বিএমইটির অনুমতি ছাড়া জনশক্তি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া যাবে না
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২০ অক্টোবর ২০২১, ০৯:৩৮
মানবপাচার আইন সংশোধন দাবি
অভিবাসন আইন ২০১৩ থাকার পরেও মানবপাচার আইনের অপব্যবহার করে নানাভাবে হয়রানি, মামলা ও গ্রেফতার করা হচ্ছে জনশক্তি ব্যবসায়ী তথা রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের। মামলার এজাহারে মানবপাচার মামলা, এমনকি সাংবাদিকদের সামনে সংশ্লিষ্ট জনশক্তি ব্যবসায়ীকে ‘আমি মানবপাচারকারী’ লেখা হয়। ফলে জনশক্তি রফতানিকারকরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেন না ছেলে মেয়ে বা আত্মীয়-স্বজনদের। অথচ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা সরকারের সব ধরণের নিয়ম মেনে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’র (বিএমইটি) কাছ থেকে স্মার্ট কার্ড নিয়ে বিদেশে কর্মী পাঠানোর পরে কোনো সমস্যা হলেই মানবপাচার আইন ২০১২ মামলা দেয়া হয়। এই আইনের অপব্যবহার থেকে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা মুক্তি চান। পাশাপাশি ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০১৩’ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন জনশক্তি ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি তাদের এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন সুশিল সমাজের প্রতিনিধিরা।
মঙ্গলবার বনানীস্থ হোটেল শেরাটনে রিক্রুটিং এজেন্সি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন অব বাংলাদেশ ‘মানবপাচার আইনের অপপ্রয়োগ, বৈধ অভিবাসনের অন্তরায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা এসব কথা বলেন।
সভায় বক্তারা বলেন, কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের (জনশক্তি ব্যবসায়ী) বিরুদ্ধে মামলা করার আগে বিএমইটির অনুমতি নিতে হবে। যদি মামলাযোগ্য অপরাধ করে তাহলে বিএমইটির সম্মতির ভিত্তিতে মামলা দেয়া যাবে। এটাই প্রকৃত নিয়ম হওয়া উচিত। আগামীকাল বৃহস্পতিবার আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা রয়েছে। এই সভায় সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা রাখার অনুরোধ করেন বক্তারা।
গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, প্রবাসীদের সবাই রেমিটেন্সযোদ্ধা বলে আক্ষায়িত করে। অথচ তাদেরকে যারা খুঁজে খুঁজে বের করে বিদেশে পাঠিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করে তাদেরকে সামান্য ভুলের জন্য মানবপাচারকারী বলা হয়। রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরাই রেমিটেন্সযোদ্ধা তৈরি করেছে। এই মহামারী করোনার মধ্যে রেমিটেন্স কমেনি, বরং বেড়েছে।
তিনি বলেন, অভিবাসন আইন থাকতে মানবপাচার আইনে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের মামলা দেয়া হয়। এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হবে।
ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের অর্থ প্রবাসীদের উন্নয়নের জন্যই ব্যয় করতে হবে। এ খাত গুরুত্বপূর্ণ। দুটি খাত বাংলাদেশকে ধরে রেখেছে-প্রথমত পোশাক খাত ও দ্বিতীয়ত-প্রবাসী আয়।
তিনি আরো বলেন, মানবপাচার আইনে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের হয়রানি, মামলা ও গ্রেফতার সম্পূর্ণ অন্যায়, অপরাধ। মানবপাচার আইনের সাথে অভিবাসন আইনের কোনো সম্পর্ক নেই।
অতিথির বক্তব্যে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি এমপি বলেন, কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করার আগে বিএমইটির অনুমতি নিতে হবে। যদি মামলাযোগ্য অপরাধ করে তাহলে বিএমইটির সম্মতির ভিত্তিতে মামলা দেয়া যাবে। এটাই প্রকৃত নিয়ম হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ভিন্নতা। যদি বৈধ লাইসেন্স নিয়ে বৈধভাবে কর্মী পাঠায় সেক্ষেত্রে মানবপাচার আইনে বিচার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বৈধ লাইসেন্স নিয়ে যদি কেউ অবৈধ কাজ করে সেক্ষেত্রে মানবপাচার আইনে মামলা হবে এটাই স্বাভাবিক।
প্রধান বক্তার বক্তব্যে বিএমইটি’র মহাপরিচালক শহীদুল আলম বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স দেয় বিএমইটি। সুতরাং এজেন্সিগুলোর দায়িত্ব আমাদের। কিন্তু যখন দেখি তাদেরকে মানবপাচার আইনে মামলা দেয়া হয়, আর আমরা কিছুই জানি না। অথচ রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিএমইটির নেয়ার কথা।
তিনি বলেন, মানবপাচার আইন একটা আর অভিবাসন আইন আরেকটা। একটার সাথে অন্যটা মিলানোর কোনো সুযোগ নেই। আইন ঠিকই আছে, কিন্তু আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। এটা সংশোধন হওয়া প্রয়োজন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বায়রা’র সাবেক সভাপতি মোহা: নূর আলী বলেন, দেশে প্রায় ১৮ শ’ রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স আছে। এসব লাইসেন্স প্রতিবছর রিভিউ করা দরকার। লাইসেন্স পদ্ধতি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, যে লাইসেন্সের বয়স চল্লিশ বছর, অন্য দিকে যে লাইসেন্স নতুন কাজ শুরু করেছে, তার কাজের মান এক হবে না এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে।
ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এখন আর আগের অবস্থায় নেই। সব যায়গায় সমস্যা। এই সমস্যা ঠিক করতে হলে সরকারকে আগে এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর সব জায়গায় সমস্যা আছে, বিদেশে কোনো সমস্যা হলে এক চিঠিতেই সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কেন রাস্তায় নামতে হবে?
তিনি বলেন, ২০১৩ সালের অভিবাসন আইন আছে। কিন্তু এর মূল্যায়ন করা হয় না। সিআইডি ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানবপাচার আইনে মামলা দিয়ে হয়রানি করে। তিনি বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সি কোনো অপরাধ করলে প্রথমে বাদির সাথে সমঝোতার সুযোগ দিতে হবে, তাতে সমাধান না হলে আরপিটেশ হবে, তাতেও যদি কাজ না হয় তার পরে মামলা করা যাবে।
নূর আলী বলেন, বাংলাদেশের যে সুযোগ রয়েছে, পৃথিবীর যে চাহিদা তাতে ৫ কোটি মানুষের অভিবাসন হওয়া দরকার ছিল। সারা পৃথিবী বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের সে ধরনের মার্কেটিং বা নিকেশিয়েশন নেই।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’র (বিএমইটি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাফরিজা শ্যামা বলেন, দালাল নামে একটা গ্রুপ আছে যাদের আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। তাদের দোষারোপ আপনাদের ঘাড়ে আসুক এটা চাই না। যাদের আমরা দালাল বলছি তাদের আরো একটু সম্মানজনক জায়গায় আনি, জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। তাদের একটা আইনের মধ্যে আনলে সমস্যা ৮০ শতাংশ কমে যাবে।
রামরু’র চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বৈধভাবে কর্মী পাঠানো রিক্রুটিং এজেন্সির বিষয়ে কোনো অভিযোগ এলে সেটা প্রথমে আন্তঃমন্ত্রণালয়ে আলোচনা পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। এরপর সেখানকার সিদ্ধান্ত মোতাবেক অপরাধের ধরণ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা হতে পারে।
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ৬ হাজারের উপরে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ১০০ মামলা। বেশিরভাগ। ক্ষেত্রেই ঠিকমতো শাস্তি হয় না, লোক পাওয়া যায়নি বলে।
বিএফইউজে’র সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা আগে কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিএমইটির কাছে যাওয়া উচিত। তারাই বলবেন যে অভিযোগটি মানবপাচার আইনে নাকি অভিবাসন আইনে মামলা হতে পারে। আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত বিএমইটি’র নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের একটি টাস্কফোর্স হতে পারে। অভিযোগ এলে তারাই ঠিক করে দেবেন যে, এই অপরাধের জন্য কোন আইনে মামলা হবে।
সিনিয়র সাংবাদিক দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের প্রধান সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, বৈধভাবে বিদেশে যারা লোক পাঠান তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমে তাদের মানবপাচারকারী লেখা বা বলা উচিত হবে না।
বায়রা’র সাবেক সভাপতি আবুল বাশার বলেন, মানবপাচার আইনে যেভাবে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের হয়রানি করা হচ্ছে বা সম্মানহানি করা হচ্ছে; আমাদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে বিদেশে লোক পাঠাবো কি না। কারণ নুর আলী সাহেব বা আমাদের মতো লোকদের যদি মানবপাচারকারী বলা হয়, সম্মান বাঁচাতেই এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আমরা সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বায়রা’র সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম। বায়রা’র সদ্য বিদায়ী সভাপতি বেনজীর আহমেদ এমপির সভাপতিত্বে এতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. খন্দকার শওকত হোসেন, উপসচিব (এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস, বায়রা’র সাবেক সহ-সভাপতি শাহাদাত হোসেন ও আবুল বারকাত ভুইয়া, রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্যপরিষদ সভাপতি এম টিপু সুলতান, মিজানুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।