২১ জুলাই ২০২৫। বেলা ১টা নাগাদ একটি ঈগল ডানা মেলে উড়ে গেল। স্বপ্ন তার আকাশের অসীম উচ্চতায় পৌঁছানোর; স্বর্ণ ঈগলের মতো আকাশের অসীম উচ্চতায় বিচরণ করে ডানা মেলে নিচের সবুজ শ্যামলিমাকে পাহারা দেবে। নিচে তখন অনেক স্বপ্নের ফুল ফুটছে। কেউ বৈমানিক হবে, কেউবা বিজ্ঞানী। চিকিৎসক অথবা ইঞ্জিনিয়ার, কেউবা পাড়ি জমাবে বিদেশে। আর এক অবুঝ শিশু ঈগলের উড়ে যাওয়া দেখে ভাবছে- আহা, আমিও যদি অমন করে উড়তে পারতাম। অকস্মাৎ আকাশ থেকে নেমে এলো- মৃত্যুদূত। মুহূর্তেই প্রচণ্ড আওয়াজ, আগুনের কুণ্ডলী স্বপ্নগুলোর অবসান ঘটাল। আকাশের উড়ন্ত ঈগলের পতনে নিচের স্বপ্নেরা পুড়ে ঝলসে গেল।
সারা দেশ স্তব্ধ হয়ে গেল। সময় যেন থমকে গেল। চতুর্দিকে শুধুই মৃত্যুযন্ত্রণা। ঝলসে যাওয়া যন্ত্রণার আর্তনাদ। টেলিভিশনের প্রতিটি চ্যানেলেই হৃদয়বিদারক বাকহীন এক মর্মন্তুদ দুর্ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন। নির্বাক রুদ্ধশ্বাসে সবাই টেলিভিশন স্ক্রিনের দর্শক। পোড়া-ঝলসে যাওয়া শিশুদের করুণ আর্তি, আহত ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের আর্তচিৎকার, উদ্ধারকর্মীদের প্রাণান্ত চেষ্টা সবাই দেখছে। রাজনৈতিক নেতাদের তাৎক্ষণিক আহত-নিহতদের পাশে দাঁড়ানো বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে যোগ করল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। জাতির দুর্দিনে ভেদাভেদ ভুলে আমাদের নেতারা যে একসাথে সাহায্য ও সহযোগিতার মানবিক ক্যানভাসে দাঁড়াতে পারেন তার নজির সৃষ্টি করলেন। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, দমকল বাহিনীর প্রাণান্তকর চেষ্টা দেশবাসী স্মরণ করবে কৃতজ্ঞতার সাথে। প্রধান উপদেষ্টাসহ প্রশাসনের ত্বরিত হস্তক্ষেপ হলো। এই বিমান দুর্ঘটনা অনেক জাতীয় দুর্বলতার দিকনির্দেশ করেছে। এর আলোকে সরকার জরুরি ভিত্তিতে পরিকল্পনা নিলে দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজে আসবে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো এবারো প্রমাণিত হয়েছে দুর্যোগ মোকাবেলায় যথাযথ প্রস্তুতির দুর্বলতা। জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী তখন জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, কোনো বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটলে ঢাকাবাসী অত্যন্ত অসহায়ভাবে ঘরে আটকে পড়ে মৃত্যুবরণ করবে। সাভার এলাকায় ড্রিল মেশিনের জন্য জনগণের কাছে তখন আবেদন জানাতে হয়েছিল। এবারো তার খুব একটা উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয় না। সিএমএইচের বার্ন ইউনিট না থাকলে হতাহতের সংখ্যা যে আরো অনেক বেড়ে যেত তা বলা যায় নিঃসন্দেহে। দিয়াবাড়ি থেকে ঢাকা মেডিক্যালের পাশে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে পৌঁছানো যে কত কষ্টকর তা সহজেই অনুমেয়। অথচ পাশেই বেশ কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে, রয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষণের জন্য হাসপাতাল। সেখানে পুড়ে ঝলসে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই এটা অবিশ্বাস্য। জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতাহীন হাসপাতাল বিশেষ করে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিএমডিসির তৎপর হওয়া প্রয়োজন। ঢাকা শহরে পুড়ে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য শহরের বিভিন্ন জায়গার হাসপাতাল তৈরির প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব এই দুর্ঘটনা তুলে ধরেছে। সাথে সাথে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সার্বিক প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তার দৈন্যদশার কথা আর একবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
সরকারিভাবে পরদিন জাতীয় শোক দিবস ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি তাদের পূর্বঘোষিত সব কর্মসূচি বাতিল করে প্রশংসাভাজন হয়েছে। জামায়াত নেতারাও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। নেতারা পাইলট তৌকিরের নামাজে জানাজায় শরিক হয়েছেন, নিহত ও আহতদের জন্য দোয়ার আয়োজন করে চিকিৎসার জন্য অনুদান ঘোষণা করে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। জাতীয় নাগরিক কমিটি মুনাজাত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, যা জাতীয় শোক দিবসের সাথে তাদের আত্মীকরণ করেছে। সরকারিভাবে ও বিভিন্ন আয়োজনে এই দিবসকে শোকের আবহে পালন করা হয়েছে। সারা দেশের প্রকৃতিতে ছিল শোকের আবহ। ব্যতিক্রম এ দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। তারা শোক দিবসের কালো স্টিকার লাগিয়ে দিনভর নাটক, গান আর কৌতুকের ভাঁড়ামো দিয়ে অনুষ্ঠান সাজিয়েছেন। চ্যানেলগুলোর কোনো অনুষ্ঠানেই প্রকাশ পায়নি জাতীয় শোক দিবসের আবহ। অথচ এই চ্যানেলগুলোকেই অতীতে আগস্ট-জুড়ে শোকাবহ অনুষ্ঠানসূচি প্রচার করার প্রতিযোগিতায় নামতে দেখা গেছে। আমাদের একজন সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা আছেন যিনি জাতির বর্তমান চাহিদা ও পরিবর্তনের আদলে মানানসই নয় বলেই মনে হয়েছে। জাতীয় শোক দিবসে নাটক, নাচ, গান আর কৌতুকের ভাঁড়ামোপূর্ণ অনুষ্ঠানের দায় তার ওপরও কিছুটা বর্তায়।
এই দুর্ঘটনা প্রমাণ করেছে আমাদের আকাশ মুক্ত রাখার দায়িত্বে যারা নিযুক্ত তাদেরকে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’ বানিয়ে রাখা হয়েছে। ২০১৩ সালের সংগৃহীত পুরনো প্রশিক্ষণ বিমান দিয়ে আর যা-ই হোক বর্তমান শতকে আকাশ পাহারার ট্রেনিং দেয়া যায় না। নিরাপদ করা যায় না দেশের আকাশকে। এর প্রমাণ ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাত ও ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ। যেখানে স্থলযুদ্ধের পরিবর্তে আকাশযুদ্ধই প্রাধান্য পেয়েছে। অথচ অতীতে জাতিকে বারবার বলা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত বিমান দিয়ে বিমানবাহিনীকে যুগোপযোগী করা হবে। অনেক প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ আলোচক বিভিন্ন চ্যানেলে ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। অথচ ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছরই প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। আলোচকরা ভুলেও এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি! এমনকি তাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি, এটি ছিল আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে পঙ্গু করে রাখার একটি অপচেষ্টা। শুধু তাই নয়, আমাদের বিমানবাহিনীকে বিদেশী কোনো এক বিমান কমান্ডের সাথে সংযুক্তির প্রস্তাবও ছিল বলে শোনা যায়। যে জন্য বিমানবাহিনীর যুগোপযোগী উন্নয়ন করা হয়নি। অথচ এসব আলোচক বিগত ১৮ বছরের দায় চাপাতে চাইছেন বর্তমান সরকারের ওপর। শুধু তা-ই নয়, বিমানবাহিনীর ঘাঁটি এখান থেকে সরিয়ে নেয়ার কথাও অনেক আলোচক বলছেন। এটা হলে তো পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেরই বিমানবাহিনীর ঘাঁটিগুলো সরিয়ে ফেলতে হয়। কেননা এগুলোর আশপাশে রয়েছে জনবসতি। তাদের কথা শুনলে তো বিমানবন্দরও সরিয়ে নিতে হয়। সম্ভবত এসব বুদ্ধিজীবীই নিকট অতীতে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন, আমাদের জন্য সেনাবাহিনীর আদৌ প্রয়োজন আছে কি না? তবে আমাদের আকাশ প্রতিরক্ষাকে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে আধুনিকায়ন করার বিকল্প নেই।
আর একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলেই নয়। বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় শব্দ-তরঙ্গের যে কম্পন সৃষ্টি হয় তা অনেক দিন ধরে চলতে থাকলে শ্রবণশক্তি, পরিপাকতন্ত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ধরনের এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না রাখাই ভালো।
এই দুর্ঘটনা কেন্দ্র করে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের দিয়ে পানি ঘোলা করার মাধ্যমে পতিত শক্তি ন্যূনতম সময়ে সংগঠিত হয়ে আবারো অস্থিতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পেরেছে। এটাও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা দরকার। মাত্র ক’দিন আগে সংঘটিত গোপালগঞ্জের ঘটনা; বর্তমানে সচিবালয়ে গেট ভেঙে রাতের আঁধারে হামলার ঘটনা জবাবদিহিতা অনুপস্থিতির ব্যাপারটিকে আবারো সামনে এনেছে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যর্থতা সামনের নির্বাচন সুষ্ঠু আয়োজন নিয়ে তাদের সক্ষমতার বিষয়টি সামনে আনছে। নির্বাচনের আগেই এসব বাহিনীকে জরুরিভাবে সুসংগঠিত বাহিনীতে রূপান্তরের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। ইদানীং অনেকেই সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনের পক্ষে ওকালতি শুরু করেছেন। এটা ভালো লক্ষণ নয়। সবকিছুই এখন একটি বার্তাই দিচ্ছে তা হলো- জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ