সাংস্কৃতিক চেতনার গৌরবোজ্জ্বল ধারাবাহিকতার উপলব্ধি একটি জাতির সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ার অন্যতম প্রধান সোপান। সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য একটি জাতির প্রাণ। যে জাতি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারায় যত বেশি সম্পৃক্ত ও সিক্ত, সে জাতি তত বেশি উন্নত; নেত্বত্বের আসনে তত বেশি অগ্রগামী। নিজ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য যেসব জাতি হারিয়ে ফেলেছে তারা পরনির্ভর, অপরের করুণাপ্রার্থী। নিজেদের সব যোগ্যতা সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও শুধু সাংস্কৃতিক চেতনা ধারণ করতে না পারায় তাদের এই দুর্দশা। চব্বিশের জেন-জি বিপ্লব আমাদের দেশ, ইতিহাস ও কৃষ্টি সম্পর্কে নতুন করে নিজেকে আবিষ্কারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। নিজস্ব সাংস্কৃতিকস্বরূপ, চেতনা ও এর ধারাবাহিকতার ব্যাপারে নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়েছে। সুযোগ সৃষ্টি করেছে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা নতুন করে জানার, উপলব্ধি করার এবং এর সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করার।
আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের পরিমণ্ডলে সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে নবযাত্রার এক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল, সরকার এ ব্যাপারে একটি ইতিবাচক অবস্থান নেবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। ফলে এত দিন চলে আসা সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির করাল থাবা থেকে জাতির মুক্তি মেলেনি। মূলত সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা, অনুকরণ ও অনুশীলন জীবনকে করে তোলে অর্থবহ। তৈরি করে সামাজিক সুস্থিরতা ও দায়বদ্ধতা। পরিবার ও সমাজে শ্রদ্ধা বিনয়-আদর স্নেহ ও মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার সাথে সাথে ব্যক্তিজীবনকে আলোকিত করে। সুবিচার সদাচারের পরিবেশ সৃষ্টি করে। সামষ্টিক কল্যাণের চিন্তার বলয় সৃষ্টি করে। প্রতিটি জাতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক সত্তা ও স্বকীয়তা রয়েছে। এর রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় মৌলিক উপাদান, যা পরিবেশ, খাদ্যভ্যাস, ভাষা-শিক্ষা, লোকাচার ও জীবনাচারের অবদানে পুষ্টি লাভ করে, গতি পায়। ভিন্নতা সত্তে¡ও বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত, চিন্তাচেতনা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন থাকাটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে ঘটেছে এর বিপরীত। এ দেশে ২০-২৫ বছর আগের চিত্র ছিল ভোর হওয়ার সাথে সাথে প্রায় প্রতিটি মহল্লা থেকে ভেসে আসত পবিত্র কুরআন অধ্যয়নের আওয়াজ। এখন এর পরিবর্তে শোনা যায় সঙ্গীতচর্চার ধ্বনি। ছোট ছোট শিশুদের আগে মক্তবে পাঠানো হতো কুরআন ও নামাজ শেখার সাথে সাথে জীবনের সদাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য। এখন অভিভাবকরা অতি ভোরে শিশুদের নিয়ে ছোটেন গান শেখানোর প্রতিষ্ঠানে। নাচের চর্চার জন্য। আমাদের জাতীয় জীবনে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধারা হারিয়ে যাওয়ার বাস্তবতার প্রতিফলন দেখা যায় প্রাথমিক স্কুলে গান ও নাচ শেখানোর জন্য কয়েক হাজার শিক্ষকের পদ সৃষ্টির ঘটনা।
আমাদের সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের আরেকটি বড় চিত্র দেখা যায় মিডিয়ায়। আমাদের মিডিয়াগুলো এ দেশের মূল সাংস্কৃতিক জীবনাচার প্রতিফলিত করার চেয়ে বিদেশী ভাবধারার লালন ও প্রসারে একে অপরের প্রতিযোগী। ফলে আজ হাজার বছরের ঐতিহ্যের বিপরীতে বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন, পান্তা-ইলিশ নামক অদ্ভুতুড়ে এক সাংস্কৃতিক ধারার প্রচলনে উৎসাহ জুগিয়েছে। মিডিয়ায় প্রদর্শিত জীবনাচার-শব্দমালা অনেকটিই এ দেশের মূল সাংস্কৃতিক জীবনাচারের প্রতিনিধিত্ব করে না।
এর মাধ্যমে বিদেশী সাংস্কৃতিক চেতনার অবাধ প্রবাহ এ দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সুচিন্তিতভাবে জাতীয় চেতনার শব্দমালা বদলে ফেলা হয়েছে এবং হচ্ছে। এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বের পরিবর্তে প্রচলন করা হয়েছে পৌরোহিত্য, লাশ হয়ে গেছে মরদেহ, জানাজা হয়ে গেছে শেষকৃত্য। অনুষ্ঠানের শুরুতে সালামের পরিবর্তে শুভ সকাল, শুভ মধাহ্ন, শুভ সন্ধ্যা চালু হয়ে গেছে। অথচ পাশের দেশের অনুষ্ঠানের শুরুতে নমস্কার শব্দে তাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশকে তারা বিসর্জন দেয়নি। তাদের প্রতিটি অনুষ্ঠানে উলুধ্বনি ও শাঁখ বাজানোর নিয়মিত চর্চা অনুসরণের ব্যবস্থা রয়েছে। অন্য দিকে আমরা আজান তুলে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছি! নিয়মিত নামাজ পড়েন এমন টুপি-দাড়িওয়ালাদের পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে সস্ত্রাসী আখ্যায় আখ্যায়িত হতে হয়। আমরা এখন গলায় উত্তরীয় জড়িয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানমালায় যোগ দিয়ে প্রদীপ জ্বালানোয় অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা এখন অতীত। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার অন্যতম কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। সেখানেও জাতীয় ঐতিহ্যের মশাল বরদারদের সাহিত্য অনেকটা অপাংক্তেয়। পরিবর্তে যা পাওয়া যায় তা আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতিফলন তো নয়ই; বরং তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কর্ণধারদের অধিকাংশই আমাদের জাতীয় চেতনাও ঐতিহ্যকে ধারণ করেন না। আলাওল, কবি গোলাম মোস্তফা, কায়কোবাদ, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ- এসব নাম অতি চাতুর্যের সাথে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অপরিচিত করে দেয়া হচ্ছে।
শিল্পকলা একাডেমি এ ক্ষেত্রে আরো একধাপ এগিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে নেই জাতীয় চেতনার প্রতিফলন। সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হয় আমাদের নিজস্ব কোনো সাংস্কৃতিক সত্তা নেই, ঐতিহ্য নেই। যেন এই জাতি এক দিন অস্তিত্ব হারিয়ে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এরকম একটি পটভূমিতে চব্বিশের বিপ্লব স্বভাবতই আশার সঞ্চার করেছিল জাতির বুকে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল নিজ জাতিসত্তার বিকাশ, জাতিসত্তার মৌলিক উপাদান সাংস্কৃতিক পরিচয় ও ঐতিহ্যের ব্যাপারে কারোরই তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। মাথাব্যথা নেই জাতীয় নেতাদেরও। জাতির অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ার এর চেয়ে বিরূপ বাস্তবতা আর কি হতে পারে!
লেখক : চক্ষু বিশেষজ্ঞ



