২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত না করলে উন্নয়ন অর্থবহ হবে না : টিআইবি

- ছবি : সংগৃহীত

বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত না করলে উন্নয়ন অর্থবহ হবে না বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

শনিবার (৯ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায় জাতীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে ‘গণমাধ্যম, বাকস্বাধীনতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি আলোচনা এবং দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার-২০২৩ অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করা হয়।

বাংলাদেশে ক্ষমতাবানদের ‘শ্যুট দ্য মেসেঞ্জার’ মানসিকতার উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সমালোচক মাত্রই শত্রু অবস্থান থেকে তাদের স্তব্ধ করে দেয়া প্রবণতার দেখা যায় এবং ফলে ভয়ের সংস্কৃতি আরো ঘণীভূত হচ্ছে। গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজের ওপর এর প্রভাবের কারণে, চাপে পড়ে সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মীরা পেশা পরিবর্তন করছেন, সেল্ফ সেন্সরশিপের চর্চা করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থার সম্ভাবনা নিয়ে উৎকণ্ঠিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
UNCAC-এর ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নাগরিক বিশেষ করে, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির যে অঙ্গীকার করা আছে, তার উপযুক্ত পরিবেশ সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’-এর অন্তর্নিহিত এজেন্ডা হলো কখনোই গণতন্ত্র নয়। জনমুখী উন্নয়নকে নিশ্চিত করতে হলে আগে চাই গণতন্ত্র বিশেষ করে বাকস্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। তাহলেই উন্নয়ন অর্থবহ হবে।'

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কোঅর্ডিনেটর জাফর সাদিক। প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ, বৈশাখী টেলিভিশনের প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট জুলফিকার আলি মাণিক, নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী, অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও প্রশিক্ষক মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের বার্তা প্রধান আশীষ সৈকত। টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

টিআইবির আউটরিচ ও কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংবাদকর্মী-মানবাধিকার কর্মী তথা নাগরিক সমাজের মত প্রকাশের অধিকারের ক্ষেত্রে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে, যা গণতন্ত্র নিশ্চিতে অন্তরায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ণের ফলে ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’-এর চর্চা হচ্ছে, সাংবাদিকরা হুমকি ও হত্যার শিকার হয়েছেন। শত বছরের পুরোনো ঔপনিবেশিক আইন ও তার ধারাবাহিকতায় নতুন আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে বাক্‌স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের পরিবেশ সরকারকেই সৃষ্টি করতে হবে।

টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘আগে সংবাদ রাজনৈতিক দল বা নেতার বিপক্ষে গেলে সাংবাদিকের ওপর চাপ সৃষ্টি হতো। আর এখন কোনো সংবাদ ব্যবসায়ী, আমলা বা অন্য কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গেলে সাংবাদিক হত্যার ঘটনাও ঘটে। সাংবাদিকরা দুর্নীতিকে উন্মোচন করেন বলেই তাদের ওপর চাপ বেশি থাকে। আমরা দেখছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো বিভিন্ন নিপীড়নমূলক আইন সাংবাদিকদের ওপরই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের মনোভাব শূন্য সহনশীলতা থেকে ক্রমান্বয়ে ‘সহনশীল' হয়েছে এবং এখন তা একপ্রকার খোলাখুলিভাবে ‘প্রশ্রয়' দেয়া হচ্ছে।'

আলোচনা শেষে টিআইবির দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার-২০২৩ ঘোষণা করা হয়। এ বছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে তিনজন সাংবাদিক ও একটি প্রামাণ্য অনুষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। আঞ্চলিক সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন চট্টগ্রামের ‘একুশে পত্রিকা ডট কম'-এর প্রধান প্রতিবেদক শরীফুল ইসলাম (শরীফুল রুকন)। জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন ‘দৈনিক কালের কণ্ঠ' পত্রিকার সাভার প্রতিনিধি জাহিদ হাসান শাকিল।
টেলিভিশন বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার হাসান মিসবাহ। তবে বিচারকদের সম্মিলিত বিবেচনায় বিজয়ী টেলিভিশন প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে ক্যামেরাপারসনের অনন্য বিশেষ কোনো ভূমিকা না থাকায় ক্যামেরাপারসনকে আলাদাভাবে পুরস্কৃত করা হয়নি। টেলিভিশন (প্রামাণ্য অনুষ্ঠান) বিভাগে বিজয়ী হয়েছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘তালাশ'। বিজয়ীদের প্রত্যেককে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। বিজয়ী প্রামাণ্য অনুষ্ঠানটির জন্য সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট এবং ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে।

একইদিন বিকেল ৩টায় ‘দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন প্রতিযোগিতা-২০২৩' এর পুরস্কার ঘোষণা এবং পনের দিনব্যাপী কার্টুন প্রদর্শনী এবং ভার্চুয়াল গ্যালারির উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্দ্রা বার্গ ফন লিন্ডে, সুইজারল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত কোরিন হেনচজ পিগনানি, ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার ম্যাট ক্যানেল, ইউএসএআইডির মিশন ডিরেক্টর রিড এশলিম্যান, দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন প্রতিযোগিতার বিচারক কার্টুনিস্ট ও উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবিব।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

১৮তম বছরের মতো দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য টিআইবির প্রশংসা করেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কার্টুনের ব্যবহারকে উৎসাহ দিয়ে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্দ্রা বার্গ ফন লিন্ডে বলেন, ‘সমাজের জটিল সব সঙ্কট কার্টুন একদিকে যেমন সহজভাবে ফুটিয়ে তোলে, তেমনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির কাজেও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ক্ষমতাধরদের স্বেচ্ছাচারিতাকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি দাঁড় করানোর পাশাপাশি মত প্রকাশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কার্টুন কাজ করে।'

ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার ম্যাট ক্যানেল বলেন, ‘ঘুষ, অনিয়ম, দুর্নীতির বিভিন্ন ছোট ছোট গল্প সমাজের সামনে তুলে এনে এর বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে কার্টুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা পালন করা এই সব তরুণ কার্টুনিস্টদের অভিবাদন জানাই।'

ইউএসএআইডির মিশন ডিরেক্টর রিড এশলিম্যান বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমাজের সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন সরকার, সুশীল সমাজ, বেসরকারি খাত, গণমাধ্যম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ নাগরিকরা। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের গঠনের প্রয়াসে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানাই। চলুন এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে একসাথে কাজ করে যাই যেখানে ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও সততা আমাদের ভবিষ্যতের পথ দেখায়।'

‘দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও অবিচার’ বিষয়ে আয়োজিত ১৮তম কার্টুন প্রতিযোগিতায় ‘ক' বিভাগে (১৩-১৮বছর) প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেন যথাক্রমে সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজের মুগ্ধ রায় নিবিড়, বরিশাল ক্যাডেট কলেজের ইশতিয়াক আহমেদ তৌফিক এবং শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মো: তাহসিন বিন ইব্রাহিম। ‘খ' বিভাগে (১৯-২৫ বছর) প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেন যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভীর মালেক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দেবাদৃতা হালদার এবং ইম্পেরিয়াল কলেজের এইচএসসি পরিক্ষার্থী মো: আবদুর রহমান তালুকদার। উভয় গ্রুপের বিজয়ী তিনজনকে যথাক্রমে ৭৫ হাজার, ৫০ হাজার ও ৪০ হাজার টাকা, ক্রেস্ট ও সনদ প্রদান করা হয়।

এছাড়া দু'টি বিভাগ থেকে মোট ২৩ জন কার্টুনিস্টকে বিশেষ মনোনয়ন দেয়া হয়।

উল্লেখ্য, এ বছর দু'টি বিভাগে ১১০ জন কার্টুনিস্টের আঁকা মোট ২২৯টি কার্টুন জমা পড়ে। কার্টুন প্রতিযোগিতার বিজয়ী ও বিশেষ মনোনয়ন প্রাপ্ত ২৯ জন কার্টুনিস্টের মোট ৪৮টি কার্টুন নিয়ে আজ থেকে ১৫ দিনব্যাপী সাধারণের জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ের লেভেল ৫-এ ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রদর্শনী রোজ দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা চলে। পাশাপাশি, ভার্চুয়াল গ্যালারিতেও (https://www.ti-bangladesh.org/cartoon-competition) এই প্রদর্শনী দেখা যায়।

প্রেস বিজ্ঞপ্তি


আরো সংবাদ



premium cement