২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৬ শাবান ১৪৪৬
`
বাংলাদেশের ই-জিপি

সরকারি ক্রয়খাতের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে বাজার দখলের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ : টিআইবি

‘বাংলাদেশের ই-ক্রয়কার্য : একচ্ছত্র বাজার, যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের লক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন - ছবি : সংগৃহীত

আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার এবং রাজনৈতিক শক্তির ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি ক্রয়ের বাজার দখল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ‘বাংলাদেশের ই-ক্রয়কার্য : একচ্ছত্র বাজার, যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের লক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রভাবশালী ঠিকাদারদের চক্র আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনৈতিক চর্চার মাধ্যমে সুস্থ প্রতিযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে। মন্ত্রণালয় বা সরকারি সংস্থার উচ্চপর্যায়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেতৃত্বের পরিবর্তনে শীর্ষ কার্যাদেশগুলো হাত বদল হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। টিআইবি এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সরকারি ক্রয়ে সুশাসন নিশ্চিতে ছয় দফা সুপারিশ করেছে।

সার্বিক চিত্র

২০১২-২০২৪ সময়কালে দেশের ৬৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ই-জিপি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মোট ৬৬৬,৪৭৪ টি ক্রয়কার্যের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে উঠে এসেছে, ২০১১ সালে চালু হওয়ার পর থেকে, বাংলাদেশ ই-জিপি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ৫,৯৬,৯২১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এই পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ রেকর্ডকৃত চুক্তির মূল্য ৮৮১ কোটি টাকা। এর চেয়ে বেশি মূল্যের সকল চুক্তি এই প্ল্যাটফর্মের বাইরে রয়েছে। শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ঠিকাদার মোট চুক্তির মূল্যের ৬১.৩১ শতাংশ অর্জন করেছে, অন্যদিকে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ ঠিকাদারের বাজার অংশীদারিত্ব সব মন্ত্রণালয়ের জন্য এক শতাংশ এরও কম।

বাজার দখল

অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ে, শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ঠিকাদার এক দশকে তাদের বাজার অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৭৪.৯৬ শতাংশ কাজ করেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ ঠিকাদারদের দখল ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অন্যতম সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। এছাড়া, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ (কার দখলে কতো?)

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ : মাত্র ১১ শতাংশ (৩৮৪ জন) ঠিকাদার ৯৩.৫৫ শতাংশ মোট চুক্তিমূল্যের কাজ করেছে। ৩৫ জন ঠিকাদারই ৭২.৯ শতাংশ বাজার দখল করেছে।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় : ৯ শতাংশ (৩৩৬ জন) ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৯১.৫ শতাংশ কাজ করেছে। মাত্র ৩৮ জন ঠিকাদার ৩০.৯ শতাংশ বাজার দখল করেছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় : ৭.৪৫ শতাংশ (৬০৭ জন) ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৭১ শতাংশ কাজ করেছে। ৮১ জন ঠিকাদার ৩২.৩২ শতাংশ বাজার দখল করেছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগ : ৯.৭৪ শতাংশ (২৮৬৫ জন) ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৬২.৮৮ শতাংশ কাজ করেছে। ২৯৪ জন ঠিকাদার ২৭.৭ শতাংশ বাজার দখল করেছে।

যোগসাজসের নেটওয়ার্ক

বাজার দখলের পেছনের কারণ হলো শীর্ষ ঠিকাদাররা যৌথ উদ্যোগ বা জয়েন্ট ভেঞ্চার গঠন করে বড় প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ। গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগে নয়টি বড় ঠিকাদারি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকিউরমেন্টে ১২টি প্রধান ঠিকাদারি সম্প্রদায় চিহ্নিত হয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ১১টি ঠিকাদারি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। শীর্ষ ঠিকাদাররা যৌথ উদ্যোগ গঠনের মাধ্যমে বাজারের বড় অংশ দখল করে রেখেছে। এই ঠিকাদাররা জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে যে চুক্তিমূল্যে কাজ করেছে, তা এককভাবে প্রাপ্ত কাজের পাঁচগুণ।

রাজনৈতিক প্রভাব

রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তন সরকারি প্রকল্প লাভের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শীর্ষ ঠিকাদারদের আধিপত্যকে প্রভাবিত করে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনের ফলে শীর্ষ ঠিকাদারদের আধিপত্য বদলে যায়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র পরিবর্তনের সময় শীর্ষ ১০ ঠিকাদারের সম্পূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আবার, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মেয়র পরিবর্তনের ফলে শীর্ষ ঠিকাদার বদলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মাত্র দু’জন ঠিকাদার দু’ মেয়রের সময়কালেই কাজ পেয়েছেন, এ ছাড়া দু’ মেয়াদে শীর্ষ ঠিকাদারের তালিকা একেবারে বদলে গেছে। অনুরূপভাবে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পরিবর্তনের সময়ও একই রকম পরিস্থিতি দেখা গেছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি ক্রয়খাত সারাবিশ্বেই সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ, তবে বাংলাদেশে তা নিয়ন্ত্রণহীন দখলদারিত্বের হাতে জিম্মি দশায় নিমজ্জিত হয়েছে। ২০১৮ সালে আমাদের একটি গবেষণায় আমরা দেখেছি যে প্রাতিষ্ঠানিক ক্রয়খাতের দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য মোট ক্রয় বাজেটের ২৭ শতাংশ পর্যন্ত অপচয় হয়। প্রত্যাশা ছিলো, ই-জিপি ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হবে, সরকারি ক্রয়খাতে দুর্নীতি কমবে এবং ব্যয়িত অর্থের সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল ই-জিপির মাধ্যমে ডিজিটাইজেশন করা হলেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যায়নি বরং ইলেক্ট্রনিক ক্রয় ব্যবস্থাকেও কুক্ষিগত করে আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার এবং রাজনৈতিক শক্তির ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি ক্রয়ের বাজার দখল আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২০১২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পাঁচ লাখ কোটি টাকারও বেশি সরকারি ক্রয়খাতে ব্যয় করেছে শীর্ষ ১০টি মন্ত্রণালয়। যার সিংহভাগ, ৬১ শতাংশ কার্যাদেশ পেয়েছে শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ঠিকাদার। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক এই কার্যাদেশ প্রাপ্তির হার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭৪ শতাংশ অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ এখানে বাজারের বিশাল অংশ প্রভাবশালী ঠিকাদারদের দখলে। দ্বিতীয়ত, একক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রভাবশালী ঠিকাদারদের চক্র নীতিমালার ফাঁকফোকর ব্যবহার করে যৌথ অংশীদারত্ব বা জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে কার্যাদেশ নেয়ার সুযোগকে একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার পথ রুদ্ধ করেছে ও দখলদারিত্ব আরো ঘণীভূত করেছে। আবার, ই-জিপি কর্তৃপক্ষের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে মন্ত্রণালয় বা সরকারি সংস্থার নেতৃত্বের পরিবর্তন হলে শীর্ষ কার্যাদেশগুলো হাত বদল হয়েছে কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থেকেছে। যা ক্রয়খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অকাট্য প্রমাণ।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদ পরবর্তী রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রেক্ষিতে একই অবস্থা অব্যাহত থাকবে কি-না-এ প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি এবং ই-জিপি প্রক্রিয়ার যুগোপযোগী সংস্কারের ওপর নির্ভর করবে। তবে এ ক্ষেত্রে বাস্তব সুফল অর্জন রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও চর্চায় ইতিবাচক পরিবর্তন ছাড়া অসম্ভব।’

গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে গবেষণা দলের প্রধান ও টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ই-জিপি সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইনের অপপ্রয়োগ করে অনিয়মকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে, বিশেষত জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার পরিবেশ ধ্বংস করা হয়েছে। ই-জিপি প্রর্বতনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল প্রতিযোগিতা বাড়ানো, কিন্তু সে চিত্র আমরা দেখছি না বরং আইনের ঘাটতিকে পুঁজি করে বাজার দখলের চর্চা অব্যাহত আছে বলেই আমরা মনে করি এই দুর্বল আইনের সংস্কার প্রয়োজন।’

টিআইবির সুপারিশমালায় রয়েছে বিপিপিএ কর্তৃক জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা, যাতে যোগসাজশের মাধ্যমে বাজার দখলে সুযোগ না থাকে; সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে বিপিপিএ কর্তৃক প্রতিযোগিতামূলক আইন প্রণয়ন করা এবং জয়েন্ট ভেঞ্চারের কার্যক্রম সীমিতকরণ; মার্কেট শেয়ারের ক্ষেত্রে একক ঠিকাদার ও জয়েন্ট ভেঞ্চারের একটি সীমারেখা নির্ধারণ করা, যাতে সকলে সমান সুযোগ পায়; বিপিপিএ-সহ ক্রয়কার্যক্রমে জড়িত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক ভালো চর্চাগুলো বজায় রাখা এবং বাজারে একচ্ছত্র বাজার ব্যবস্থার বদলে প্রতিযোগিতমূলক পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা; পাবলিক প্রকিউরমেন্ট নীতিমালা সংশোধন করা, যেন প্রতিষ্ঠান ও জয়েন্ট ভেঞ্চারের বেনিফিসিয়াল ওনারশিপের তথ্য সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং যে চুক্তিগুলো ই-প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ায় হয়নি সেগুলোকে দ্রুত ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসা।

সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।

এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা দলের সদস্য অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর রিফাত রহমান ও কে এম রফিকুল আলম।

বিজ্ঞপ্তি


আরো সংবাদ



premium cement