নারীর প্রতি বৈষম্য : হিন্দু নেতৃত্বে বিভক্তি
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২৩:৩৯, আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২৩:৪৩
বাংলাদেশে তরুণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি সংগঠন নারী, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের সম্পত্তির ভাগ পাওয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হিন্দু আইনে সংস্কারের দাবি তুলেছে। এই তরুণরা বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ নামে একটি নতুন সংগঠন তৈরি করে এই দাবি নিয়ে শুক্রবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছে। তবে হিন্দুদের পুরোনো একটি সংগঠন তাদের আইন সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে হিন্দুদের নেতৃত্ব সংস্কার প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
হিন্দু নেতাদেরই অনেকে বলেছেন, সংস্কার ইস্যুতে তাদের বিভক্তির পেছনে তাদের কোনো কোনো গোষ্ঠীর কট্টরচিন্তা ও প্রভাব বিস্তারের বিষয় থাকতে পারে বলে তারা মনে করেন। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, হিন্দু নেতাদের বিভক্তির কারণে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। সংস্কারের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেয়া হিন্দু নেতারা তাদের স্ব স্ব অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন।
'স্বামী বেঁচে থাকতেই তার সম্পত্তি লিখে দিতে হচ্ছে'
ঢাকায় একজন গৃহিনী শ্যামলী মুখার্জী দুই মেয়ে সন্তান নিয়ে স্বামীর সম্পত্তির অধিকার পেতে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি বলছেন, কোনো নারী বিধবা হলে তার ছেলে সন্তান না থাকলে তিনি স্বামীর সম্পত্তি ভোগ করতে পারলেও অংশীদার হতে পারেন না। এ জন্য শ্যামলী মুখার্জী তার স্বামী বেঁচে থাকতে দুই মেয়েকে সম্পত্তির অংশীদার করতে গিয়ে দেবরদের বাধা পেয়েছিলেন। তার বক্তব্য হচ্ছে, আমার স্বামী বেঁচে থাকতেই তার সম্পত্তি লিখে দিতে হচ্ছে। না হলে আমার দুই মেয়ে সম্পত্তি পাবে না।
হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সংবাদ সম্মেলন। ছবি : সংগৃহীত
সংস্কারের দাবিতে তরুণদের নতুন সংগঠন
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকে বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে হিন্দু আইনে সংস্কারের দাবি করা হয়েছে। এখন হিন্দুদের একদল তরুণ একটি সংগঠন তৈরি করে এই দাবি তুলেছে। হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ নামের এই সংগঠনটি হিন্দু আইনে নারী, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে এ ব্যাপারে সংস্কারের কথা বলছেন। তারা চাইছেন, বিয়ের নিবন্ধন ব্যবস্থা।
হিন্দু মেয়েদের বাবার সম্পত্তিতে অধিকার নেই। সেখানে মেয়েরা যাতে বাবার সম্পত্তিতে ছেলেদের সাথে সমান অধিকার পায়- নতুন সংগঠনটি আইনে সংস্কারের দাবিতে এই ইস্যুকে এক নম্বর অগ্রাধিকার দিচ্ছে। হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সভাপতি ড. ময়না তালুকদার বলেছেন, নতুন কোনো আইন নয়, তারা প্রচলিত প্রথানির্ভর আইনে সংস্কার চাইছেন। তার ভাষায়, হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার সূত্রে নারীদের বাবার সম্পত্তিতে যেমন অধিকার নেই, তেমনি স্বামীর সম্পত্তিতেও তারা অধিকার পান না। এটাই আমরা পরিস্কার করতে চাইছি। কিন্তু এসব সংস্কারের বিষয়ে হিন্দু নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ না থাকার বিষয়ও তিনি উল্লেখ করেন।
সংস্কার প্রশ্নে হিন্দু নেতৃত্বে বিভক্তি
আইনে সংস্কারের ব্যাপারে হিন্দুদের মধ্যেই ব্যাপক বিরোধিতা রয়েছে। কয়েক দিন আগেই জাতীয় হিন্দু মহাজোট নামের একটি পুরোনো সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে সংস্কার-বিরোধী বক্তব্য দিয়েছে। সংগঠনটির নেতা গোবিন্দ প্রামাণিক বলেছেন, তাদের মধ্যে সঙ্ঘাত তৈরির জন্য হিন্দু আইনে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। হিন্দু নারীদের বিয়ের সময়ই বাবার সম্পত্তির বদলে স্বর্ণের অলঙ্কার ও নগদ অর্থ দেয়া হয়। সেখানে কখনো কোনো হিন্দু নারী বা পুরুষ সংস্কার চায়নি।
এমন দাবির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রমাণিক আরো বলেছেন, কিছু এনজিও ও কিছু মুসলিম লোকজন এখানে ইন্ধন জুগিয়ে আইনে সংস্কারের বিষয় আনছে।
'সব জট একসাথে খুললে জটলা লেগে যেতে পারে'
হিন্দুদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সব সময় সোচ্চার থাকে হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, নির্দিষ্ট এই ইস্যুতে তারা এখনো সাংগঠনিকভাবে কোনো অবস্থান ঠিক করেননি। তিনি ব্যক্তিভাবে মনে করেন, প্রচলিত আইনে সংস্কার না করে নতুন আইন প্রণয়ন করে কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা যেতে পারে। তবে সংস্কার প্রশ্নে হিন্দুদের মধ্যেই পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত যে রয়েছে, সেই বাস্তবতার মুখে ধাপে ধাপে সংস্কারের পক্ষে রানা দাশগুপ্ত।
তার ভাষায়, জট অনেক আছে। সব জট একসাথে খুললে দড়িতে জটলা লেগে যেতে পারে। ফলে যেটা আপাতত করা সম্ভব- সেটা নিয়ে এগুনো উচিত। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টানদের নেতা দাশগুপ্ত মনে করেন, বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকারের বিষয়ের আগে প্রথমে বিধবা হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্ন সামনে আনা যেতে পারে। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা নারী যখন স্বামীর সম্পত্তির অধিকার পাবেন, তখন সমাজটাকে উপলব্ধি করানো যাবে যে, মাকে সম্পত্তি দিলে ধর্ম ও সমাজ ধ্বংস হয়ে যায় না।
যদিও গত বছর একজন বিধবা হিন্দু নারীর এক রিট মামলায় হাইকোর্ট স্বামীর কৃষিজমিতে বিধবা নারীর ভাগ পাওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু হিন্দু সমাজে এর বাস্তবায়ন নেই বলে হিন্দু নারীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন।
রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, হিন্দুরা যত দেব দেবতার পূজা করে, তার বেশিরভাগ মূর্তিই হচ্ছে নারী। আমরা নারীদের পূজা করতে ভালোবাসি। কিন্তু যখনই সম্পত্তি দেয়ার প্রশ্ন ওঠে, তখনই আমরা চিৎকার করতে থাকি।
এ দিকে বাবার সম্পত্তিতে মেয়ের সমান অধিকার দেয়া ও বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগ রাখাসহ বেশ কিছু বিষয়ে হিন্দু আইন সংস্কারের প্রস্তাব সরকারের আইন কমিশন তৈরি করেছিল ২০১৭ সালে। কিন্তু তা আর সামনে এগোয়নি।
হিন্দু আইনে সংস্কারে বাধা নেতৃত্বের বিভক্তি ও সরকার
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, হিন্দুদের নেতারা একমত না হওয়ায় তারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। একপক্ষ আমার কাছে সংস্কারের প্রস্তাবসহ আইনের খসড়া দিয়ে গেছেন। আরেকপক্ষ এসে সেটার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। আমি তাদের দুই পক্ষকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঐকমত্য হয়ে তারপর আসতে বলেছি। তিনি আরো জানিয়েছেন, হিন্দুদের সিনিয়র নেতা ও মুরব্বীরাও তার সাথে দেখা করেছেন।
আনিসুল হক বলেন, তারা আশ্বস্ত করেছিলেন যে ঐকমত্য হয়েই তারা আমার কাছে আসবেন। এ পর্যন্তই ব্যাপারটা গড়িয়েছে।
এখন সংস্কারের দাবি তুলেছে নতুন যে সংগঠনটি, তারা বিরোধিতাকারী নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করে ঐক্যবদ্ধ একটা জায়গায় আসার চেষ্টা চালানোর কথা বলছেন। কিন্তু হিন্দু আইন নিয়ে যাদের কট্টোর অবস্থান, তারা বলছে, সংস্কার ইস্যুতে তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে এগুনো কতটা সম্ভব হবে- তা নিয়ে তারা সন্দিহান।
সূত্র : বিবিসি