যার মধ্যে নৈতিকতা নেই সে প্রকৃত মানুষ হতে পারে না : প্রফেসর ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১১ আগস্ট ২০২২, ২১:৪৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডীন ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান বলেছেন, নৈতিকতা এমন একটি শিক্ষা, যা অর্জন করে নিতে হয়। কারণ নৈতিক শিক্ষার কোনো সার্টিফিকেট নেই। এখন কথা হলো কোথায় থেকে এই শিক্ষা অর্জন করতে হবে। সমাজে কেউ শিক্ষিত হয়ে জন্মগ্রহণ করে না, আবার কেউ অপরাধী হয়েও জন্মগ্রহণ করে না। মানুষ পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করেই বেড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে নৈতিকতা শিক্ষায় প্রথম ভূমিকা রাখতে হয় পরিবারকে। এরপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। এই নৈতিক শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে রাষ্ট্রের ওপর।
তিনি বলেন, একটি শিশুর নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি পরিবার থেকে বপন করতে হয়। তাকে বোঝাতে হবে ভালো- মন্দের পার্থক্য। ছোট-বড়দের সাথে কিভাবে আচার-আচরণ করতে হবে। দিতে হবে ধর্মের জ্ঞান। একমাত্র ইসলাম ধর্মই পারে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। যা বর্তমানে অতি প্রয়োজন। একজন সফল মানুষ হতে হলে দক্ষতা অর্জনের সাথে সাথে নৈতিকতার কোনো বিকল্প নেই। যার মধ্যে নৈতিকতা নেই সে প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। বাহ্যিক দিক থেকে যদিও সে ধনবান বা ক্ষমতাবান হন।
বৃহস্পতিবার যুব উন্নয়ন সংসদের উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষে ‘দক্ষ ও নৈতিকতা সম্পন্ন যুবশক্তিই উন্নয়নের অন্যতম মাধ্যম’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক আলমগীর মহিউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার আল কোরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. মো: নাসির উদ্দিন মিঝি। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএফইউজে-এর সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. নকিব নসরুল্লাহ, যশোর সরকারি কারিগরি মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ ড. সৈয়দ আব্দুল আজিজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. আতিয়ার রহমান, বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও সমাজকর্মী অ্যাডভোকেট ড. হেলাল উদ্দীন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো: শহিদুল ইসলাম, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. গোলাম রহমান ভূঁইয়া প্রমুখ।
প্রফেসর ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান বলেন, সুশিক্ষা ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরিতে পরিবারের বড় একটি ভূমিকা থাকে। আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনেও অনৈতিকতা ও আদর্শহীনতার ছোঁয়া লেগেছে। অন্যের সফলতা আমাদের সহ্য হয় না। তাই তো সুযোগ পেলেই কাউকে বিপদে ফেলতে এতটুকু দ্বিধা করি না। কারো বিপদে সাহায্য করি না। দাঁড়িয়ে তামাশা দেখি।
তিনি বলেন, রাস্তাঘাট, বন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষা, চিকিৎসার এমন একটা খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে নৈতিকতা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত নয়। কর্মকর্তা, কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা, আমজনতা কেউ বাদ নেই। পুরো সিস্টেম একটা সিন্ডিকেট হয়ে গেছে। অনেকেই হয়তো চাইলেও এই সিন্ডিকেট থেকে বের হতে পারছেন না। আবার অনেকে ইচ্ছা করেই বের হতে চাইছেন না।
তিনি বলেন, এসব দুর্নীতি ও অপকর্ম রোধ করা যাদের দায়িত্ব, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেই কতটা নৈতিক অবস্থানে আছে, বর্তমানে তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং নীতিহীন এই কর্মকাণ্ডগুলো প্রতিরোধ বা নির্মূল করা সম্ভব নয়।
তিনি আরো বলেন, ইসলামের শিক্ষার অভাবেই মুসলিম জাতি আজ সমগ্র বিশ্বে পদে পদে বিপর্যস্ত ও পদদলিত। তাই হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে হলে প্রয়োজন নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখা এবং চালু করা। আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিকসহ সব স্তরে যদি ইসলামী শিক্ষা কারিকুলাম চালু করা হয়, তা হলে সৎ-চরিত্রবান ও নিষ্ঠাবান নাগরিক গড়ে তুলে সমাজের সর্বস্তরে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে কাক্ষিত শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। একজন মুসলমানের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহর বিধি-বিধান মেনে নেয়া ও তার সন্তুষ্টি অর্জন করাই হলো ইসলামি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
তিনি আরো বলেন, ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থায় পরিপূর্ণরূপে ইসলামকে তুলে ধরা হয়েছে। ইসলাম শিক্ষার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও আনুগত্য শিখতে পারি। কল্যাণমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করতে পারি। পরকালীন জীবনে জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় জানতে পারি।
সভাপতির বক্তব্যে প্রবীণ সাংবাদিক আলমগীর মহিউদ্দিন বলেন, প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কোনো না কোনো ধর্মকে আশ্রয় করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটি ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে গড়ে উঠেছে। তাই একটি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি সৃষ্টি ও অবক্ষয়হীন সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে নাগরিকদের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি, ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্প্রসারণ, লালন ও অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য
থাকে সে সমাজই সভ্য সমাজ। তিনি বলেন, একটি ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ হওয়ার পরেও বাংলাদেশকে একটি কল্যাণময় রাষ্ট্রে পরিণত করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এ ব্যর্থতা থেকে শিগগিরই বের হয়ে আসতে হবে। জাতির মনে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। আর এজন্য ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি নৈতিক অবক্ষয় ঠেকানো না গেলে যত উন্নয়ন করা হোক না কেন, তা দিয়ে সুস্থ ধারার জাতি বিনির্মাণ কখনোই সম্ভব নয়।
রুহুল আমিন গাজী বলেন, দেশে তো মনে হয় এখন যুব সমাজের মাঝে নৈতিকতার ‘ন’ অবশিষ্ট নেই। দেশ এখন উন্নয়নের পথে হাঁটছে। তবে এটাও ঠিক, সমাজে অস্থিরতা, অপরাধপ্রবণতাও লাগামহীনভাবে বাড়ছে। খবরের কাগজের পাতা উল্টালেই নজরে পড়ছে ধর্ষণ, পাশবিক নির্যাতনের নানা ঘটনার খবর। পৈশাচিক কায়দায় খুন, শিশু নির্যাতন, সন্ত্রাসবাদ, মাদক, লুটপাট, দুর্নীতি, মারামারি আর হানাহানির খবর তো নিত্যদিনের পত্রিকার পাতা ভরে থাকছে। এক কথায়, দেশে নীতি-নৈতিকতার দুর্ভিক্ষ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবক্ষয় এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দেন সেখানে তাদের নৈতিকতা ঠিক করার জন্য। প্রকারন্তরে দেখা যায় বেতনের সাথে সাথে ঘুষ দুর্নীতিও পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেছে। এগুলো রোধ করতে হলে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মূলধারায় ফিরে আসতে হবে। ইসলামের জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
প্রফেসর ড. নকিব নসরুল্লাহ বলেন, টেকসই উন্নয়ন বলতেও আমরা বুঝি কোনো কাজ পরবর্তীতে থেকে যাওয়ার পরেও মানুষের কল্যাণে কাজে লাগছে। সেক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন যেমন অত্যাশকীয়, ঠিক তেমনি নৈতিকতার অভাবে যেকোনো অর্জনই ম্লান হয়ে যেতে পারে। মূলত উন্নয়নের বড় নিয়ামক হচ্ছে মানবিক উন্নতি, যা ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করা ব্যতীত অর্জন অসম্ভব।
ড. সৈয়দ আব্দুল আজিজ বলেন, একটি মানব দেহের দু’টি অংশ আছে, একটি হচ্ছে দক্ষতা অপরটি নৈতিকতা। একটা থাকলে অন্যটা না থাকলে সে প্রাণ পূর্ণতা পায় না। ৭০ দশকে আমরা একটা গান শুনতাম ‘এই দেশ তোমারি দান’। অর্থাৎ আমরা আল্লাহর কাছে দেশ রাষ্ট্র পেয়ে শুকরিয়া আদায় করতাম। অথচ সেই দেশে আজ নৈতিক অবক্ষয় মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
কেউ হয়তো বিশেষ কোনো কাজে দক্ষতা অর্জন করেছে ঠিকই কিন্তু নৈতিকতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রবন্ধে প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দিন মিঝি বলেন, বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে যুব সমাজের অধঃপতন চোখে পড়ার মতো। পশ্চিমা বিশ্বে নিঃসন্দেহে দক্ষতার বিকাশ ঘটেছে এবং বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে ঈর্ষনীয় সাফল্য লাভ করেছে। কিন্তু পাশাপাশি তাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে। মাদকাসক্তি, লাগামহীন যৌনাচারসহ বিভিন্ন নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মকাণ্ড পশ্চিমা সমাজকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করেছে। মুসলিম সমাজব্যবস্থা ও কালের বিবর্তনে পশ্চিমা সভ্যতা সংস্কৃতির বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা চর্চায় তথাকথিত মুসলিম নামের কিছু পশ্চিমা দালাল আমাদের পুত:পবিত্র সমাজব্যবস্থাকে কুলষিত করেছে। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, মিশরের জামাল নাসেরসহ তৃতীয় বিশ্বের কিছু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী প্রকৃত অর্থে ধর্মহীনতা চর্চা করে মুসলিম যুব সমাজকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। তার থেকে আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও মুক্ত নয়। মাদকসক্তিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আমাদের সমাজকেও গ্রাস করছে। এ অবস্থায় দক্ষ ও নৈতিকতায় উর্ত্তীন একটি যুবশক্তিই হতে পারে আমাদের মুক্তির পূর্ব শর্ত।
ড. হেলাল উদ্দীন বলেন, সরকারের দায়িত্ব ছিলো দেশের যুব সমাজকে দক্ষ ও নৈতিকতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলা। অথচ একটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে আইন পাশ করে তারা মদের লাইসেন্স দিয়ে এই যুব সমাজকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ থেকে জাতিকে বাঁচাতে হলে ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিধি-বিধান ব্যক্তি ও পরিবার, এমনকি সকল ক্ষেত্রে অনুসরণের বিকল্প কিছু নেই। আর মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহ নৈতিকতা সম্পন্নদেরকেই সফলকাম বলে অভিহিত করেছেন।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি