ইমদু কথকতা এবং আশঙ্কা

জুলাই ঘোষণায় প্রাপ্তির অসম্পূর্ণতা রাজনৈতিক দল ও পক্ষগুলোর মধ্যে নতুন করে বিভাজন সৃষ্টির শঙ্কা তৈরি করেছে। সম্ভবত এই উপলব্ধি থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, যেকোনো অবস্থায় রাজনীতিবিদদের মধ্যে যেন মুখ দেখাদেখি বন্ধ না হয়। রাজনৈতিক অনৈক্যে এবং বিভিন্ন ঘটনার অন্তরালে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের পটভূমি তৈরি হচ্ছে না তো!

৩০ মে, ১৯৮১ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের হাল ধরেন। তিনি তখন গুরুতর অসুস্থ। ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। হাসপাতালের বিছানা থেকে তিনি শোকবিহবল জাতির হাল ধরলেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে দেশে সুস্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়। জিয়াউর রহমানের শাহাদতে দেশে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার কালো মেঘ ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করলেও বিএনপির অভ্যন্তরে ক্ষমতার মেরুকরণের একটি বিবদমান ধারা রাজনীতির আকাশে কালো মেঘের সৃষ্টি করে। বাকশালীয় শাসন সময়ে রাষ্ট্রায়ত্তকৃত পাটকলগুলো ব্যক্তিমালিকানায় ফিরিয়ে দেয়া এবং ক্ষমতার বলয় সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে অন্তর্দলীয় বিরোধ চরমে ওঠে। এই বিভেদে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ান তৎকালীন সেনাপ্রধান। তিনি নিজ এখতিয়ারের বাইরে এসে ফেরত দেয়া পাটকলগুলোর আগের কোনো শ্রমিককে বাদ দেয়া যাবে না বলে সরকারকে একরকম চরম নোটিশ দিয়ে বসলেন। শুধু তাই নয়, সরকার পরিচালনায় সেনাবাহিনীর হিস্যা দাবি করার পাশাপাশি তিনি সুশীলসমাজ এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ বাড়িয়ে জনমত তৈরির কর্মসূচি নেন। এক পর্যায়ে শুরু হয় দেশে অস্থিরতা তৈরির নানাবিধ ন্যারেটিভ।

এসব ন্যারেটিভের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠে ইমদু। বিটিভিতে ধারাবাহিকভাবে পরিবেশিত হতে থাকে ইমদু উপাখ্যান। এতে সুকৌশলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ বলে দেখানো হতে থাকে। ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে শুরু হয় আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি। ঘটনাপ্রবাহ নাটকীয়তার চরমে ওঠে তৎকালীন যুবমন্ত্রীর বাসা থেকে ইমদুকে গ্রেফতারের মাধ্যমে। দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির দোহাই দিয়ে ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে নাটকীয়ভাবে রাষ্ট্রপতি আ: সাত্তার সাহেবকে সরিয়ে সেনাপ্রধান ক্ষমতা দখল করেন। মজার ব্যাপার হলো- পরে ইমদুর বিচার প্রক্রিয়া হারিয়ে যায় অন্ধকারে। দেশবাসী প্রায় এক দশকের জন্য বাঁধা পড়ে স্বৈরতন্ত্রের কবলে। পরে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হলে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কলহের কারণে ঘটে শতাব্দীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও নির্মম হত্যাকাণ্ড। আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার আন্দোলনে প্রকাশ্য রাস্তায় সাপের মতো পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জামায়াত-শিবির কর্মীদের। শুধু তাই নয়, মৃতদেহের ওপর উঠে নাচতে দেখা যায় হন্তারকদের। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের মধ্যে ওঠে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড়। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবও নিন্দা জানান। এ হত্যার বিচারিক মামলা পরে আওয়ামী লীগ সরকার প্রত্যাহার করে নেয়। হন্তারকরা ছাড়া পায়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি পূর্ণমাত্রায় বলবৎ হয়।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তঃকলহের পটভূমিতে আবারো দেশে জারি করা হয় সেনাশাসন যা পরে একদলীয় শাসন এবং স্বৈরশাসনের পথ সুগম করে। যা প্রমাণ করে, এই ঘটনা ছিল পরিকল্পিত ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ। একইভাবে ‘অপারেশন চাল-ডাল’-এর তথাকথিত অজুহাতে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় ঘটানো হয় ইতিহাসের সর্বোচ্চ সংখ্যক সেনাকর্মকর্তা হত্যার ঘটনা। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মাত্র কয়েক মিনিটে বিএনপির লাখো জনতার নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার ঘটনাও ছিল স্বৈরতন্ত্র প্রলম্বিত করার চক্রান্ত। এ ব্যাপারে তথাকথিত সুশীলসমাজের ভ‚মিকা ছিল নিন্দনীয়ভাবে আপসকামিতার। ফলে দেশে ঘটে ভোটারবিহীন নির্বাচনের তামাশা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস (?) বিজয়ে সুশীল সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং মিডিয়া ও ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশের মধ্যে হাসিনা তোষণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর ফলে দেশবাসী আরো কঠিনভাবে বাঁধা পড়ে স্বৈরশাসকের নিষ্ঠুর ও অমানবিক অত্যাচারের জাঁতাকলে। তৈরি হয় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির। রাজনীতিকে পাঠানো হয় হিমঘরে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরশাসকের পলায়ন দেশবাসীকে নতুন করে স্বপ্ন দেখার, আত্মপরিচয়ে উদ্ভাসিত হওয়ার আশায় উজ্জীবিত করে তোলে। পাশাপাশি পরাজিত অপশক্তি এই বিপ্লব নস্যাৎ করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। গ্রহণ করে নানা অপকৌশল। অভ্যুত্থানের পরপরই পোশাকশ্রমিকদের মাঠে নামিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টা করা হয়। আনসার বিদ্রোহ, সাত কলেজের ছাত্র আন্দোলন, সচিবালয়ে বিদ্রোহ- সব কিছুই ছিল পরিকল্পিত, যেন দেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা মুখ থুবড়ে পড়ে। গোপালগঞ্জের ঘটনা ও মাইলস্টোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সচিবালয়ে হামলাও এর বাইরে নয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কৌশলে বিভাজন সৃষ্টির- সাথে সাথে রাজনৈতিক নেতাদের অযাচিত ও অবাঞ্ছিত বিরোধ বারবার পতিত শক্তির আবির্ভাবের পথ প্রশস্ত করে।

ইতোমধ্যে লুকিয়ে থাকা, গুটিয়ে থাকা চেহারাগুলো মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সদর্পে মতামত দিচ্ছে। একই সাথে চ্যানেলগুলো আন্দোলনের সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে সরাসরি অপপ্রচারে নেমেছে। নতুন করে পিটার হাসের উপস্থিতি ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে জোসেফ ফারল্যান্ডের কর্মকাণ্ডের ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে। জুলাই ঘোষণায় প্রাপ্তির অসম্পূর্ণতা রাজনৈতিক দল ও পক্ষগুলোর মধ্যে নতুন করে বিভাজন সৃষ্টির শঙ্কা তৈরি করেছে। সম্ভবত এই উপলব্ধি থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, যেকোনো অবস্থায় রাজনীতিবিদদের মধ্যে যেন মুখ দেখাদেখি বন্ধ না হয়। রাজনৈতিক অনৈক্যে এবং বিভিন্ন ঘটনার অন্তরালে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের পটভ‚মি তৈরি হচ্ছে না তো?

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ

[email protected]