দু’টি পৈশাচিক ঘটনার মূল্যায়ন আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রথমটি হলো- ৯ জুলাই পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রাঙ্গণে সোহাগ নামে এক ভাঙ্গাড়ি ব্যবসায়ীকে পৈশাচিকভাবে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনা। অসংখ্য মানুষের সামনে (খবরের কাগজের সংবাদ অনুসারে) দায়িত্ব পালনরত আনসারদের দৃষ্টিসীমায় মাথা থেঁতলিয়ে হত্যা করার দৃশ্য স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার নয়। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় ১২ আগস্ট ১৯৬৯ সালে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ইটের আঘাতে মাথা থেঁতলিয়ে লোহার রড মাথায় ঢুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আব্দুল মালেকের মৃত্যু নিশ্চিত করার ঘটনা। এ ঘটনার নায়কদের কারোর বিচার হয়নি। পরবর্তী সময়ে প্রায় সবাই মন্ত্রী হয়েছেন, হয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধান। ভিআইপি মর্যাদায়-সদর্পে বিচরণ করছেন সমাজে। যা উৎসাহিত করেছে পরবর্তী বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ড এবং সন্ত্রাসকে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে ছয়জন ছাত্রহত্যা শেষে লাশের ওপর পৈশাচিক নৃত্য করা হয়। এর খুনিরা বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে সমাজে আদৃত, হোমড়া চোমড়া। স্মৃতি থেকে আজও মুছে যায়নি ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় শিবির সন্দেহে প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে।
২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তোফাজ্জল হোসেন নামক যুবককে পিটিয়ে হত্যাও ছিল রাজনৈতিক মদদে। একই বছর নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির নাহিদ হোসেনকে হত্যা করা হয় রাজনৈতিক প্রভাবের ছত্রছায়ায়। এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে রাজনীতির প্রশ্রয়ে অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞের। আবরার ফাহাদ ও বিশ্বজিৎ হত্যার লোকদেখানো বিচার ছাড়া বাকিগুলোর কোনো বিচার হয়নি। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি এবং পরবর্তীতে দলীয় প্রধান হওয়ার ও মন্ত্রী, হোমড়া চোমড়া পদ-পদবির মাধ্যমে পুরস্কৃত হওয়া এবং সমাজে প্রভাবের সাথে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ থাকায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
প্রশ্ন উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ, কর্মদক্ষতা ও দায়বদ্ধতার ব্যাপারে। বিশেষ করে গোপালগঞ্জের ঘটনা এই সত্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করিয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বিচারের আশ্বাস, ছাড় না দেয়ার ঘোষণা (এর আগেও দিয়েছেন) ঘোষণাই রয়ে গেছে।
দেড় হাজার ছাত্রহত্যার জন্য কমপক্ষে দেড় হাজার পুলিশ সদস্য জড়িত ছিলেন। তাদের কতজনকে শাস্তির মুখোমুখি করা হয়েছে, তা জানা যায়নি আজও। হয়নি পতিত সরকারের সময় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ-মহিলা লীগ, শ্রমিক লীগের অনুকূলে যেসব অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল সেগুলো উদ্ধার করা। আব্দুল মালেককে হত্যার মাধ্যমে যে বিচারহীনতার সূত্রপাত ঘটেছিল তার ধারাবাহিকতা এখন দৃশ্যমান। জুলাই বিপ্লবের বছর পূর্তিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে, দলীয় ভিত্তিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা পালিত হলেও উপেক্ষিত রয়ে গেছে হাজারো শহীদের খুনিদের বিচারপ্রক্রিয়া। জাতীয় বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কারের ক্ষেত্রে গা ছাড়া মনোভাবও দেখা যাচ্ছে।
নীরবে চলছে এই অপরাধীদের পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া। অপরাধীর মনে যখন প্রত্যয় জন্মায় যে, রাজনৈতিক তকমা থাকলেই অন্যায় করেও অধরা থাকা যায়; তখন সোহাগ হত্যার মতো ঘটনা ঘটে, ঘটে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষকে পিটিয়ে মারা; প্রাণ দিতে হয় বিশ্বজিতের মতো নিরীহ ব্যক্তিকে, হারিয়ে যেতে হয় আবরার ফাহাদের মতো মেধাবী ছাত্রকে। বিচারহীনতা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসন সাহস জুগিয়েছে গোপালগঞ্জের ঘটনা ঘটানোর। আইনি প্রক্রিয়ার দুর্বলতা এখানে অনুঘটকের কাজ করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দ্রুত ঢেলে না সাজালে ভবিষ্যৎ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের মধ্যে অনৈক্য, ‘দেশের চেয়ে দল বড়’ মনোবৃত্তি পতিত সরকারের সহযোগীদের সুযোগ করে দেবে নিঃসন্দেহে। আমাদের কোনোক্রমেই ভুলে গেলে চলবে না- রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ পিটিয়ে মারা, সচিবালয় ও এনবিআরের মতো সরকারের স্নায়ুকেন্দ্রে সরকারিবিরোধী মনোভাব, গোপালগঞ্জের মতো ঘটনা ঘটার জন্য জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়নি।
চাঁদাবাজি ও জবরদখলদারির রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের জন্য জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। পতিত সরকারের কুশীলবদের পুনর্বাসনের জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে লালন করার জন্য অসংখ্য প্রতিভা জীবনের সূচনায় ঝরে যায়নি। পঙ্গুত্ববরণ করেনি শালীনতা বর্জিত রাজনীতি চর্চার জন্য। গোপালগঞ্জের ঘটনা ঈশান কোণে ঝড়ো মেঘের ইশারাবাহী। যেকোনো মুহূর্তে তা ঘূর্র্ণিঝড়ের তাণ্ডব সৃষ্টি করে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে ভবিষ্যতের স্বপ্নকে।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ