জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড

Justice delayed is justice denied এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে সমাজজীবনে। বাংলাদেশে এর ছায়াপাত দেখা যাচ্ছে জুলাই বিপ্লবে হতাহতদের প্রার্থিত বিচারের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতায় যেন বিচারের বাণীকে নীরবে নিভৃতে কাঁদতে না হয়।

প্রধান উপদেষ্টার একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে আজকের প্রসঙ্গের অবতারণা। তিনি নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির একমাত্র সন্তান মেঘকে সরকারি একটি প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন। এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, সন্দেহ নেই। কিন্তু যে অবোধ শিশু ১৩ বছর আগে চোখের সামনে বাবা মাকে নৃশংসভাবে খুন হতে দেখেছে- আজ সে ১৮ বছরের টগবগে তরুণ। এই প্লট প্রাপ্তির বদৌলতে সে কি তার দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারবে? তার বাবা-মার খুনিরা সমাজে প্রকাশ্যে চলাফেরা করবে- এটি সে মেনে নিতে পারবে? ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচারকাজ সমাপ্ত হয়নি; বরং তদন্ত প্রতিবেদন ১২০ বারেরও বেশি পিছিয়েছে। এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও নানা টালবাহানা করে প্রতিবেদন দাখিলের সময় পেছানো হয়েছে। যেসব সংস্থা বা তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন তাদের ব্যাপারে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। খুনিদের আড়াল করার এটি কোনো অপকৌশল কি না খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

প্রশ্ন উঠতেই পারে মেঘকে এক টুকরো জমি উপহার দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা কি- চলমান বিচারহীনতার সংস্কৃতির কাছে নীরবে আত্মসমর্পণ করলেন? নইলে ব্যর্থতার জন্য তদন্তকারীদের কেন আইনের মুখোমুখি করা হলো না? তারা কি রাষ্ট্রযন্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী? সাগর-রুনির ঘটনা কি রাষ্ট্রের ভেতর আরেক রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জানান দেয় না? চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না, আমরা ভালো নেই। সাধারণ জনগণের জন্য নেই আইনি সুরক্ষা, নেই দ্রুততম সময়ে বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনা। আইনের প্রতি বিতৃষ্ণা, অবজ্ঞা আর অশ্রদ্ধার সৃষ্টি এখানেই। মবতন্ত্রের সুপ্ত বীজ এখানেই নিহিত। আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এই ধরনের চৌকস (?) পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দেয়ার। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায় নির্বাচন কমিশনের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচনকালীন সময় কমিশনের কাছে দায়বদ্ধ। এ কথা হয়তো তিনি ভুলে গেছেন।

আর একটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। বাংলা ১৮২০ সালে আমার এলাকায় কিছু ভূস্বামী মিলে সূচনা করেন শ্যামাপূজা উপলক্ষে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতি, চিত্তবিনোদনের জন্য ঢেমঢেমিয়া কানি মেলার। যা মাসব্যাপী চলত। প্রথম ১০ দিন চলত মহিষ ও গরু বেচাকেনা, পরবর্তী ২০ দিন বারোয়ারি মেলা। আশপাশের জেলা থেকেও ব্যবসায়ীরা মেলায় আসতেন। তারা খোলা আকাশের নিচে তাঁবু খাটিয়ে থাকতেন। নিজেরা রান্না করে খেতেন। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান হওয়ার পর মেলা পরিচালনা ও স্বত্ব নিয়ে জোতদার ও পূজারি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। পরে মামলা মোকদ্দমায় গড়ায়। সে মামলা আজও চলমান। ইতোমধ্যে এই মামলার তদন্তকারী অফিসাররা বেঁচে নেই এবং তার পরবর্তী অফিসাররা অনেকই জীবন সায়াহ্নে অথবা মৃত্যুবরণ করেছেন। বেঁচে নেই- বিচারকরাও। বাদি-বিবাদির এখন চতুর্থ পুরুষ চলমান। যারা মামলা করেছিলেন তারা বছরের পর বছর মামলা চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত। মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। এই দুটো উদাহরণ টানলাম এ কারণে যে, দুটো ঘটনাই প্রমাণ দেয় মামলার সুরাহা, আইনি সুরক্ষার অবস্থা।

আইন কমিশন ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ জনগণের বিপরীতে রয়েছেন একজন বিচারক। ভারতে যা ১ : ৪৭০০০, পাকিস্তানে ১ : ৫০০০০, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ : ৩০০০। বর্তমানে দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪৫ লক্ষাধিক। শুধু সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রয়েছে পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার ৭৫১টি মামলা। নি¤œ আদালতে বিচারাধীন মামলা প্রায় ৩৭ লাখ। বর্তমান বিচারিক আদালত ও বিচারক দিয়ে এই বিপুল সংখ্যক মামলা দ্রুততার সাথে নিষ্পত্তি করা অসম্ভব। প্রতিদিন প্রতিটি কোর্ট যদি ১০০ মামলার নিষ্পত্তি করেন, তাহলেও বর্তমানে বিচারাধীন মামলাগুলোর নিষ্পত্তিতে প্রায় তিন বছরের বেশি সময় লেগে যাবে। এ অবস্থায় অত্যন্ত দ্রুত ও যৌক্তিকতার সাথে বিচারিক আদালত ও বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। এক্ষেত্রে জাতীয় অর্থনীতির ওপর এর চাপ বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। অপরদিকে মামলার দীর্ঘসূত্রতায় বাদি-বিবাদি উভয়ের উপর যে মানসিক আর্থিক ও সামাজিক চাপ তৈরি হয় তার কোনো তুলনা হয় না। মামলায় কেউ যেন অযৌক্তিকভাবে দীর্ঘসূত্রতা ঘটাতে না পারে সেজন্য বাদি-বিবাদি, কৌঁসুলি, তদন্তকারী কর্মকর্তা সবাইকে ‘টাইমলাইনের আওতায় এনে কঠোর জবাবদিহি ও শাস্তির বিধান তৈরি করা প্রয়োজন।

সেই সাথে একই মামলার বারবার শুনানির পরিবর্তে শুনানির সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া যায় কিনা- বিবেচনা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন জনসচেতনতারও। প্রতিশোধমূলক মামলা ও মিথ্যা মামলার ব্যাপারে জনগণকে নিরুৎসাহিত করার সাথে সাথে শাস্তিমূলক ব্যবস্থারও বিধান থাকা প্রয়োজন। হাইকোর্ট ডিভিশনগুলোকে প্রয়োজনের নিরিখে বিভাগীয় সদর দফতরে স্থাপন করা যায় কিনা- ভেবে দেখা প্রয়োজন। এতে একদিকে জনভোগান্তি কমবে, অন্যদিকে সাধারণ জনগণের ওপর আর্থিক চাপ কমবে। সব কিছুর লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের কষ্টের লাঘব। বিচার বিভাগকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার গুরুত্ব জাতি গত বছরগুলোতে প্রত্যক্ষ করেছে। বিচারব্যবস্থা স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত না হলে ফরমায়েশি রায়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

বিচারব্যবস্থায় গতি সঞ্চারের জন্য যেমন বিচারিক আদালত ও বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন; একইভাবে স্বাধীন পুলিশ কমিশনও সময়ের যৌক্তিক দাবি। ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত পুলিশি ব্যবস্থা ছাড়া আইনের শাসন অধরাই থেকে যাবে। সাগর-রুনি হত্যা মামলা তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ। দীর্ঘায়িত বিচারিক সংস্কৃতি জনগণকে বিচার বিভাগ ও আইনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। সৃষ্টি করে মবতন্ত্রের। জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হয় আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আইনি সুরক্ষার পথে যা বড় চ্যালেঞ্জ।

Justice delayed is justice denied এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে সমাজজীবনে। বাংলাদেশে এর ছায়াপাত দেখা যাচ্ছে জুলাই বিপ্লবে হতাহতদের প্রার্থিত বিচারের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতায় যেন বিচারের বাণীকে নীরবে নিভৃতে কাঁদতে না হয়।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ