জুলাই অভ্যুত্থান নাগরিক ভাবনা

এই মুহূর্তে সবার আগে দরকার জাতীয় ঐকমত্য। জাতীয় স্বার্থে সব দলেরই ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। না হলে জাতির সামনে আবারো সঙ্কটের অমানিশা ঘনিয়ে আসতে পারে।

এ দেশের ইতিহাস অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার জন্য আপসহীন লড়াইয়ের ইতিহাস। মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে বারো ভূঁইয়াদের লড়াই, ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিতুমীরের বিদ্রোহ, ফকির মজনু শাহ, দেবি চৌধুরানী প্রমুখের লড়াইয়ের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে রচিত এ ইতিহাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদবিরোধী আন্দোলন- সবই একই চেতনায় উজ্জীবিত। জুলাইয়ের ছাত্র-গণবিপ্লব এর সর্বশেষ সংযোজন। প্রতিটি আন্দোলন ছিল আত্মত্যাগের মহিমায় জড়ানো। সমাজ পরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ। এসব আন্দোলন-সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রচিন্তা।

চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এই চিন্তা চেতনার আলোকে একটি দীপ্যমান ক্যানভাস। পুরনো সামন্তবাদী রাজনৈতিক চেতনাধারা, রাজনীতিতে পারিবারিক উত্তরাধিকার, বিচারের নামে অবিচার, শক্তি আর অস্ত্রের আওয়াজ বন্ধের আকাক্সক্ষা জন্ম দিয়েছিল এই গণ-বিপ্লবের। এক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে পুরাতনের অর্গল ভেঙে নতুন সমাজকাঠামো নির্মাণের চেতনা। নতুন সমাজগঠনের যে সংস্কারপ্রক্রিয়া তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত জটিল। রাজনীতির পুরনো ছন্দবৃত্তে যারা অভ্যস্ত, আমলাচক্র, সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী শ্রেণী, অলিগার্ক-বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, প্রচারমাধ্যম ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের সুবিধাভোগীর স্বার্থে ঘা লাগায়। সমাজে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। নেতাদের ভাষার ধরন পাল্টেছে। পাল্টেছে প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা; সংস্কারপ্রক্রিয়া রুখে দিতে উদ্যত আমলাতন্ত্র। অথচ একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র তৈরি হলে ন্যায়, কল্যাণ ও মানবিক মর্যাদা সমুন্নত হওয়ার সাথে সাথে মেধার সর্বাত্মক ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হবে। রাষ্ট্রীয় অগ্রযাত্রা গতিশীল হবে। মেধার সঠিক ব্যবহারের ফলে পশ্চিমাবিশ্ব আজ শিক্ষা, শিল্প, প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে পৃথিবীর নেতৃত্বের আসনে বসেছে।

মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে স্বাধীন নিরপেক্ষ ও ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা। যা সুরক্ষা দেবে সাধারণ নাগরিকদের, সরকারকে বিরত রাখবে সীমালঙ্ঘন থেকে। দলীয় প্রভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতিমুক্ত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার এই স্বপ্নই ছাত্র গণ-আন্দোলনকে শক্তি জুগিয়েছিল। ইনসাফভিত্তিক সমাজের মাধ্যমে ন্যায়বোধ, মানবিকতা ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনাও ছিল চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের মৌলিক লক্ষ্যের একটি। অন্য যে লক্ষ্য জুলাই বিপ্লবের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে তা হচ্ছে- একটি জবাবদিহিমূলক স্বচ্ছ সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। যে সরকারের মৌলিক লক্ষ্য হবে সুবিচার।

গত ৫০ বছরের সরকারব্যবস্থায় এর ব্যত্যয় ঘটায় দলের নামে, নেতার নামে চাঁদাবাজি, দখলদারি ও অলিগার্কের সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক অস্থিরতা। যাদের দাপটে জবরদখল, পেশিশক্তির প্রদর্শন এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কালো অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় জীবনে।

এই গণ-বিপ্লবের উন্নয়ন ভাবনায় একটি ইনসাফপূর্ণ দায়বদ্ধতা সম্পন্ন অর্থনৈতিক কাঠামোর অবস্থানও লক্ষ করা যায়। শুধু তাই নয়, সমাজ পরিবর্তন ও সরকার সংস্কারে সুশিক্ষা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের স্বপ্নও তাড়িত করেছে বিপ্লবের গতিধারাকে। জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার চেতনাও লক্ষ করা যায় এই আন্দোলনে। বিভিন্ন দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি-সাংস্কৃতিক পরিবেশনাগুলো তার স্বাক্ষর বহন করে। জুলাই বিপ্লবের এসব মৌল চিন্তা বাস্তবে রূপায়ণের জন্য প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা এর মৌলিক শর্ত। সুষ্ঠু নিরপেক্ষ দলীয় ও প্রভাবশালীদের প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে সব দলের ঐকান্তিক সহমত ও সহযোগিতা। একটি স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং সুবিধাসম্পন্ন নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরির প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সহযোগিতার দায় রাজনৈতিক দল ও নেতাদের। ইদানীং গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করা যাচ্ছে, সমস্ত রাজনৈতিক দল, ব্যক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠান যারা এক হয়ে পতিত সরকারের পতন ঘটিয়ে ড. ইউনূসকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল; তাদের অনেকেই আজ তাকে তাড়ানোর জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। সামাজিক অস্থিরতার সমস্ত দায় তার ঘাড়ে চাপানো কতটুকু যৌক্তিক? এ দ্বিচারিতা কোনোভাবেই দেশের কল্যাণ বয়ে আনবে না- এ কথা সবারই উপলব্ধি করা দরকার। অতীতে রাজনৈতিক অনৈক্যের কারণে জাতিকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। জাতি এর পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না।

এই মুহূর্তে সবার আগে দরকার জাতীয় ঐকমত্য। জাতীয় স্বার্থে সব দলেরই ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। না হলে জাতির সামনে আবারো সঙ্কটের অমানিশা ঘনিয়ে আসতে পারে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ