সাধারণত ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবীণ নাগরিক বলা হয়। সামাজিক প্রেক্ষিত, আঞ্চলিক বিভিন্নতা এবং নৈতিক আইনি কাঠামোতে এর ব্যত্যয় লক্ষ করা যায় সর্বত্রই। বিশেষ করে পৃথিবীর নেতৃত্বের ক্ষেত্রে। বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেরই, বিশেষ করে ক্ষমতাধর দেশগুলোর নেতৃত্ব এর চেয়ে বেশি বয়সী ব্যক্তিদের হাতে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ইরান, তুর্কিয়ে, ভারত এবং বাংলাদেশের দিকে তাকালে এর সত্যতা মেলে।
সিনিয়র সিটিজেন মানেই তিনি অপাঙ্ক্তেয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে, অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারে তিনি অবদান রাখতে পারবেন না এমন চিন্তা নিতান্তই ভ্রান্ত; বরং সিনিয়র সিটিজেনরাই অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিচ্ছেন, যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। তবে তরুণদের রয়েছে কর্মস্পৃহা এবং স্বপ্ন। প্রবীণ ও তরুণের সম্মিলনী যেখানে সেখানেই রয়েছে সাফল্য।
জাতিসঙ্ঘের গাইডলাইনের আলোকে ২০১৩ সালে বয়স্কদের জন্য জাতীয় নীতির আলোকে বাংলাদেশে সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবীণের বয়স নির্ধারণ করা হয় ৬০ বছর। সমাজে বয়স্কদের সম্মানজনক অবস্থান, শারীরিক ও আর্থিক নিরাপত্তাসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এ নীতিনির্ধারণ করা হয়। এই হিসাবে ২০১১ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৩ লাখ। বছরে এ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৪.৪১ শতাংশ।
ফলে ২০৬১ সালে এ জনসংখ্যা দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশে, অর্থাৎ তিন কোটি ৬০ লাখে। কর্মহীন এই জনগোষ্ঠী প্রভাব ফেলবে পরিবার ও জাতীয় আর্থসামাজিক জীবনে। কারণ এই জনগোষ্ঠীর বড় অংশ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভোগেন। আজীবন এদের চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। তাই প্রতিটি পরিবারকে অধিক পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজে। যা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করবে সবাইকেই।
প্রবীণদের বার্ধক্যজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা, কর্মক্ষমতার সীমাবদ্ধতা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব এসব বিবেচনায় নিয়ে ১৯৮২ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত হয় প্রবীণবিষয়ক বিশ্ব সম্মেলন। পরবর্তীতে মাদ্রিদে ২০০২ সালে ১৫৯ দেশের স্বাস্থ্যকর্মী ও সমাজকর্মীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গৃহীত হয় প্রবীণদের জন্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালা। যা মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনা হিসেবে পরিচিত। প্রবীণ নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং নিরাপদ জীবন নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে এই ঘোষণায়। এর অংশীজন বাংলাদেশও। এ ছাড়াও কর্মক্ষমদের কাজের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে প্রবীণদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করাসহ বার্ধক্যজনিত ব্যক্তিগত সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত জটিলতার মোকাবেলায় বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার কথাও বলা হয়েছে এই ঘোষণায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, যানবাহনে, পথ চলাচলে, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সেবার ক্ষেত্রে প্রবীণদের প্রাধান্য দেয়ারও অঙ্গীকার রয়েছে ঘোষণায়।
পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে এবং পূর্ব গোলার্ধের সিঙ্গাপুর, জাপান, চীন প্রভৃতি দেশে প্রবীণদের রয়েছে বিভিন্ন প্রাধিকার। ট্রেনে, বিপণিবিতানে, বিমান ভ্রমণে, বিভিন্ন সেবা কেন্দ্রে প্রবীণদের দেয়া হয় বিশেষ সুবিধা, যা একজন প্রবীণের জীবন সহজ করে। দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশে একমাত্র বয়স্ক ভাতা ছাড়া প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য আর কোনো দৃশ্যমান সুবিধা নেই।
মাদ্রিদ ঘোষণার আলোকে বাংলাদেশ সরকারের প্রবীণ জাতীয় নীতিমালায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে প্রবীণদের অধিকার ও মর্যাদা। বিভিন্ন ভাতার ক্ষেত্রে রাজনীতিকরণ প্রাধান্য পাওয়ায় এই ভাতার সুফল প্রকৃত প্রাপকদের কাছে পৌঁছেনি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ভবিষ্যতে যারা দেশের দায়িত্ব নেবেন অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দলের কর্মপরিকল্পনায় প্রবীণদের কোনোরকম উল্লেখ দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত।
বর্তমানে দেশে প্রায় দেড় কোটি প্রবীণ এবং এক কোটি এতিম ও পথশিশু আছে। এদের সমাজের মূল অংশ থেকে বাদ দিয়ে কিভাবে দেশের উন্নয়ন সম্ভব তা বোঝা কঠিন। পক্ষান্তরে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে প্রবীণদের সমাজ বিচ্ছিন্নতা প্রকট আকার ধারণ করছে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে প্রবীণদের শ্রম ও আত্মত্যাগের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে। প্রবীণদের হেয় করা বা অস্বীকার করার অর্থই হচ্ছে শেকড়ের সাথে বিচ্ছিন্নতা। এ ক্ষেত্রে প্রবীণদের প্রতি ইসলামের নীতিমালা যেমন সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সমৃদ্ধ করে- তাদের অবদানের স্বীকৃতি দেয় তার তুলনা পৃথিবীর অন্য কোনো জীবনাচারে দেখা যায় না। প্রবীণরাই অতীত ও ভবিষ্যতের সংযোগসূত্র। তাদের অশ্রদ্ধা, হেনস্তা, অপমান, অবহেলা পুরো মানবজাতি ও মানবসভ্যতার প্রতি অসম্মান।
ক’দিন আগে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার সংখ্যাও।
প্রবীণ জনগোষ্ঠীতে পুরুষের চেয়ে নারীদের দুর্ভোগ বেশি। প্রবীণদের জীবন সহজ ও স্বচ্ছন্দ করার লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সব কিছুই প্রবীণবান্ধব করার কৌশল এখন থেকেই গুরুত্বের সাথে শুরু করা প্রয়োজন। প্রবীণরা সমাজকে সমৃদ্ধ করতে পারেন, পারেন সমৃদ্ধির দিকনির্দেশনা দিতে, এ কথা চিন্তায় রেখে এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে সুপরিকল্পিতভাবে সমাজে আত্তীকরণ করতে পারলেই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে উঠতে পারে, যেখানে প্রবীণরা সম্মান ও মর্যাদার সাথে বাস করতে পারবেন।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ