্রতিষ্ঠান- সবকিছুতেই নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন হিটলার।

ফ্যাসিস্ট দলগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল জনসমাবেশ করে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করা করা। এর মাধ্যমে তারা দেখাতে চাইতো যে জনগণ তাদের পাশে আছে। সে জন্য তারা প্রায়ই বড় আকারের জনসমাবেশ, প্যারেড আয়োজন করত।

ইতালির মুসোলিনি, জার্মানির হিটলার এবং পর্তুগালের সালজার সরকার জনসভার আয়োজন করত।

ফ্যাসিস্ট দলগুলো সবসময় এক ব্যক্তির সর্বময় কর্তৃত্ব ও শাসনে বিশ্বাস করত। তার মনে করত, রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং রাষ্ট্রের প্রধান একই ব্যক্তি থাকবেন, যার হাতে সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকবে। যেমন হিটলার ও মুসোলিনি যেটা মনে করতেন সেটাই সবাইকে মানতে হবে।

তরুণদের শক্তি সামর্থ্যকে সবসময় প্রশংসা করত ফ্যাসিস্টরা। তারা তরুণদের বোঝাতে চাইতেন যে সবকিছু দেশের জন্য হচ্ছে। তারা নানা বিষয় নিয়ে তরুণ প্রজন্মকে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন।

ফ্যাসিস্টরা সবসময় তাদের সমালোচনার জবাব দিতেন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে।

দেশে যেকোনো সমস্যার জন্য ফ্যাসিস্টরা অন্যের ওপর দোষ চাপাতে পছন্দ করতেন। এ জন্য তারা কাউকে না কাউকে বলির পাঠা বানাতেন। যেকোনো সমস্যার উদ্ভব হলেই সেটি মার্ক্সবাদী, অভিবাসীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হতো।

মার্কিন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী লরেন্স ব্রিট-এর মতে ‘ফ্যাসিবাদ’-এর ১৪টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিম্নরূপ:

জাতীয়তাবাদের ক্রমাগত প্রচার : ফ্যাসিস্ট শাসনামলে দেখা যায়, দেশাত্মবোধক এবং জাতীয়তাবাদী গান, স্লোগান কিংবা প্রতীক ক্রমাগত ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে তারা মানুষকে দেখাতে চায় যে দেশকে তারা কতটা ভালোবাসে।

মানবাধিকার হরণ : রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ফ্যাসিস্টরা মানবাধিকারকে অবজ্ঞা করে। তারা মনে করে ‘প্রয়োজনের স্বার্থে’ মানবাধিকার উপেক্ষা করা যায়।

সেনাবাহিনীকে সুবিধা দেয়া : দেশের ভেতরে নানা সঙ্কট থাকলেও ফ্যাসিস্টরা সেনাবাহিনীকে পেছনে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি খরচ করে। তাদের নানা সুবিধা দেয়া হয়। সেনাবাহিনীর চাকরিকে গ্ল্যামারাইজ করা হয়।

গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ : অনেক সময় তারা গণমাধ্যমকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে সরাসরি চাপ করা হয় এবং বিভিন্ন আইন-কানুনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপানো হয়।

কর্পোরেট স্বার্থ : ফ্যাসিস্টদের শাসনামলে দেখা যায় সরকারে সাথে কিছু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়। তারা একে অপরের স্বার্থ বিবেচনা করে। অনেক ব্যবসায়ীরা সরকারের ভেতরে নেতা বা মন্ত্রীদের ক্ষমতায় বসায়, যারা তাদের স্বার্থ দেখবে।

প্রতারণার নির্বাচন : যারা ফ্যাসিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাস করে তারা প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে গ্রাহ্য করে না। ক্ষমতায় টিকে থাকার তারা এমন নির্বাচনের আয়োজন করে যেখানে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
বিনা শর্তে দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাসে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর সড়ক ছাড়ল শ্রমিকরা রেমিট্যান্স বাড়ায় দেশের রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে শরণার্থীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে দক্ষিণ সুদান সরকারকে বিরোধ নিষ্পত্তির নোটিশ এস আলম গ্রুপের, নইলে আন্তর্জাতিক সালিশির হুমকি একনেকে ১ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকার ১০ প্রকল্প অনুমোদন সালাহর চমকে উড়ল লিভারপুল ডেঙ্গুতে আরো ১ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ১৭২ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী চীন সখীপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩ নাসিরনগরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু ইউক্রেন যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার ১১০০ সেনা হতাহত হয়েছে : দাবি সিউলের

সকল