১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সাংবাদিকতা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে : আবদুস শহিদের স্মরণ সভায় বক্তারা

সাংবাদিকতা এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে : আবদুস শহিদের স্মরণ সভায় বক্তারা - ছবি- সংগৃহীত

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবদুস শহিদের স্মরণ সভায় সাংবাদিক নেতারা বলেছেন, সাংবাদিকতা এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে। সরকার এবং মালিকপক্ষের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় এখন মড়ক ধরেছে। বাকস্বাধীনতা নিয়ে আজ লেখক-সাংবাদিকরা চরম সংকটে রয়েছেন উল্লেখ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, এখন কথা বলতেও ভেবেচিন্তে বলতে হচ্ছে। পরিস্থিতির কারণে শুধু গণমাধ্যমই নয়, নাগরিকরাও নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে। কিছু লিখলে বা বললে সরকারের বিরুদ্ধে যায় কিনা, প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে যায় কিনা, এটি এখন বড় সংশয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজ মঙ্গলবার সকালে ডিইউজে'র সাবেক সভাপতি, এনটিভির বার্তা সম্পাদক আবদুস শহিদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এই স্মরণ সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, দ্য নিউ নেশন পত্রিকার এডিটর মোস্তফা কামাল মজুমদার, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি এম আবদুল্লাহ, মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কবি আবদুল হাই শিকদার, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাকের হোসাইন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মোরসালিন নোমানী,সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ, সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, এনটিভির পরিচালক নুরুদ্দিন আহমেদ,এনটিভির যুগ্মবার্তা সম্পাদক ফখরুল আলম কাঞ্চন, বিএফইউজের সাংগঠনিক সম্পাদক খুরশিদ আলম, ডিইউজের সহসভাপতি বাছির জামাল, রাশেদুল হক, সাবেক সহসভাপতি আমিরুল ইসলাম কাগজী, সাংবাদিক নেতা মাহমুদ হাসান, সাদ বিন রাবি, একেএম মহসিন, দিদারুল আলম, আমিরুল ইসলাম অমর,গাজী আনোয়ারুল হক, খন্দকার আলমগীর হোসাইন, আবুল কালাম, রফিক মুহাম্মদ, জেসমিন জুঁই, মনির আহমেদ জারিফ প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।

রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আবদুস শহিদ ছিলেন সৎ, সাহসী ও নির্ভীক সাংবাদিক।তার অকাল মৃত্যু সাংবাদিক সমাজের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। জাতির এই ক্রান্তিকালে তার মতো সৎ, সাহসী ও নির্ভীক সাংবাদিক নেতার খুব প্রয়োজন ছিল।

তিনি বলেন,আবদুস শহিদ সাংবাদিক হিসেবে বরাবরই পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে চাননি। নীতির প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। ফোরামের নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ।

শওকত মাহমুদ বলেন, আবদুস শহিদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় অকপটে সত্য বলতে পারতেন। মেরুদণ্ড সোজা করে হাটার মতো সাংবাদিক কমই আছেন, আব্দুস শহিদ ছিলেন তেমন এক ব্যক্তি। তিনি গণতন্ত্রের জন্য, মুক্তমতের জন্য, কথা বলার স্বাধীনতার জন্য, সাংবাদিকদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।

সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, গণতন্ত্রের শত্রুরাই গণমাধ্যমের শত্রু। এই শত্রু হচ্ছে তারা, যারা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করতে চায় এবং লুটেরাতন্ত্র কায়েম করতে চায়। তারা স্বাধীন গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ মনে করে। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যমান গণমাধ্যমের সঙ্কট নিরসনে মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।

মোস্তফা কামাল মজুমদার বলেন, যে দেশে গণতন্ত্র থাকে না, সে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও থাকে না। আমাদের সংবিধানে বাক স্বাধীনতার কথা উল্লেখ থাকলেও কেউ সেটা মানছে না বরং গণমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যেখানে সত্য প্রকাশেই বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সাংবাদিকের কলম স্বাধীন নয়, সেটি কাজ করছে উপর মহলের নির্দেশে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে তিনি গণতন্ত্রের চর্চার উপর জোর দেন।

এম আবদুল্লাহ বলেন, আবদুস শহিদের অকাল মৃত্যু আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। তার মৃত্যু আমাদের জন্য এ অপূরণীয় ক্ষতি। সাংবাদিক সমাজ তার অবদানের কথা কোনো দিন ভুলবে না। আমরা তার তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করে এজন্য দোয়া করছি।

সভাপতির বক্তব্যে কাদের গনি চৌধুরী বলেন, আবদুস শহিদ গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতার জন্য সব সময় সংগ্রাম করে গেছেন। তার অকাল মৃত্যুতে আমরা ব্যথিত হয়েছি। তিনি বলেন, আবদুস শহিদ যে সাংবাদিকতার জন্য লড়াই করেছেন সেটি আজ ধবংসের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা আজ আধমরা হয়ে গেছে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় মড়ক ধরেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিলুপ্ত প্রায়। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা আজ কেড়ে নেয়া হয়েছে। যেখানে সাংবাদিকদের হওয়ার কথা ছিল 'ওয়াচডগ'। সেখানে সাংবাদিকরা আজ সত্য কথা লিখতে পারছেন না। লিখতে হচ্ছে সরকার ও মালিক পক্ষকে খুশি রেখে।

এম এ আজিজ বলেন, আবদুস শহিদ এতো অল্প সময়ে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে তা ভাবিনি। তার অকাল মৃত্যু খুবই কষ্টদায়ক। তার জন্য সাংবাদিক সমাজে এক শূন্যতা বিরাজ করছে। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে শহিদ ছিল আপসহীন। শহিদ তার জীবন চলায় কথা বলতো খুবই কম। আর যখন কথা বলতো তখন ন্যায় ও সততার সঙ্গে সে বজ্রকন্ঠে কথা বলতো। আমি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং আল্লাহ তাকে বেহেসত নসিব করুক এই প্রার্থনা করছি।

নুরুল আমিন রোকন বলেন, নুরুল আমিন রোকন বলেন,দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক।

আবদুল হাই শিকদার বলেন,  দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে থাকা আইনটি যেন মানুষের বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে৷ গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে যারা নিজেদের মতপ্রকাশ করে থাকেন, তাদেরকে সবসময়ই আতংকে থাকতে হয়৷

কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, একটি দেশে স্বাধীন সংবাদপত্র না থাকলে সেখানকার মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকে না। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত মিয়ানমার এবং তার দেশের নাগরিক রোহিঙ্গারা। আমি মনে করি, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় বাধা দেয়া বড় অন্যায়। দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ যাতে ক্রমাগত সংকীর্ণ ও দুর্বল হয়ে না পড়ে সেদিকে সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে দেশবাসী সবসময় সোচ্চার থাকা প্রয়োজন। নয়তো স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও মুক্ত সংবাদমাধ্যমে পেশাদার সাংবাদিকতায় আগ্রহীদের সংখ্যা কমে যাবে। যা পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও কাঠামোর জন্য বড় ধরনের ক্ষতি।

ইলিয়াস খান বলেন,যে কোন দেশেই আইন তৈরি হয় জনগণের সুবিধা অসুবিধার কথা বিবেচনা করে৷ সুবিধার কথা মাথায় রেখে তৈরি আইনের কারণে যদি অসুবিধার মাত্রা বেড়ে যায়, তখন আবার আইনে পরিবর্তনও আসে, অনেক সময় তা বাতিলও হয়ে যায়৷ কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় এর উল্টা প্রবণতা৷ দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে থাকা আইনটি যেন মানুষের বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে৷ গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে যারা নিজেদের মত প্রকাশ করে থাকেন, তাদেরকে সবসময়ই আতঙ্কে থাকতে হয়, এই বুঝি তার উপর এই আইনের খড়গ নেমে এলো।

মোরসালিন নোমানী বলেন, সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বের সঙ্কটের এই প্রেক্ষাপটকে ধাক্কা দেয়ার জন্য দরকার শক্তিশালী আইনি কাঠামো ও সাংবাদিকদের ঐক্য৷ দু'টিই আমাদের দেশে বিরল৷ আমাদের সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আইন না থাকলেও তাদের শেকল পরানোর মতো আইন ও নীতিমালার সংখ্যা অর্ধশতের কাছাকাছি৷ সবশেষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাইবার অপরাধী ও সাংবাদিকদের একই কাতারে সামিল করার চেষ্টা পেশাদারিত্বে শৃংখল বাড়িয়েছে৷
প্রেস বিজ্ঞপ্তি

 


আরো সংবাদ



premium cement