নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও রোহিঙ্গা ইস্যু এজেন্ডায় থাকবে : ইইউ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:১৩
বাংলোদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি রেনসে তিরিঙ্ক বলেছেন, কোভিড-১৯ মহামারী এবং আফগানিস্তান সঙ্কটের মতো নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও রোহিঙ্গা ইস্যুর স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এটি এজেন্ডা থেকে অদৃশ্য হবে না।
বিদায়ী ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমার কাছে ম্যাজিক রেসিপি বা ক্রিস্টাল বল নেই যে কীভাবে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে এটি (রোহিঙ্গা ইস্যু) এজেন্ডা থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে না।’
বর্তমানে আফগানিস্তানের পরিস্থিতিও খুব গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত তিরিঙ্ক বলেন, ‘এর মানে এই নয় যে রোহিঙ্গা ইস্যু অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমি এটি অনুসরণ করতে থাকব।’
‘বাংলাদেশ-ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্ক : ভবিষ্যত সম্ভাবনা’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় (ওয়েবিনার) মূল বক্তা হিসেবে ইইউ দূত এসব কথা বলেন।
কসমস গ্রুপের জনহিতকর প্রতিষ্ঠান কসমস ফাউন্ডেশন অ্যাম্বাসডর লেকচার সিরিজের অংশ হিসেবে এই ওয়েবিনার আয়োজন করে।
আলোচনায় উদ্বোধনী বক্তব্য দেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান। সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত কূটনীতিক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী।
এছাড়াও আলোচক প্যানেলে সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. জিয়াদি সাত্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ফাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এবং কসমস ফাউন্ডেশনের ইমেরিটাস উপদেষ্টা সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম উপস্থিত ছিলেন।
এনায়েতুল্লাহ খান ক্রমবর্ধমান মার্কিন-চীন দ্বন্দ্ব, কোভিড -১৯ মহামারী, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আফগানিস্তানে সঙ্কটের মতো বিষয়গুলো তুলে ধরে বলেন, মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুটি মানুষের মন থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুকে অত্যন্ত জটিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত, চীন ও জাপান এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের সহযোগিতা ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করা যাবে বলে আমি মনে করি না।
রাষ্ট্রদূতের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, মিয়ানমারের সৃষ্ট এই সমস্যা সমাধানে ইইউ বাংলাদেশকে কী সহায়তা করতে পারে।
জবাবে ইইউ রাষ্ট্রদূত তিরিঙ্ক বলেন, ‘মিয়ানমারকে অবশ্যই প্রথমে একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে, কিন্তু এটা খুবই দুঃখজনক যে ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে যা সত্যিই এই অলোচনার ক্ষেত্রে এক বিরাট ধাক্কা।’
জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে তৎপরতা সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত বলেন, দুর্ভাগ্যবশত তারা সেখানকার পরিস্থিতি দেখেছে এবং এটি খুব ইতিবাচক নয়।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ, ভারত, চীন এবং জাপানের সাথে অংশীদার হিসেবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা যোগাযোগ করছি। এটি আমাদের সব সময় এজেন্ডায় থাকে।’
আন্তর্জাতিক এনজিও এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে ইইউ রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকার সহায়তায় উল্লেখযোগ্য তহবিল প্রদান করে আসছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বড় ধরনের সহিংসতার পর দেশটি থেকে প্রায় সাত লাখ ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বতর্মানে কক্সবাজার ও নোয়াখালীর ভাসানচরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এছাড়া এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে এক লাখ ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুকে অর্থনৈতিক স্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মহামারী এবং রোহিঙ্গা-দু’টি বিষয় এখন বাংলাদেশের জন্য বড় উদ্বেগ এবং এই দু’টি বিষয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির সাথে জড়িত।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গা ইস্যু এবং টিকা কূটনীতিতে ইইউ সক্রিয় ভূমিকা পালন করুক।
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ইউরোপের মূল্যবোধ-আইনের শাসন, সরকার পদ্ধতি এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে মিয়ানমারের সাথে ইইউর সম্পর্কের বিষয়টি আসলে তা মিলানো যায় না।
তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারছি না ইইউ পার্লামেন্ট কেন বর্তমান মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্ভট গণতন্ত্রকে সহায়তা করে। ইইউ মিয়ানমারের নির্বাচনেও সহায়তা করেছে। সামরিক কর্মকর্তারা যখন সংসদে বসেন তখন এটা গণতন্ত্র থাকে না। ইইউকে আরো কঠিন হওয়া উচিত ছিল এবং এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেত।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গা ইস্যু এবং টিকা কূটনীতিতে ইইউ সক্রিয় ভূমিকা পালন করুক।
তিনি বলেন, কিন্তু যখন মিয়ানমারের কথা আসে ৯০০ এর বেশি মানুষ হত্যার পরও ইইউ এখনো মিয়ানমারের সাথে প্রায় একই ধরনের সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে। আপনারা কেবল কিছু সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন যারা কখনো ইইউ দেশগুলোতে যায় না এবং তাদের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। আপনারা খুব সম্প্রতি মিয়ানমারকে ঋণ পরিশোধেও সহায়তা করেছেন।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ইইউ মিয়ানমারের সাথে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এটি চীন ও থাইল্যান্ডের পর মিয়ানমারের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। তাই, আমি এখানে ব্যবসায়িক আগ্রহ এবং রাজনীতি দেখছি। আমি বুঝতে পারি যে ইইউ তার ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সত্যিকার অর্থে চাপ দিতে পারছে না।’
তিনি বিদায়ী ইইউ রাষ্ট্রদূতকে ব্রাসেলসে ফিরে আসার পর রোহিঙ্গা ইস্যুকে অর্থনৈতিক স্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করার আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আরো বলেন, শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে ইইউ মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাবে না, যদিও ইরান ও উত্তর কোরিয়াসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
তিনি বলেন, যতক্ষণ না পরিস্থিতি আরো উন্নত হয় যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইইউ আফগানিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে, কিন্তু মিয়ানমারে তা করবে না। ৯০০-এরও বেশি লোক নিহত হয়েছে, কিন্তু আপনারা এখনো সেদিকে যাননি।
তিনি বলেন, নেদারল্যান্ডস ছাড়া ইইউ দেশগুলোর কেউই আর্ন্তজাতিক আদালতে গাম্বিয়ায় প্রকাশ্যে সহায়তা করেনি। যদিও ইইউ সাময়িক রায়কে স্বাগত জানিয়েছে, কিন্তু তারা সহায়তা করছে না।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গণহত্যা ইস্যুতে সামগ্রিকভাবে ইউরোপ খুবই সক্রিয় ছিল, কিন্তু এখানে যখন মিয়ানমারের কথা আসে তখন তারা চুপ থাকছেন।’
এই আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘উইঘুরদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ক্ষেত্রে আপনি চীনের সমালোচনাকারী, কিন্তু মিয়ানমারের ক্ষেত্রে আপনি চুপ। সুতরাং, আমি মনে করি এটি দিন দিন ক্ষতি হচ্ছে এবং একপর্যায়ে জনগণ ইউরোপকে গুরুত্ব সহকারে নেবে না এবং তাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় উপায়টি হলো রোহিঙ্গা প্রবাসীদের নাগরিক সত্তা গঠনে সহায়তা করা, কারণ ইউরোপে বিশেষ করে জার্মান, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা সংগঠন রয়েছে। ইউরোপের রোহিঙ্গা প্রবাসীরা বেশ সক্রিয় এবং ভালো অবস্থানে রয়েছে।’
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, যখন একটি দেশ গণহত্যা করে তখন তা দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিসেবে থাকে না কারণ সংজ্ঞা অনুসারে এটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমি মনে করি ইইউ’র একত্রিত হওয়ার সময় এসেছে এবং রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডাকা উচিত।
ইমতিয়াজ বলেন, সেই সম্মেলন থেকে একটি নাগরিক সত্তা গঠন করা যেতে পারে।
মিয়ানমারের ভূরাজনীতিতে ভারত, চীন এবং জাপান এই তিনটি দেশ গুরুত্বপূর্ণ বলেও ইমতিয়াজ আহমেদ উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূত তিরিঙ্ক যখন ব্রাসেলসে ফিরে যাবেন তখন সমস্যাটি সমাধানের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারেন। কারণ রোহিঙ্গাদের দুর্দশা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক করিম বলেন, দু’টি বড় সমস্যাগ্রস্ত দেশ মিয়ানমার এবং আফগানিস্তানের পাশে বাংলাদেশের অবস্থান। এই দু’টি সমস্যা সমগ্র অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এর প্রভাব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিরাপত্তা এবং বিশ্বব্যাপীও অনেক প্রভাব পড়বে।
তিনি ইইউকে শুধু বিশ্বব্যাপী নয়, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়নের আহ্বান জানান।
রাষ্ট্রদূত তিরিঙ্ক অন্যান্য অংশীদারদের সাথে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সক্রিয় ভূমিকা রাখার আশ্বাস দিয়ে আলোচনা শেষ করেন।
সূত্র : ইউএনবি