‘দেশের মুসলমানদের ইতিহাস ও ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাঠ্যপুস্তক প্রনয়ণ করা হয়েছে’
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ২২:০৬
শিক্ষা গবেষণা সংসদ ঢাকার উদ্যোগে আয়োজিত সিম্পোজিয়ামে দেশের বিশিষ্টজনেরা বলেন, ‘দেশের মুসলমানদের ইতিহাস ও ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে ভারতীয় উগ্র সাম্প্রদায়িক, সমকামী, যৌন ও বিবর্তনবাদের শিক্ষা ঢোকানো হয়েছে। নতুন বইগুলোতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইসলাম এবং মুসলমান প্রসঙ্গ। শুধু এড়িয়েই যাওয়া হয়নি, বরং ইসলাম এবং মুসলিম ধর্মাচার বিদ্বেষী করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। মুসলিম ঐতিহ্যকে হেয় করা হয়েছে সুকৌশলে। পাশাপাশি বইগুলোতে যৌন বিকৃতিকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।’ বিশেষকরে মাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে চালু হওয়া পাঠ্যপুস্তক নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তারা অবিলম্বে ইসলামবিরোধী বিতর্কিত পাঠ্যপুস্তক বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, মুসলিম জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মকে অন্তসারশূন্য সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এই সরকার।
বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘শুধু পাঠ্যক্রম সংশোধন নয়: দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টির জন্য শিক্ষায় মৌলিক সংস্কার অপরিহার্য’ শীর্ষক সিম্পোজিয়াম বক্তারা এইসব কথা বলেন। প্রফেসর ড. এম কোরবান আলীর সভাপতিত্বে সিম্পোজিয়ামে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রফেসর ড. মোহাম্মাদ আবদুর রব, সিম্পোজিয়ামে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল আজিজ। বক্তব্য রাখেন কবি আবদুল হাই শিকদার, শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব কাদের গনি চৌধুরী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন- বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ, ইঞ্জিনিয়ার শেখ আল আমিন, শিক্ষাবিদ ড. ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে’র সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান, সাংবাদিক শাহেদ মতিউর রহমান, সাংবাদিক শাহীন হাসনাত, স্কুল শিক্ষক মাকসুদুর রহমান প্রমুখ।
প্রধান অতিথি প্রফেসর ড. মোহাম্মাদ আবদুর রব বলেন, পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ইতিহাস ঐতিহ্য পরিপন্থী শিক্ষা। এগুলো আমাদের দেশের মুসলমানদের ইতিহাস ও ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। ইসকনের নামে একটি সংগঠন নাকি এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। বিবর্তনবাদের মতো একটি কুফরি বা নাস্তিক মতবাদ শেখানো হবে মুসলমানদের সন্তানদের। এটা বিশ্বাস করলে ঈমান থাকবে না। যারা এইগুলো করেছে তারা জেনেবুঝে করছে- কিভাবে মুসলমানদেরকে ধর্মহীন করা যায়। কিভাবে মুসলমানদেরকে নাস্তিক বানানো যায়। ইসলাম উদার মানবিক ধর্ম সব ধর্মের মানুষকে সম্মান দেখায়। পাঠ্যক্রমে যদি আমাদের ইসলামের বিশ্বাস না থাকে তবে বহিরাগত শক্তি আমাদের ওপরে আগ্রাসন চালিয়ে করদ রাষ্ট্রে পরিণত করবে। শিক্ষাব্যবস্থা বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জীবনমুখী শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সিম্পোজিয়ামে ধারণাপত্র উপস্থাপন করে অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল আজিজ বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় চলমান যে সংকট তার সাথে সাম্প্রতিক আলোচনা-সমালোচনার মাত্রাগত অসামঞ্জস্যতা রয়েছে; সংকটের যে গভীরতা তা শুধু উপরি আলোচনা করে সমাধান করা সম্ভব নয়, শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি একটি মানব দেহের সঞ্চালনের সাথে তুলনা করা হয়, আর কোনো একজন ব্যক্তির সমগ্র রক্ত দুষিত হয়, উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয়, হৃৎপিন্ডে ব্লক ধরা পরে, মস্তিকে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি হয় আর একজন চিকিৎসক যদি ওই ব্যক্তির শরীরের বাহ্যিক চর্মরোগের চিকিৎসায় মনোযোগী হন তাকে আর যাই হোক যথার্থ চিকিৎসা বিবেচনা করা যাবে না।
তিনি বলেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম: কিছু মৌলিক তথ্য শিক্ষাক্রমকে ইংরেজিতে কারিকুলাম বলা হয়, পাঠ্যসূচি হচ্ছে শিক্ষাক্রমের একটি অংশ যাকে ইংরেজিতে সিলেবাস বলা হয়। শিক্ষাক্রমের অর্থ ব্যাপক এবং এর সাথে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য, জাতীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্য মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয়। ২০১৭ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, ১০২ দেশের শিক্ষানীতি নির্দেশনা বিশ্লেষণ, ৫১টি দেশের দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম অনুসরণ ১১টি দেশের দক্ষতাভিত্তিক যোগ্যতাকে অন্তর্ভূক্ত করার দাবি করা হয়েছে। দেশের ১৫৬ জন বিশেষজ্ঞ, ৮০০ জনের অধিক অংশিজন অংশ নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রফেসর ড. এম কোরবান আলী সভাপতির বক্তব্যে বলেন, শিক্ষানীতি ২০১০ সালে পাশ করার পর প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধর্মীয়, বিজ্ঞান ও কারিগরি বা প্রযুক্তি শিক্ষা। পাঠ্যক্রম এমন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে যা আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের বিরোধী। ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, মুসলিম নামধারী ষড়যন্ত্রকারীরা বর্তমান শিক্ষার পাঠ্যক্রম তৈরি করেছে। আমাদের মুসলিম ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামবিরোধী বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষকদের মতামতসহ একটি বই প্রকাশ করে সারাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। পাঠ্যবইয়ে ইসলামবিরোধী বিষয় প্রনয়ণকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। ইরান ও চীন শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করার কারণে আমেরিকা বিরুদ্ধে টিকে আছে। ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এদেশের দালালরা ইসলামবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা প্রনয়ণ করে। ডারউইন নিজেই তার তত্ত্ব বিশ্বাস করতো না। বিবর্তনবাদ একটি ভুয়া জিনিস যা ডিএনএ পরীক্ষা আবিস্কারের পর প্রমাণিত হয়েছে।
শিক্ষকনেতা অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া বলেন, এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা সরকার বানিয়েছে যে, ছাত্রদের এখন আর পরীক্ষা দিতে হবে না। দেশে শিক্ষা বাজেট খুবই কম। যাও প্রশিক্ষণের নামে বরাদ্ধ দেয়া হয় তা লুটপাট করা হয়। সরকারি দলের মাস্তানদের বসানো হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে, যাদের কাজ হলো ফান্ডের টাকা লুটপাট করা।
শুধু পাঠ্যক্রম সংশোধন নয়,দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টির জন্য শিক্ষায় মৌলিক সংস্কার অপরিহার্য শীর্ষক দাবি শিক্ষা গবেষণা সংসদের। এ সময় বক্তারা সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বলেন, পাঠ্যবইগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্নভাবে বিভিন্ন অধ্যায়ে ইসলামবিদ্বেষ ফুটে উঠেছে বইগুলোতে। সম্প্রীতি শেখানোর নামে, স্বাধীনতা শেখানোর নামে শিশুদের মনে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ইসলামবিদ্বেষ। পাশাপাশি সযত্মে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইসলামী নিদর্শন, ব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতির আলোচনা। পাঠ্যপুস্তকে ইসলামী ঐতিহ্য আড়ালের চেষ্টা হয়েছে। ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইটিই পড়ে দেখা গেছে, বইয়ের অধিকাংশ পৃষ্ঠাজুড়েই রয়েছে হরপ্পা সভ্যতা ও মাহেঞ্জোদারোর গল্প। এখানে দেখানো হয়েছে, তারা খুবই সভ্য আর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছিল। মূলত তারা ছিল উৎকৃষ্ট এক জনগোষ্ঠী। তাদের ধর্ম বেদের ওপর নির্ভরশীল। তাদের মুদ্রা, মন্দির, স্থাপনা, ধর্মীয় গ্রন্থ, দেব-দেবীর ছবি, বৌদ্ধ বিহার আর মন্দিরের ছবিতে সয়লাব পুরো বই। একই উদাহরণ পাওয়া গেছে অন্য বইগুলোতেও। সেগুলোতেও বৌদ্ধ বিহার, হিন্দু মন্দির এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রতিমার বহু ছবি দেয়া হয়েছে। বাস্তব কিংবা কল্পিত ছবি ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবিই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।
তারা বলেন, আইন-নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য মানসম্পন্ন (জাতীয় চেতনা ও বৈশ্বিক চাহিদার সমন্বয়) পাঠ্যক্রম, মানসম্পন্ন শিক্ষক ও মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিখন উপকরণ পরিবেশ সহযোগে জাতীয় নীতি-কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সমান্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
-প্রেস বিজ্ঞপ্তি