গত ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই ঘোষণা পাঠ করেন। একই সাথে তিনি আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন। তখন থেকে দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় নির্বাচন। পরিস্থিতি নির্বাচনমুখী। এ নির্বাচন উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ ও সর্বজনীন হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেছেন। নতুন ভোটারসহ প্রবাসীরাও এই প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নেবেন। ২০০৬ সালের পর প্রথম প্রভাবমুক্ত ভোটাধিকার প্রয়োগের এই ঘোষণায় সবাই উৎফুল্ল ও আনন্দিত। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় জাতীয় রাজনীতি নির্বাচনমুখী হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ। গণতন্ত্রায়নের এই সুযোগ থেকে জাতি বঞ্চিত হয়েছে গত ১৫ বছর। এই সময়ে জালভোট, রাতের ভোট, ডামি প্রার্থী, ভোটারবিহীন ভোটের প্রহসন দেখেছে জাতি। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঘিরে জনগণ এখন নতুন আশার আলোয় উজ্জীবিত। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় চলছে নির্বাচনী প্রচারণা। নির্বাচনী আবহে গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর মুখর হয়ে উঠেছে। কিন্তু সম্ভাবনাময় নির্বাচনী যাত্রার মধ্যেও কেন যেন আশঙ্কার কালো মেঘ পিছু ছাড়ছে না। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে তো? হলে তা কতটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে? জনমনে বিরাট প্রশ্ন। এর কিছু কার্যকারণও আছে।
প্রথমত, সর্বজনীন উৎসবমুখর নির্বাচনের সামগ্রিক প্রস্তুতি, সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা, প্রতিরোধ কৌশল, মস্তান বাহিনীর পেশিশক্তি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা- অংশীজনের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সর্বজনীন করার ব্যবস্থা বা আয়োজনের যথেষ্ট দুর্বলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভোটার সচেতনতা সৃষ্টির কোনো কর্মসূচি দৃশ্যমান নয়। ভোটার সচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারলে কলাগাছ দাঁড় করালেও নির্বাচিত হয়ে নেতার তুষ্টি বিধানের সংসদ সৃষ্টি হবে। প্রার্থীদের শিক্ষা, বয়স, আর্থিক সঙ্গতি ইত্যাদি জনপ্রতিনিধি হওয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না- এ বিষয়ে কোনো বিধিবিধানের অনুপস্থিতি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। অন্য দিকে ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক নেতাদের পুরনো সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের খুব একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। তাদের কথাবার্তায় স্পষ্টই বোঝা যায়, নির্বাচনকে নিজের পক্ষে আনার জন্য তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। এটি যেন শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ না হয়ে ওঠে তা নিশ্চিত করার শক্ত আইনি ব্যবস্থা কমিশন আজো ঘোষণা করেনি। সবচেয়ে বড় কথা, একটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন পরিচালনার অভিজ্ঞতাহীন এই কমিশন কিভাবে জাতীয় নির্বাচনের মতো বিশাল কার্যক্রম পরিচালনা করবে?
দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর দক্ষতা ও জবাবদিহির ক্ষেত্র এখনো নির্ণীত হয়নি। এ ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীকে স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠন করে তাদের কাজের জবাবদিহির ব্যবস্থা করলে পুলিশ দলীয় পেটোয়াবাহিনীর ভূমিকা নেবে না। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগেই যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য, পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকেও এই পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অজানা কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
পুরান ঢাকার সাম্প্রতিক ভাঙ্গাড়ি ব্যবসায়ী হত্যা, গোপালগঞ্জের ঘটনা এবং গাজীপুরে সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তার ওপর ঢাকা শহরের বুকে সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণের ঘটনা এবং এতে আইনশৃঙ্খলা ও অন্যান্য বাহিনীর সম্পৃক্ততা সবাইকেই নতুন করে ভাবাচ্ছে। পতিত সরকারের সময় তারা এতই দক্ষ ছিলেন যে, মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা অপরাধীদেরও শনাক্ত ও পাকড়াও করতে পেরেছেন। অথচ এখন প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেও অপরাধীদের পাকড়াও করে দ্রুত বিচারে সোপর্দ করার ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা দৃশ্যমান। নির্বাচনে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার মোকাবেলায় তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। অন্য দিকে জুলাই বিপ্লবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত পুলিশের ক্ষেত্রবিশেষে পদোন্নতি পেয়ে সদর্পে বহাল থাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
তৃতীয়ত, পতিত সরকারের আনুকূল্যে যেসব আমলা পদোন্নতি পেয়েছিলেন তারাই এখনো সচিবালয় এবং মন্ত্রণালয়গুলোর বিভিন্ন কমিটিতে সদর্পে ভূমিকা পালন করছেন, সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। সাথে সাথে বিভিন্ন জেলার ডিসি ও ইউএনওকে নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত করার বিরাট ঝুঁকির কথা কমিশন ভাবছেন কি না বোঝা যাচ্ছে না। এরাই ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। এদের দায়িত্বে ও তত্ত¡াবধানে নির্বাচন হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। নির্বাচনকে আমলা প্রভাবমুক্ত করার উপায় এবং প্রতিরোধ কৌশল তৈরির ব্যাপারে সময় ক্ষেপণ করা সমীচীন হবে না।
চতুর্থত, নানা ক্ষেত্রে গত সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত এখনো বাতিল করা হয়নি। এমনি এক সিদ্ধান্তের আলোকে অতীতে কমিশনকে রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করা হয়েছিল। এসব বিধিনিষেধের বেড়াজালে কমিশনের স্বাধীন ও সুষ্ঠুভাবে কাজ সম্পাদন ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এসব সিদ্ধান্ত অনতিবিলম্বে বাতিল করা উচিত। জাতীয় নির্বাচনের আগে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অন্তত ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনের আয়োজন করা দরকার। নইলে কমিশনের সামান্য ভুলও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, জুলাই বিপ্লবের যাবতীয় অর্জন ও স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে। এমন হলে তার সব দায় প্রধান উপদেষ্টার ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে। তার সম্মানজনক বিদায় অসম্ভব করে তোলার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীতে পতিত সরকারের অনুগত ব্যক্তিরা এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে না- এমন ভাবার কারণ নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতির প্রারম্ভিক কাজগুলো দ্রুত করে ফেলা দরকার।
আগামী জাতীয় নির্বাচন এক দিকে যেমন নতুন সম্ভাবনার আগমনী বার্তা দিচ্ছে, একই সাথে তা কালো মেঘের আভাসেও চিত্রিত। ভোটার তালিকা হালনাগাদের কথা বলা হলেও ভোটার কর্মীরা সব জায়গায় যাননি। তালিকাভুক্ত হতে পারেননি অনেক ভোটার। এটি নিঃসন্দেহে কমিশনের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের বিপরীতমুখী ভূমিকাও নির্বাচনী পরিবেশকে বিশৃঙ্খল অবস্থানের দিকে ঠেলে দিতে পারে। নির্বাচনী পরিবেশকে সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর রাখার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও প্রিন্ট এবং ইলেকট্র্রনিক মিডিয়ার নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। মোট কথা, নির্বাচন সুষ্ঠু, সর্বজনীন ও উৎসবমুখর করতে হলে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ত্বরিত সিদ্ধান্ত জরুরি।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ