ভূমি অফিসে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে : টিআইবি
এসএসসি পাশ হয়েও সাব রেজিস্ট্রার- অনলাইন প্রতিবেদক
- ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:০১, আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:৩৮
ভূমি দলিলের ক্ষেত্রে সেবা গ্রহণকারীদের জিম্মি করে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি। জবাবদিহিতা এবং সুশাসন এই খাতে কাজ করছে না বলেও জানান দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থার নির্বাহী ডক্টর ইফতেখারুজ্জামান।
আজ সোমবার দুপুরে ধানমন্ডির টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়।
ভূমি দলিল নিবন্ধন সেবায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে টিআইবি।
ভূমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দূর করতে টিআইবির পক্ষ থেকে ১৫ দফা সুপারিশও করা হয়েছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দলিল নিবন্ধক ও দুর্নীতি সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, নকল নবিশ পদে তালিকাভুক্তি এবং নকল নবিশ থেকে স্থায়ী কর্মচারী হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়। এক্ষেত্রে মেয়র, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর সুপারিশ প্রয়োজন হয়।
নকল নবীশ নিয়োগ জেলা রেজিস্ট্রারের এখতিয়ার হলেও এক্ষেত্রে নিবন্ধন অধিদফতরের সিদ্ধান্তই মনোনয়নে প্রাধ্যান্য পায়।
অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে থেকে কোনো চাহিদা না থাকলেও মন্ত্রণালয়-অধিদফতর থেকে নিয়োগের সুপারিশ বা অনুমোদন হয়। সাব-রেজিস্ট্রারসহ অন্যান্য কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতির জন্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের নিয়মবহির্ভূত অর্থের লেনদেন হয়।
বর্তমানে সাব রেজিস্ট্রার নিয়োগ পিএসসির মাধ্যমে হলেও সাব-রেজিস্ট্রারের একাংশ বিভিন্নভাবে নিয়োগ পেয়েছেন।
প্রতিবেদনে উঠে আসে, মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী বিভাগীয় কোটায় ৫ শতাংশ, প্রধান অফিস সহকারী থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। মুজিবনগর সরকার কর্মচারী নিয়োগে ১৯৭ জন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তদের একাংশের বয়স ১৯৭১ সালে ১৮ বছরের কম ছিল। বিভাগীয় প্রধান অফিস সহকারী থেকে পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের একাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এসএসসি পাশ ব্যক্তিও রেজিস্ট্রার পদে পদোন্নতি লাভ করেছেন। নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। তবে পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার পর থেকে লেনদেনের মাত্রা কমে গেছে বলে জানিয়েছেন একজন সাব রেজিস্ট্রার।
অন্যদিকে সাব-রেজিস্ট্রারদের বদলির জন্য নিয়মবহির্ভূত অর্থের লেনদেন ও প্রভাব বিস্তার বা তদবির করা হয়। বিশেষ করে পছন্দনীয় স্থানে বদলির জন্য বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। নিবন্ধন সেবাও দুর্নীতিপ্রবণ হওয়ায় সাব রেজিস্ট্রার অফিসগুলোতে বদলির বিষয় এবং এক্ষেত্রে লেনদেনের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। তাদের বদলির ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূতভাবে ৩ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা দিতে হয়। এলাকাভেদে নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেনের পরিমাণ কম-বেশি হয়। ঢাকার আশপাশের এলাকার জন্য ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত অর্থের লেনদেন হয়েছে। আবার সাব-রেজিস্ট্রার থেকে জেলা রেজিস্ট্রার পদে পদোন্নতি নিয়মবহির্ভূত অর্থের লেনদেন রয়েছে। নকল নবিশ পদে তালিকাভুক্তি এবং অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রেও নিয়মবহির্ভূত দিতে হয়। নকল নবিশদের তালিকাভুক্তির কাজে যোগদানের জন্য ২০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দলিল নিবন্ধন ফি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে সেবা গ্রহীতাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। ফলে তারা সহজেই দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। ভূমি দলিল নিবন্ধন সেবা জনগুরুত্বপূর্ণ এবং সরকারের রাজস্ব আহরণের অন্যতম প্রধান উৎস। রাজস্ব আহরণের অন্যতম প্রধান উৎস হওয়া সত্ত্বেও এই সেবার যুগোপযোগী মানোন্নয়নে আইনি, পদ্ধতিগত, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যথাযথ পরিকল্পনা ও উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। আর্থিক দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী লেখকদের একাংশের যোগসাজশে কার্যকরতায় ঘাটতি রয়েছে। ভূমি নিবন্ধনে প্রতিটি পর্যায়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির উপস্থিতি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুনীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে এবং সেবাগ্রহীতা, সরকারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ভূমি দলিল নিবন্ধন সেবাখাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করতে দুটি জিনিসকে গুরুত্ব দেয়া উচিত জানিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়মের সাথে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। কর্তৃপক্ষের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। দুর্নীতির অংশীজনদের নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং করা, দুর্নীতিপরায়ণদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে সেবাগ্রহীতারা হয়রানি থেকে রক্ষা পাবেন, সরকারের রাজস্ব আহরণ আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
দ্বিতীয়ত প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি ও আধুনিকায়নকে গুরুত্ব দেয়া। যদিও সরকার এই কার্যক্রম গ্রহণ করলেও অগ্রগতি নেই। এক্ষেত্রে ই-নিবন্ধনসহ পুরো প্রক্রিয়াকে ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। এটা সম্ভব হলে এই খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম কমে আসবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সুলতানা কামাল, উপদেষ্টা (নির্বাহী) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা পরিচালনা ও প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রোগ্রাম ডেপুটি ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) শাম্মী লায়লা ইসলাম ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) নিহার রঞ্জন রায়।