সরকারি সেবায় বৈষম্য : টিআইবির ১০ দফা সুপারিশ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২১ অক্টোবর ২০২১, ১৮:২৮, আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২১, ১৮:৩১
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বিভিন্ন সরকারি সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিতে বাধা, বৈষম্য ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক সেবা নিশ্চিতে জবাবদিহি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা না হলে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ‘কাউকে পেছনে না রাখা’ লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে। বৃহস্পতিবার ‘সরকারি সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা : জবাবদিহি ব্যবস্থার বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেছে টিআইবি। পাশাপাশি সঙ্কট উত্তরণে ১০ দফা সুপারিশ প্রদান করেছে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের রিসার্চ এসোসিয়েট (কোয়ালিটেটিভ) মো: মোস্তফা কামাল ও গবেষণাটি তত্ত্বাবধান করেন একই বিভাগের সিনিয়র ফেলো শাহজাদা এম আকরাম।
সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলম।
গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর সময়কালে গুণবাচক এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরিমাণবাচক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে আদিবাসী, অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার, দলিত, চা বাগান শ্রমিক, হিজড়া জনগোষ্ঠীদের অন্তর্ভুক্ত করে গবেষণাটি করা হয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য সুশাসনের নির্দেশক আইনি সক্ষমতা, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উপাত্তের অনুপস্থিতি তাদের প্রতি উদাসীনতা ও অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ এবং তাদের মূলধারায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকারি সেবা ও জবাবদিহি ব্যবস্থা সর্ম্পকে প্রচারে ঘাটতি বিদ্যমান। আবার আইনি সীমাবদ্ধতা বা আইনের অনুপস্থিতি, আইনের যথাযথ প্রয়োগে ব্যর্থতার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সেবায় অভিগম্যতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান জবাবদিহি কাঠামো অনেক ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়, কারণ এক্ষেত্রে তাঁদের ভাষাগত দক্ষতা, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সামর্থ্য ইত্যাদি সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের নেতিবাচক মানসিকতা ও চর্চা, অভিযোগ দাখিলে প্রত্যাশিত ফলাফল না পাওয়া বরং বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হওয়ার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী জবাবদিহি কাঠামো ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হন।
গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশ সংবিধানে নাগরিকের বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যের কারণে অধিকার ও সেবা প্রাপ্তিতে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না উল্লেখ করা হলেও, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ‘খসড়া বৈষম্য বিলোপ আইন’ এখনো পাস হয়নি। আবার খসড়া আইনে অভিযোগ অনুসন্ধানকারী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে জবাবদিহি করার বিষয়টি উল্লেখ নেই।
অন্য দিকে তদন্তের স্বার্থে ‘সময় বর্ধিত’ করা ও ‘যুক্তিসঙ্গত’ কারণে মামলা মুলতবীর সুযোগ আইনে দেয়া আছে, যার পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা খসড়া আইনে অনুপস্থিত। এর ফলে মামলা সম্পন্ন হতে দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ থাকে।
বৈষম্যবিরোধী আইন না থাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মামলা দায়ের করতে না পারার মতো বিষয় এই গবেষণায় উঠে এসেছে। সরকারি সেবা প্রাপ্তির সুযোগ সকল নাগরিকের জন্য সমান হলেও সেবায় অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতে কিছু কিছু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশেষ অবস্থা ও চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় আইন ও আলাদা নির্দেশনা প্রদান করা হয়ে থাকে।
আইনগতভাবে সকল আদিবাসীর পরিচয় ও তাদের ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন থাকলেও সমতলে বসবাসরত বৃহৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের ভূমি সমস্যা সমাধানে ভূমি কমিশন নেই।
গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এবং নীতিমালা, ২০১৫- এ অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার ভুক্তভোগীদের প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে সরাসরি নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়নি। এ ছাড়াও নির্বাচন কমিটি কার কাছে জবাবদিহি করবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা আইনে নেই। অ্যাসিড দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির চিকিৎসা, আইনগত সহায়তা ও পুনর্বাসন বিধিমালা, ২০০৮- এ অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার ভুক্তভোগীদের চিকিৎসা, আইনি সহায়তা ও পুনর্বাসনের বিষয়ে একাধিক ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য সর্ম্পকে বলা হলেও কার কাছে তারা জবাবদিহি করবে, সে বিষয়ে আইনে দিক নির্দেশনা দেওয়া নেই। ফলে ভুক্তভোগীদের সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০১০- এ আদিবাসী ভাষার বই বিতরণ, এর পাঠদান নিশ্চিত, শিক্ষক চাহিদা নিরূপণ ও তাদের প্রশিক্ষণ তদারকির বিষয়টি অনুল্লেখিত থাকায় তদারককারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায় না। শ্রম আইন, ২০০৬ এবং শ্রম বিধিমালা, ২০১৫- এ চা শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদাগুলো বাগান কর্তৃপক্ষ প্রদান করতে অপারগ হলে শুধুমাত্র বাগান কর্তৃপক্ষই তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিত আকারে অবহিত করার বিধান রাখা হয়েছে। ফলে, বাগান মালিক বা বাগান কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকরা এই বিষয়ে জবাবদিহি ব্যবস্থার আওতায় আনতে পারে না। গবেষণায় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান জবাবদিহি কাঠামোগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যবস্থাসমূহ সম্পর্কে পরিচিতির অভাব ও এর প্রক্রিয়াগত জটিলতা, সেবা প্রদানকারীদের নেতিবাচক মানসিকতা ও চর্চার কারণে জবাবদিহি কাঠামো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহজলভ্য/অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়।
গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনে সাড়া প্রদানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের কার্যক্রম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে সরকারি সেবার ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র দেখা যায়। যেমন- প্রান্তিক পরিচয়ের কারণে অভিযোগ দাখিল করতে না পারা, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করে সমাধান না পাওয়া, বিদ্যালয়ে ‘মূলধারার’ সহপাঠী ও শিক্ষকদের বর্ণবাদমূলক আচরণের অভিযোগে সমাধান না পাওয়া, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে শিক্ষকদের বিরূপ মন্তব্যের শিকার হওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার না পাওয়া, ভূমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ জানিয়েও সহযোগিতা না পাওয়া, অভিযোগ দাখিলের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি। দেখা গেছে, মধুপুরে ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ ঘোষণা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে করা হয়েছে উল্লেখ করে পরিবেশবাদী সংগঠনের মামলায় উচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা অবজ্ঞা করে ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ দখলমুক্ত করা ও সামাজিক বনায়নের নামে আদিবাসীদের বসত-ভিটা ও আবাদি জমিতে বন বিভাগের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার প্রমাণ রয়েছে। আবার শেরপুরে স্থানীয় আদিবাসীদের বাড়ি ও আবাদি জমি বন বিভাগের উল্লেখ করে ‘অবৈধ দখলকারীদের’ তালিকা তৈরি করে উচ্ছেদ ও সামাজিক বনায়নের লক্ষ্যে জমির ফসল ও বাগানের গাছপালা ধ্বংস করার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আদিবাসীদের মধ্যে শতভাগ স্যানিটেশন নিশ্চিত করা হয়নি অভিযোগ করায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একজন অধ্যাপককে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সভা থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টার নজিরও আছে।
গবেষণার ফলাফলে আরও দেখা যায়, জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের তদারকি ব্যবস্থাপনায় নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আদিবাসী পরিচয়ের কারণে শিক্ষা, ভূমি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিষয়ক লিখিত অভিযোগ সরাসরি উপস্থিত হয়ে দাখিল করা হলেও তা রেজিষ্টারে লিপিবদ্ধ, সংরক্ষণ ও ফলোআপ না করার উদাহরণ রয়েছে। প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর জনসংখ্যা বিষয়ক তথ্য সংগ্রহে তদারকির ঘাটতি ও সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির ঘাটতির কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার উপেক্ষার নজির আছে। অবাঙালি শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও পরীক্ষার প্রশ্ন বুঝতে না পারার বিষয়ে শিক্ষকদের অসহযোগিতামূলক আচরণ দেখা। চা বাগানের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির ঘাটতির কারণে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সেবাও উপেক্ষিত।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তথ্যে অভিগম্যতার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দলিত শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি না পেলে তার কারণ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা জানতে চাইলে শিক্ষকরা তা জানান না। অন্যদিকে, তথ্য অধিকার আইনে দলিত জনগোষ্ঠী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ঔষধ বিতরণ সম্পর্কিত তথ্যের আবেদন করায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিড়ম্বনা ও হুমকির শিকার হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির তালিকাভুক্তিতে অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা এ সম্পর্কে তথ্য প্রদান না করে প্রতিবন্ধকতা তৈরির অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সরকারি সংশ্লিষ্ট স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে অনিহা দেখা যায়। উপকারভোগী বাছাইকরণ সম্পর্কে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রচার করা হয় না। এমনকি, দলিতদের জন্য আবাসন প্রকল্পের আওতায় দলিতদের স্থানান্তর ও পুনর্বাসনের তথ্য তারা জানতে চাইলে তা না জানানোর দৃষ্টান্ত রয়েছে। পাশাপাশি ভূমি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে গণশুনানি আয়োজন করা হলেও তা আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় প্রচার হয় না।
গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি ও সভায় সংশ্লিষ্ট প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয় না। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিতে জমি দাতাকে সদস্য করার বিধান থাকলেও দলিত ও আদিবাসী ব্যক্তির দান করা জমিতে নির্মিত বিদ্যালয়ের কমিটিতে দাতা বা তার পরিবার, এমনকি তার গোষ্ঠীর কাউকে না রাখার দৃষ্টান্ত রয়েছে। আবার, বিদ্যালয় কমিটির নির্বাচিত দলিত সদস্যকে নিয়মিতভাবে সভার তারিখ সম্পর্কে না জানানোর পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাতে সদস্যদের মতামত না নেওয়া বা মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন স্থায়ী কমিটি এবং উপকারভোগী বাছাইয়ের উপজেলা কমিটিতে আদিবাসী ও দলিতদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব রাখা হয় না। সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিশেষ কর্মসূচির উপকারভোগী বাছাই কমিটিতে নিষ্ক্রিয় দলিত প্রতিনিধি বা প্রভাবশালীদের আজ্ঞাবহ দলিত প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদের সভার তারিখ ও সভায় অংশগ্রণের আমন্ত্রণ জানানো হয় না।
সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্তের ঘাটতি ও অস্পষ্টতা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্তিকরণে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সেবা প্রদানের জন্য এবং অভিযোগ দায়েরের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে যেটি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ায় সেবা প্রাপ্তি থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হন। বঞ্চিত হওয়ার পর যদি অভিযোগ দায়ের করেন, তখন তারা বাঁধাগ্রস্ত হন কিংবা প্রতিকার পান না। বরং অনেক সময় অভিযোগ উত্থাপন করলে হুমকির সম্মুখীন হন। এক্ষেত্রে আমরা দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করেছি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাংশ মূলত প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে থাকে এবং তাদের মানসিকতাও অনেক সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে নেতিবাচক।’
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যপূর্ণ আচরণ বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সমঅধিকারপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘দেশের উন্নয়ন এবং সরকারি সেবা ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত সুফলপ্রাপ্তি এবং এই বঞ্চনার প্রতিকারের জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও বিধি রয়েছে তা ব্যবহারের সুযোগ থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে তাদের প্রান্তিকতা আরও প্রকটতর হচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের মূল মন্ত্র- কাউকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পেছনে রাখা যাবে না, সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এর ফলে সুদূরপরাহত হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের সংবিধানে যে সমতাভিত্তিক বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের অঙ্গীকার রয়েছে, সেটি পদতলিত হচ্ছে বলে আমরা মনে করি।’
এসব সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণায়। এর মধ্যে বিভিন্ন সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিতে বাধা দূর করা এবং বৈষম্যহীন ও জবাবদিহিমূলক সেবা নিশ্চিত করতে বৈষম্য বিলোপ আইন দ্রুত প্রণয়ন করা; সকল প্রান্তিক গোষ্ঠীর ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও নিয়মিত হালনাগাদ করা; সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা ও জবাবদিহি ব্যবস্থা সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে এবং সকল গণমাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের ভাষায় যথাযথ এবং নিয়মিত প্রচার পরিচালনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রচার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সংশ্লিষ্ট বেসরকারি অংশীজনদের সম্পৃক্ত করা; সেবা সংক্রান্ত অভিযোগ কাঠামো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী-বান্ধব করার জন্য সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী থেকে মৌখিক অভিযোগ গ্রহণ ও তা লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করা ও সমাধানে নিয়মিত ফলোআপ করা; সরকারি প্রতিষ্ঠানের গণশুনানিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়ে আলাদা সময় বরাদ্দ এবং সমস্যা প্রকাশে উৎসাহিত করা।